ঢাবির ডিন নির্বাচন: দুর্বল একাডেমিক ব্যক্তিদের ক্ষমতাবান হওয়ার সিঁড়ি

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিয়ায় পদ-পদবি প্রাপ্তি কি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা ঠিক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে বিভিন্ন অনুষদের ডিন পদটি পূরণ করা হয় সে অনুষদের শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে বা নির্বাচনের মাধ্যমে। আমার জানামতে, পৃথিবীতে এমন দ্বিতীয় আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে ডিন হয় নির্বাচনে জিতে। নির্বাচনে জিততে হলে ভোটারদের মন জিততে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুশি হয়, এমন কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।

ভালো কাজ করার প্রতিশ্রুতিতে কেউ তেমন খুশি হয় না। যা করা উচিত না- যেমন তাড়াতাড়ি প্রমোশনের ব্যবস্থা করা বা ভর্তি পরীক্ষার বড় বড় দায়িত্ব দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান করার মত কিছু প্রতিশ্রুতি দিলে শিক্ষকরা খুশি হয়। তাছাড়া ভোট ভিক্ষা করতে হয়।  একজন একাডেমিক্যাললি সাউন্ড শিক্ষকদের অহমবোধ অনেক প্রখর থাকে। সে তেলাতেলি করতে পারে না। দুর্বল একাডেমিক ব্যক্তিদের ক্ষমতাবান হওয়ার সিঁড়ি হলো নির্বাচন। তারা ভোট ভিক্ষা চাইতেও দ্বিধা করে না।

আমার কাছে আমার সহকর্মী এসে যখন মাথা নুইয়ে খুব বিনয় দেখিয়ে ভোট প্রার্থনা করে, সে দৃশ্য আমি নিতে পারি না। এসব দেখে নিজেই লজ্জিত হই। তাই আজ অনেক বছর হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও নির্বাচনে ভোট দিই না। এতে আমার উপর অনেকেই নাখোশ, কিন্তু পরোয়া করি না।

একটু ডাটা দেখে, একটু গবেষণা করে দেখুন, কি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন কি ডিন নির্বাচন- সবক্ষেত্রেই ভোটের মাধ্যমে অযোগ্যরা ক্ষমতায়িত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধপতনের অন্যতম কারণ এটি। নির্বাচন যদি এতই ভালো হতো তাহলে- এমআইটি, হার্ভার্ড, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, স্ট্যানফোর্ডসহ বিশ্বের সকল ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন, ভিসি ইত্যাদি নির্বাচনের মাধ্যমেই হতো।

শুধু নির্বাচন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়তগুলোতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পূরণ হয় সিনিয়রিটির ভিত্তিতে। সেটি হলো বিভাগের চেয়ারম্যান। বয়সে সিনিয়র এটা কোনও যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ারম্যান বা বিভাগীয় প্রধান নিয়োগের জন্য একটা সার্চ কমিটি থাকে। সেখানে তারা উম্মুক্ত দরখাস্ত আহবান করে এবং প্রার্থীদের কাছে কিভাবে বিভাগকে নেতৃত্ব দিবে তার রোডম্যাপ চায়। এছাড়া অন্যান্য বিষয় যেমন গবেষণার অভিজ্ঞতা, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, একাডেমিক এক্সেলেন্স ইত্যাদিতো আছেই। তারপর কয়েকটি স্তরে শর্টলিস্ট করতে করতে একটা rigorous প্রসেস অনুসরণ করে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

যিনি বিভাগের নেতৃত্বে আসেন তিনি একটা মিশন নিয়ে আসেন এবং এই পদটি তিনি যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করেন। একাডেমিয়াতে প্রতিটি পদে আসীন হতে হলে সেটি পেলে নিজ যোগ্যতায় অর্জন করেছেন এই ফিলিংস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন বয়সে সিনিয়র হওয়াতো কোন অর্জন না। আমাদের দেশে সবকিছুতেই সিনিয়রিটিকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ একটা ভালো সিস্টেমে মেধা দিয়ে সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার রাস্তা থাকতে হয়। এটাই হলো ভালো কাজের ইন্সেন্টিভ। এই ইন্সেন্টিভ না থাকলে মানুষ ভালো কাজ করবে কেন? 

আরো পড়ুন: ঢাবিতে আস্থার কাউকে ভিসি নিয়োগ দিলে তাদের ডাকেও মানুষ এভাবে সাড়া দেবে

কেউ যদি এমন হয় যিনি বিশ্বসেরা জার্নাল যেমন নেচার বা সাইন্সে কিংবা PNAS-এ আর্টিকেলসহ অন্যান্য ভালো জার্নালে প্রচুর আর্টিকেল আছে, যা তার চেয়ে বয়সে সিনিয়র অনেকের ধারে কাছেও নাই। সে কেন অতি দ্রুত অল্প বয়সেই অধ্যাপক হতে পারবে না? আমরা আমাদের প্রোমোশনের নীতিমালায় একটা নির্দিষ্ট বছরের অভিজ্ঞতা বেঁধে দিয়েছি, যেটা উন্নত ভালোমানের গবেষণা দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখিনি। উন্নত দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পথ উম্মুক্ত। ফলে অনেকে সরাসরি অধ্যাপক পদেও নিয়োগ পেতে পারে বা সহকারী অধ্যাপক থেকে সরাসরি অধ্যাপক হয়ে যেতে পারে। এটা হলে মানুষের মধ্যে প্রাপ্তির বাসনা জাগে এবং পেলে তৃপ্তি আসে।

এসব কথাগুলো যে বললাম, এগুলো আমার আবিষ্কার না। বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে পথ অনুসরণ করে উন্নত হয়েছে- আমি কেবল সেগুলোই বললাম। আমরা যে পথ অনুসরণ করছি- সে পথ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে কেবল নিম্নগামী করছে। যেসব নিয়ম আমাদের ব্যর্থতার কারণ সেগুলোকে চিহ্নিত করে ভালো পরীক্ষিত প্রমাণিত নিয়ম দ্বারা প্রতিস্থাপিত না করলে আমরা আরো তলিয়ে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন, সিনিয়রিটি ইত্যাদি criteria-র কোন স্থান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় হতে হয় মেধার প্রতিযোগিতা।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