কৃষি গুচ্ছভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য
কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রি প্রদানকারী ৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং তারিখে acas.edu.bd ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ ও ফলাফল প্রস্তুতিতে কিছু বৈষম্য আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
আমি প্রক্টর/অ্যাডভাইজার/উপ-উপাচার্য হিসেবে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ভর্তি কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তখন ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষার চতুর্থ বিষয়সহ জিপিএ উল্লেখ করা হতো এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সমূহের প্রতিটিতে আলাদা আলাদাভাবে কমপক্ষে ৩.০০ জিপিএ থাকা বাধ্যতামূলক ছিল।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে কৃষিতে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর (২০১৯-২০ থেকে) আবেদনকারীদের ভোগান্তি কমলেও আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান উভয় পরীক্ষায় (চতুর্থ বিষয় ব্যতীত) ন্যূনতম জিপিএ নির্ধারণ করায় আবেদনকারীরা সমসুযোগ পাবে না। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সমূহের প্রতিটিতে আলাদা আলাদাভাবে ন্যূনতম জিপিএ উল্লেখ না থাকায় উল্লিখিত বিষয়সমূহে শুধু উত্তীর্ণ প্রার্থীদেরই আবেদনের সুযোগ থাকছে।
এপ্রিল ১৬ তারিখে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্যসমূহ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :
আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণে বৈষম্য বিজ্ঞপ্তির ২ নং ক্রমিকে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নিম্নরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে :
ক. ২০১৯/২০২০/২০২১ সালে এসএসসি/সমমান এবং ২০২২/২০২৩ সালে এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় যারা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সহ উত্তীর্ণ হয়েছে, শুধু তারাই আবেদন করতে পারবে।
খ. আবেদনকারীর এসএসসি/সমমান এবং এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উভয় ক্ষেত্রে প্রতিটিতে চতুর্থ বিষয় ব্যতীত ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ এবং সর্বমোট ন্যূনতম জিপিএ ৮.৫০ থাকতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষি গুচ্ছে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সমূহে উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে উক্ত চার বিষয়ের প্রতিটিতে আলাদাভাবে কত জিপিএ থাকতে হবে, তা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ উক্ত চার বিষয়ে শুধু উত্তীর্ণ হলেই চলবে। উক্ত চার বিষয়ের মধ্যে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান সবার জন্য আবশ্যিক।
সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের একটি তৃতীয় আবশ্যিক, অন্যটি অতিরিক্ত (চতুর্থ) বিষয় হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ কৃষিতে ভর্তির জন্য সব আবেদনকারীকেই উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে উক্ত চার বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। জীববিজ্ঞান ও গণিত ব্যতীত অন্য কোনো বিষয় চতুর্থ বিষয় হিসেবে থাকলে তিনি ভর্তির অযোগ্য। কিন্তু ভর্তির জন্য আবেদনের যোগ্যতা এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় চতুর্থ বিষয় ব্যতীত ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ নির্ধারণ করায় একই যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে কেউ ভর্তির সুযোগ পাবে, আবার কেউ সুযোগ পাবে না।
উপরোক্ত ’ক’ ও ’খ’ উভয় আবেদনকারীর এইচএসসি পরীক্ষায় মোট জিপিএ ৪.৩৩ হওয়া সত্ত্বেও ’ক’ আবেদনকারীর তৃতীয় আবশ্যিক বিষয়ে কম জিপিএ (৩.৫) ও চতুর্থ বিষয়ে বেশি জিপিএ (৫) থাকায় চতুর্থ বিষয় ব্যতীত তার জিপিএ ৩.৮৩ থাকার কারণে তিনি ভর্তির অযোগ্য।
