অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ও মানুষের প্রত্যাশা
ড. মুহাম্মদ ইউনুস’র নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি সংবিধানের অধীনে গঠিত হয়েছে? মহামান্য সুপ্রিম যদি কোর্ট বলেছেন, এটি সংবিধানসম্মত। যদি তাই হয় তাহলে সংসদ ভেঙে দেয়ার দিন থেকে নিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ধরে নেয়া যাক, ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন হলো। ফলাফল সবারই কমবেশি জানা। দুই তৃতীয়াংশের বেশী সিট পেয়ে বিএনপি যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বি এন পি ক্ষমতায় এসে সংবিধান পরিবর্তন করবে। রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের অনুকূলে আনা ও রাখার জন্যে যা যা পরিবর্তন পরিবর্ধন পরিমার্জন সংবিধানে দরকার তারা তাই করবে। এ জন্যে তাদের সকল রেজিস্ট্রার খাতাপত্র তৈরি বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন।
এজেন্ডার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- দেশের সকল প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত সকল জায়গায় নিজেদের লোক বসানোর যে সংস্কৃতি বিদ্যমান তাই তারা অনুসরণ করবে। গুমঘর আর আয়না ঘর যে নূতন নামে আবার হবে না - তা কে বলতে পারে? চাকরির ক্ষেত্রে মেধার সকল স্তর অতিক্রম করার পর শেষ পরীক্ষা হবে প্রার্থী, তার পিতামাতা, গোষ্ঠিজ্ঞাতি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক? পদোন্নতির ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। দিনের ব্যবধানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে কেজি প্রতি ১/২ টাকা।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলন: বিশৃঙ্খলার মূল্য কত?
অর্থাৎ বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ যা যা করেছে বি এন পি তাই তাই করার চেষ্টা করবে। এগুলো করা তাদের জন্যে সহজতর হবে। কারণ এর আগেও তো তারা এসব করেছে। পাঁচ বছর এ ভাবে চলার পর তারা আওয়ামী লীগের মত নির্বাচনে কারচুপি করে আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ আবার সংগঠিত হয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামবে – সৃষ্টি হবে ১৯৯০, ২০০৭ কিংবা ২০২৪। মাঝখান থেকে জনগণের চির আকাঙ্ক্ষিত ও সংবিধানের প্রধানতম প্রতিশ্রুতি গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার রয়ে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই।
তা হলে বিষয়টি কি এমন দাঁড়াচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৩ মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে জাতিকে এক স্বৈরাচারের হাত থেকে আর এক স্বৈরাচারের নিকট হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন? কিন্তু মানুষের ভোটের অধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা লাভ ও সুবিচার প্রাপ্তির কী হবে? বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নামে ছাত্রছাত্রী, দেশবাসীর যে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল তার কী হবে? নোবেল বিজয়ী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনুস’র কাছে কি ছাত্র জনতার এই প্রত্যাশা?
