০২ নভেম্বর ২০১৮, ১৮:৪৩

অনুকরণীয় শিক্ষক চাই

ড. আমিনুল ইসলাম

একথা সুবিদিত যে, যথার্থ শিক্ষা কেবল একটা তত্ত্ব জ্ঞানের ব্যাপার নয়, শিক্ষার অবশ্যই একটা ব্যবহারিক নৈতিক দিকও আছে। এ উপলব্ধি থেকেই জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞানচর্চা (Knowledge for the settle of knowledge) কথাটির প্রতি আজকাল আর কেউ তেমন একটা আগ্রহ দেখান না। বরঞ্চ আমরা যাকে সামাজিক উদ্যোগ বলি, সেটি গ্রহণ ও আনুষঙ্গিক সব দায়-দায়িত্ব পালনে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করাকেই আজ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য বলে মনে করা হয়। আর এই লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষকদের ভূমিকা নি:সন্দেহে অপরিসীম। অর্থাৎ শিক্ষকরা নিছক শিক্ষাদানের মধ্যেই তাদের দায়-দায়িত্ব সীমিত না রেখে শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণের কথা ভাববেন। শিক্ষার্থীদের চলার পথের দিগদর্শন দিবেন, শিক্ষার্থীরা যেন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে, সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিবেন, এটাই তাদের কাছে দেশ ও সমাজের প্রত্যাশা। এজন্যই বলা হয়, শিক্ষক মাত্রই শিক্ষার্থীদের রোল মডেল বা অনুকরণীয় আদর্শ স্বরূপ।

শিক্ষক মানেই মানুষ গড়ার কারিগর, শিক্ষার্থীদের বন্ধু, দার্শনিক ও দিশারি (friend, philosopher and guide)। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫-১৯৬৯) বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, শিক্ষকদের কাজ মানুষ চাষ করা, শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানুষ করা। আর তা যদি করতে হয়, তা হলে দায়িত্বশীল শিক্ষকদের কেবল শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের খোরাক দিলেই চলবে না, তাদের দেহ মন ও অন্তরাত্মার সঠিক বিকাশের দিকেও নজর রাখতে হবে, তাদের সৎ মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিক্ষকদের নিজেদেরই প্রথমে আদর্শ ও অনুকরণীয় হওয়া চাই। নয়তো তাদের উপদেশ হবে ‘কাঁকড়ার উপদেশের মতো যে তার বাচ্চাদের সোজা হয়ে চলার জন্য উপদেশ দেয়’। এসব কথার মূল মর্মটা এই যে, একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি। তাঁর লক্ষ্য হওয়া উচিত ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা-মস্তিষ্ক ও ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে পরিগঠন করা যাতে করে তাদের কোমল মনে শুভবুদ্ধি দেশপ্রেম ও মানবকল্যাণের প্রেরণা সৃষ্টি হয়, তারা যেন কালক্রমে দেশ ও দশের যথাযথ সেবা করতে সক্ষম হয়।

জ্ঞানার্জন গবেষণা ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন এমন একটি গুরুদায়িত্ব যা কোনও শিক্ষাকেই উপেক্ষা করতে পারেন না। যদি কেউ করেন, তা হলে তাঁর পেশাগত মর্যাদা এবং দেশ ও দশের সামগ্রিক কল্যাণ ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য। একজন শিক্ষকের মূল কর্তব্য যদি হয় পাঠদান, তা হলে তাঁর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হবে সফল পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন ও সত্যানুসন্ধান। শিক্ষক নিজেই যদি পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী না হন, গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন সত্য উদঘাটনে যদি তাঁর আগ্রহ না থাকে, তা হলে তিনি শিক্ষার্থীদের দার্শনিক ও দিশারি হবেন কি করে? একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের বেলায়। এ বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বুঝায় এমন একটি বিদ্যাপীঠকে যেখানে সমান তালে চলতে থাকে জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ, গবেষণা ও বিদ্যাদানের সম্মিলিত কর্মপ্রবাহ। আর পরিপূর্ণ শিক্ষক বলতেও বুঝায় এমন একজন অনুসন্ধানী পণ্ডিত ব্যক্তিকে যিনি একাধারে জ্ঞান আহরক, সত্য উদঘাটক এবং জ্ঞান-সত্যের নিবেদিতপ্রাণ পরিবেশক।

শিক্ষকতা এমন একটি মহান পেশা যার সঙ্গে সমগ্র দেশ ও জাতির কল্যাণ অকল্যাণ যুক্ত। আর এ জন্যই এ পেশায় সবাই দেখতে চান কিছু বিদ্যানুরাগী ভালো মানুষ যাঁরা কেবল অসাধারণ মেধার অধিকারীই নন, শিক্ষকতা পেশার প্রতি নিবেদিত প্রাণও বটে। আর শিক্ষকতা পেশায় এ ধরনের মহৎ প্রাণ ব্যক্তিদের আগমন ও অবস্থান নিরাপদ ও সম্মানজনক। আমরা যদি উপযুক্ত নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে ও প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই, তা হলে আমাদের নির্দ্বিধায় এমন আস্থা সৃষ্টি করা দরকার, যেখানে শিক্ষকতা কেবল একটি মহান পেশাই নয়, নিরাপদ জীবন-জীবিকার উপায়ও বটে। শিক্ষকদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিযোগিতা থাকবে, আর সেটি হবে জ্ঞানকেন্দ্রিকক কী করে শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও মানসম্মত ও কার্যকর করা যায়। আর এক্ষেত্রে কৃতী শিক্ষক ও গবেষকদের তাঁদের মূল্যবান অবদানের জন্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রকৃত শিক্ষার লক্ষ্য কেবল জ্ঞান আহরণ ও বিতরণই নয়, একই সঙ্গে সত্যানুসন্ধান, সত্যার্জন তথা মহৎ মানবোচিত জীবনও বটে। শিক্ষাবিদরা যখনই এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন, তখনই হুমকির সম্মুখীন হয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ, তখন ক্রমে ক্রমে পণ্ড হতে থাকে শিক্ষার নৈতিক ও মানবিক লক্ষ্য। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবাধ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে কখনো সত্য অর্জন করা যায় না। আর তা নয় বলেই শিক্ষকদের চাই মত প্রকাশের প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া চাই বাহিরের অযাচিত হস্তক্ষেপ মুক্ত। স্বাধীন অনুসন্ধানের ফলে কোনও প্রচলিত বিশ্বাস, ধারণা বা মতবাদ ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে, এ আশঙ্কায় যদি দেশর সরকার স্বাধীন মত প্রকাশে কোনা রকম বাধা সৃষ্টি করে, শিক্ষা তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে ফেলে এবং ব্যাপক মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে শিক্ষার শক্তিও তাতে বিনষ্ট হয়। বিজ্ঞানী গালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) যখন তাঁর জ্যোতির্বিদ্যার বিখ্যাত মতবাদটি ঘোষণা করেন, তখন তাঁকে ঐশ্বরিক সত্য ও ঈশ্বরের বিধান বিরোধী মত প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। প্রত্যুত্তরে গালিলিও তাঁর বিচারকদের বলেছিলেন, ‘একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আমার সামনে ঐশ্বরিক সত্যের বিরুদ্ধাচরণ না করার একটি মাত্র পথই খোলা আছে, আমার আবিষ্কৃত সত্যকে প্রকৃত সত্য হিসেবে হাজির করা’। পরবর্তী প্রজন্মের তথা ইতিহাসের রায় গালিলিও’র পক্ষে গিয়েছে। গালিলিও’র এ সাহসী পদক্ষেপ স্বাধীন জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের দৃষ্টান্ত হিসেবে উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে।