অন্যদিকে ’খ’ আবেদনকারীর তৃতীয় আবশ্যিক বিষয়ে বেশি জিপিএ (৫) ও চতুর্থ বিষয়ে কম জিপিএ (৩.৫) থাকায় চতুর্থ বিষয় ব্যতীত তার এ ৪.০৮ থাকার কারণে তিনি ভর্তির যোগ্য। অথচ উভয়েরই জীববিজ্ঞান ও গণিতের একটি তৃতীয় আবশ্যিক ও অন্যটি চতুর্থ বিষয় হিসেবে উত্তীর্ণ। উপরোক্ত পর্যালোচনায় বোঝা যায় যে একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আবশ্যিক বিষয়ে কম ও অতিরিক্ত বিষয় বেশি জিপিএ থাকার কারণে একজন আবেদনকারী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে; অথচ একই যোগ্যতা থাকা অন্য আবেদনকারী আবশ্যিক বিষয়ে বেশি ও অতিরিক্ত বিষয় কম জিপিএ থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে।
ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য
বিজ্ঞপ্তির ৬ নং ক্রমিকে ফলাফল প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিম্নরূপে পদ্ধতি উল্লেখ করা হযেছে :
‘মোট ১৫০ নম্বরের ভিত্তিতে ফলাফল প্রস্তুত করা হবে। ভর্তি পরীক্ষার ১০০ নম্বরের সঙ্গে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের (চতুর্থ বিষয় ব্যতীত) ভিত্তিতে ২৫ এবং এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের (চতুর্থ বিষয় ব্যতীত) ভিত্তিতে ২৫ নম্বর যোগ করে ফলাফল প্রস্তুত করে মেধা ও অপেক্ষমাণ তালিকা তৈরি করা হবে। ’
প্রত্যেক আবেদনকারীর ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের একটি তৃতীয় আবশ্যিক ও অন্যটি চতুর্থ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। অতএব এ ক্ষেত্রেও যার তৃতীয় আবশ্যিক বিষয়ে বেশি নম্বর ও চতুর্থ বিষয়ে কম নম্বর, তার ২৫ নম্বরের মধ্যে বেশি নম্বর যুক্ত হবে, অথচ একই বিষয় পড়েও যার তৃতীয় আবশ্যিক বিষয়ে কম নম্বর ও চতুর্থ বিষয়ে বেশি নম্বর আছে, তার কম নম্বর যুক্ত হবে। সব প্রার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ নিয়মটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
উপরোক্ত বিষয়াবলির সঠিক অনুধাবনের জন্য গভীর পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। আশা করি কৃষি বিশ্বদ্যািলয়গুলোর উপাচার্যবৃন্দের সঠিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা রয়েছে এবং একই যোগ্যতাসম্পন্ন সব প্রার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করেন। অধিকতর যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য নিম্নোক্ত শর্ত আরোপ করা যেতে পারে :
১. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটিতে কমপক্ষে জিপিএ ৪.০০ (চতুর্থ বিষয়সহ) এবং মোট জিপিএ কমপক্ষে ৮.৫ এর স্থলে ৮.৭৫ বা ৯.০০ (চতুর্থ বিষয়সহ) নির্ধারণ করা যেতে পারে।
২. উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের প্রতিটিতে কমপক্ষে জিপিএ ৩.৫ নির্ধারণ করা যেতে পারে, এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ইংরেজি বিষয়েরও ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৩. ফলাফল প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার নম্বরের সঙ্গে এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষার মোট জিপিএ বা মোট নম্বর যোগ করে প্রস্তুত করতে হবে।
উল্লেখ্য, সাধারণ গুচ্ছভুক্ত ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শাখা থেকে এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আবেদনকারীদের এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান উভয় পরীক্ষায় (চতুর্থ বিষয়সহ) ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫সহ সর্বমোট জিপিএ কমপক্ষে ৮.০০ নির্ধারণ করা আছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অকৃষি অংশ উল্লিখিত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত।
আশা করি, সমযোগ্যতাসম্পন্ন সব শিক্ষার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপাচার্যবৃন্দ বিষয়টি আমলে নিয়ে পুনঃ ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তা না হলে ভুক্তভোগী যে কেউ আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে।
লেখক : সাবেক উপ-উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
কালের কণ্ঠ থেকে নেওয়া