ছাত্ররা বলছে, ছাত্র-জনতা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য রাজপথে নামেনি। তাদের কোনো কর্মসূচিতে সে রকম কিছু নেই। কিন্তু তারা এখন এবং ২০১৮ সালেও বারবার সংস্কারের কথা বলেছে। যে সংস্কারে থাকতে হবে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের বিশেষ একজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্তৃত্বের অবসান, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নে এবং স্থানীয় সরকারের উন্নয়নকাজে পৃথক ভূমিকা নিশ্চিত করা, জাতীয় বাজেট প্রণয়নে জন–অংশগ্রহণ বাড়াতে সংবিধানের ৮০-৯২ অনুচ্ছেদের সংস্কার এবং বিশেষভাবে ভোটব্যবস্থার এমন এক সংস্কার, যাতে ভোট অনুযায়ী আসনের হিস্যা নির্ধারিত হয়। সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তকে নির্বাচিত ঘোষণা করে অন্য প্রার্থীর সমর্থক ভোটারদের রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বঞ্চিত করার বিষয় সংশোধন হলে জাতীয় নীতিনির্ধারণে পুরো দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে।
ড. ইউনুস এই সকল দাবীদাওয়া সপর্কে নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল আছে। এখানেই শেষ নয় – তাদের দাবি - ক্ষমতাচ্যুত সরকারের যাবতীয় অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, গুম, দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, ক্ষমতাকেন্দ্রীভূতকরণ ও অপব্যবহার এবং এ সবের জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে প্রাণহানি ঘটেছে এবং ইতঃপূর্বেকার সরকার কর্তৃক যে অত্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি হয়েছে তার বিচার করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাব নিরীক্ষক – এ সব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। ন্যায়পাল নিয়োগ করা সহ আনুষঙ্গিক যে সব সংস্কার করা দরকার – সেগুলোতে হাত দিতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়া, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার পরে প্রয়োজনীয় আইন করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে। তারা আরও দাবি করছেন বিদ্যমান জঞ্জাল সরানোর জন্যে এবং ভবিষ্যতে যাতে কেউ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে না পারে, প্রত্যেকে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত থাকে – সে জন্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে
সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? দেশ স্বাধীন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারাই রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় ঢুকছে, তারাই ‘প্রভু’ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, ‘স্বৈরাচার’ তৈরির অনিবার্য উপাদান এখনকার প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভেতর রয়ে গেছে। সুতরাং সবার তরফ থেকে সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রনৈতিক সংস্কারই এখানে সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে পারে। আপাতত সংস্কারের এজেন্ডা হিসেবে শিক্ষার্থীরা কোটা প্রশ্ন নিয়ে সামনে এলেও বিষয়টা হঠাৎ আসেনি। হঠাৎ এভাবে হাজার হাজার আবু সাঈদ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়নি। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও ‘রাষ্ট্র মেরামতে’র প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এনেছিল কিশোর-তরুণেরা। কেউ মোটাদাগে গুরুত্ব দেয়নি। সেই দাবিই এখন সরকার পতনের একদফা দাবিতে পরিণত হয় এবং চার শতাধিক প্রাণ ঝরে যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতা প্রত্যাশা করে ড. ইউনুস’র নেতৃত্বে গঠিত নবীন-প্রবীণের এই সরকার রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে এমন কিছু সংস্কারে হাত দিবেন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচার ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে। বিশেষ করে সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত হত্যা ও ধ্বংসের জন্যে দায়ী যে রাষ্ট্রক্ষমতা ও তার একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুঘটক উপাদানসমূহের ন্যায়ানুগ প্রতিস্থাপন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ। তা না করে শুধু মাত্র একটি নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণ হবে না। তাই আমরা মনে করি, এই সরকার
-জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করবেন এবং দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন;
-সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করবেন; নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতও চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত এবং গুরুতর আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন;
-গুম খুন ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ভবিষ্যতে কাউকে তুলে নিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) বা থানায় হাজির করার সংস্কৃতি বন্ধ করবেন;
-সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ, ক্যাম্পাসে গণরুম ও ‘গেস্টরুম কালচার’ ও র্যাগিং বন্ধ, যোগ্যতার ভিত্তিতে হলে আসন বরাদ্দ দেওয়া, এবং তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশে সব ক্যাম্পাসে নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন; এবং
-শিক্ষা শেষে ও শিক্ষা গ্রহণকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য যথাযোগ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ছাত্র-জনতা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যও ছিল তাই। যেহেতু সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত, তাই তাদের দাবি ছিল প্রধানত মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ প্রদান করতে হবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের মাধ্যমে ছাত্ররা তাদের সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছে। আমরা আশা ও বিশ্বাস করি, ড. মুহাম্মদ ইউনুস তার মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং বৈশ্বিক সুনাম ব্যবহার করে এই জাতির প্রত্যাশা পূরণে ত্রুটি করবেন না। স্রষ্টা আমাদের সহায় হউন।
লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd