ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে পুলিশে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র জনতার আন্দোলন সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪ সালে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান। এসব আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, গ্রেফতার এবং নিপীড়ন কৌশল নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষত ছাত্র জনতার প্রতিবাদের সময় পুলিশের আচরণ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, এবং রাবার বুলেটের ব্যবহার দেখা যায়। এই ধরনের আচরণ ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষণ, অত্যাচার ও নির্যাতন; যেমন বিনা কারণে গ্রেফতার, হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ, এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের মতো ঘটনা ছাত্র সমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের দমনপীড়নের ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের অধিকারের প্রতি পুলিশের শ্রদ্ধার অভাব প্রকাশিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার রাস্তায় আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচণ্ড সমালোচনার জন্ম দেয়। এছাড়াও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার জনগণের আস্থায় বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ এ ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে পত্রিকা মতে প্রায় ৪০০ ছাত্র জনতাকে হত্যা করা হয়, যাজনগণেরমনেগভীরহতাশা এবং ক্ষোভ সৃষ্টিকরে। সম্প্রতি সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদের বিপুল সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনের খবরও পুলিশের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। পাশাপাশি, বিগত সরকার পুলিশকে দলীয় বাহিনীতেপরিণত করে বাহিনীটির ওপর জনগণের আস্থা কার্যত বিনষ্ট করেছে। তাছাড়াও এটা লক্ষ্যণীয় যে বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্যের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, বিশেষত মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে। আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ তারই প্রমাণ।
পাশাপাশি পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি।উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে বরগুনার এক যুবক পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন।পরিবারের অভিযোগছিল, পুলিশি নির্যাতনের ফলেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরেও দায়ী পুলিশসদস্যদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ধরনে ঘটনাগুলো পুলিশের জবাবদিহিতার অভাব এবং হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সুরক্ষায় পুলিশের ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরে, যা আইনের শাসন এবং মানবাধিকার রক্ষায় গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করে।
পুলিশকে মানবাধিকার সম্মান করতে হবে এবং তাদেরকে এই বিষয়ে আরো প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুলিশ বাহিনীর মতো বাংলাদেশ পুলিশেরও মানবাধিকার সংরক্ষণে কাজ করা উচিত।পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করতে হবে, যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে দেখা যায়।
এইজন্য পুলিশের নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রেখে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মতো বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ বাহিনী স্থানীয়, রাজ্য, এবং ফেডারেল স্তরে বিভক্ত থাকে, যা জবাবদিহিতা বাড়ায় এবং জনগণের সেবার মান উন্নত করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পুলিশ বাহিনীকে স্থানীয় প্রশাসন, পৌরসভা, এবং জেলা পরিষদের অধীনে রাখা যেতে পারে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে। শুধুমাত্র পুলিশের পোশাক এবং লোগো পরিবর্তন করলেই হবে না; পুরো পুলিশ বাহিনীর চরিত্র ও মনোভাবের পরিবর্তন করা জরুরি। জনগণের সেবা, মানবাধিকার রক্ষা, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি পুলিশের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, নরওয়ের পুলিশ বাহিনী যেখানে সেবা, মানবাধিকার এবং শান্তিপূর্ণ মীমাংসা নিয়ে কাজ করে, সেরকমই একটি মনোভাব বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। এইজন্য পুলিশ বাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার না করে একটি নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রথমত, পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, এবং বদলির প্রক্রিয়া গুলোতে স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রভাব মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই এইধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশের প্রশিক্ষণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, এবং পেশাদারিত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।এতে করে পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের অধিকারকে সম্মান করবে এবং রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। তৃতীয়ত, পুলিশের কাজের উপর নিয়মিত এবং স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া চালু করা উচিত, যা জনগণের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে পুলিশের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য স্বাধীন পুলিশ কমপ্লেইন্টসকমিশন (IPCC) রয়েছে, যা পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে।
এ ধরনের একটি সংস্থা বাংলাদেশেও চালু করা হলে, পুলিশের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সহজ হবে।এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে, পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
পুলিশকে বিরোধী দল দমন বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কণ্ঠরোধের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কেবল আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা উচিত।
বাংলাদেশ পুলিশের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করে লেখাটি শেষ করব। ২০১০ সালের এক বিকেল। খুলনা অফিসার্স ক্লাবের লন টেনিস কোর্টে বসে আছি, ঘড়ির কাঁটা তখন৫টা ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ করেই ১০ থেকে ১৫ জন সশস্ত্র পুলিশ এসে কোর্টের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। দৃশ্যটা দেখে আমি হতবাক। পাশে বসা এক অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, "এত পুলিশ কেন?" তিনি বিরক্তি চেপে বললেন, "ডি আই জি সাহেব আসছেন টেনিস খেলতে।"
কিছুক্ষণ পরই তিনি এলেন একটি বিলাসবহুল SUV গাড়িতে, সঙ্গে চারজন কনস্টেবল। একজনের হাতে তোয়ালে, আরেকজনের হাতে টেনিস ব্যাট, একজন পানি বোতল আর একজনের হাতে বল। একজন ডি আই জির পেছনে ১০-১৫ জন সশস্ত্র পুলিশ এবং ৪-৫ জন কনস্টেবল, এরা সবাই রাষ্ট্রের বেতনে তার ব্যক্তিগত আরাম এবং বিলাসিতার জন্য নিয়োজিত।
প্রশ্ন জাগে, এই ডি আই জি দেশের অর্থনীতিতে কতটুকু অবদান রাখছেন? রাষ্ট্রের কর্মচারীরা তার ব্যক্তিগত বিলাসিতার জন্য ব্যবহৃত হয়ে দেশের কী উপকার করছে? আমাদের করদাতাদের কষ্টার্জিত অর্থ এভাবে অপচয় করে কি রাষ্ট্রের কোনো মঙ্গল হচ্ছে? এসপি থেকে উপরের দিকে যতই উঠবেন,ততই এই অপচয়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। সময় এসেছে পরিবর্তনের, সময় এসেছে পুলিশের ভিতর থেকে এই অন্যায় বিলাসিতা বন্ধ করার। দেশপ্রেমের সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে হলে, আমাদের এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বর্তমান পুলিশের সংস্কারের জন্য আর বিলম্ব করা সম্ভব নয়। একবিংশ শতাব্দীর চাহিদাও প্রত্যাশার সাথে তাল মিলিয়ে পুলিশবাহিনীকে আধুনিক, দক্ষ, এবং মানবিকভাবে গড়ে তোলা অপরিহার্য। শুধু পোশাক আর লোগোর পরিবর্তন যথেষ্ট নয়।
প্রয়োজন চরিত্রও মনোভাবের পরিবর্তন। বিরোধীদল দমনপীড়নের হাতিয়ার না হয়ে, পুলিশকে একটি নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি।এ ই
সংস্কার দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করবে এবং তরুণ প্রজন্মের আস্থা ফিরিয়ে আনবে।পুলিশের এই নতুন চরিত্র আমাদের সবার জন্য একটি নিরাপদ এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে, যেখানে ছাত্র-যুব সমাজ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।