তবে শিক্ষক ও গবেষকদের এই স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করতে গিয়ে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো বিতর্কিত বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে কোনও শিক্ষক যেন ব্যক্তিগত একপেশে মতামত, বিশেষত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যাপারে, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করেন; কারণ, তাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক পক্ষপাতদুষ্ট বলে চিহ্নিত হবেন। শিক্ষকতা ও জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা চাই এমন নির্ভেজাল স্বাধীনতা যেখানে পরিস্ফুট হবে শিক্ষকের বৌদ্ধিক এবং নৈতিক অখণ্ডতা এবং সত্য উদঘাটনের আন্তরিক চেষ্টা। সুতরাং কি শ্রেণি কক্ষে, কি বাহিরের সভা-সমিতিতে শিক্ষকদের দেখাতে হবে যে, তাঁরা যখন যা বলছেন তাতে যেন তাদের জ্ঞানার্জন ও সত্য উদঘাটনের অকৃত্রিম প্রয়াসে কোনও বিঘ্ন না ঘটে। কোনও শিক্ষক যদি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আস্থা ও সম্মানের সুযোগ নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা পক্ষপাতমূলক শিক্ষা দেন, তা হবে মহান শিক্ষকতা পেশার জন্য অবমাননাকর একটি নৈতিক বিচ্যুতি। কোনও মতের সমর্থনে কিংবা বিরুদ্ধে আমরা যখন যা বলি, তা হবে যুক্তি নির্ভর- এটাই শিক্ষক হিসেবে আমাদের কাছে সমাজ এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা।
শিক্ষকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ন্যায় তাঁদেরও রাজনীতি নিয়ে ভাবার এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য শুভ চেতনার ন্যায় রাজনৈতিক চেতনাও তাদের সত্তার অংশ। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় তখনি, যখন শিক্ষকতার মূল দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে কোনও শিক্ষক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং তাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করেন। ফলে এ শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিক অখণ্ডতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করে আসছি যে, রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁরা শিক্ষকদের দিয়ে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। এই অনুগত শিক্ষকদের বিভিন্ন সরকারী, আধাসরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যই বেশি প্রাধান্য পায়। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারী দলের শিক্ষকরা তখন বিরোধীদলের সমর্থক শিক্ষকদের যৌক্তিক কথাবার্তা ও দাবি-দাওয়াকেও আমলে না নিয়ে এক তরফাভাবে সরকারের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেন। এটি শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকদের কাছ থেকে আশা করা যায় না।

আগেই বলেছি, শিক্ষকতা একটি পেশা এবং শিক্ষকদের জীবিকা নির্বাহের একটি উপায়ও বটে। এখানে তাঁদের প্রতি সমাজের একটি গুরুদায়িত্বও রয়েছে। তাঁরা যেন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল থেকে তাঁদের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে পারেন, সেজন্য তাঁদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দেয়া দরকার। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় যে, জীবিকা নির্বাহের বাইরেও শিক্ষকতার একটা বিশেষ মিশন থাকা চাই; আর সেটি হবে সেবা (Service) ও মানব-কল্যাণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা। আর এই প্রেরণা, এই মৌলিক নীতিবোধ যার নেই তিনি যতবড় পণ্ডিতব্যক্তিই হন না কেন, তাঁর শিক্ষকতা জীবনটাই বিফল। নিজের ও পরিবারবর্গের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের জন্য শিক্ষক মাত্রই সম্মানজনক বেতন-ভাতা পাওয়া দরকার বটে; কিন্তু না পাওয়ার অজুহাতে (ক্লাস না নেওয়া, পড়াশোনা, গবেষণায় অনীহা) নৈতিক দিক থেকে কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।

আশা ও আনন্দের বিষয় এই যে, আমাদের শিক্ষক সমাজ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বহুলাংশে দায়িত্বসচেতেন। যেমন: বিগত শতাব্দীর আশির দশকে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সাপ্তাহিক ছুটি দু’দিন করা হয়েছিল। সারা দেশে যখন এ ব্যবস্থা কার্যকর, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অসহনীয় সেশনজট প্রশমন ও ছাত্র-ছাত্রীদের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে দু’দিনের জায়গায় একদিনের ছুটিই বহাল রেখেছিলেন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, অন্যান্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বহুভাবে এ ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শিক্ষকতা পেশার অনন্য মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু একই মুদ্রার আবার অন্য এক পিঠও আছে। যেমন শিক্ষকদের মধ্যে কেউ-কেউ নৈতিকতার চেয়ে অর্থনৈতিক ব্যাপারটাকে বড় করে দেখেন। আজকাল প্রায়শই অভিযোগ পাওয়া যায় যে, কোনও কোনও শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন না করে প্রাইভেট কোচিং করেন, এমনকি অননুমোদিতভাবে অন্যত্র কাজ করে থাকেন। এটা যে শিক্ষকতার মহান পেশার ওপর এক চরম আঘাত এবং ছাত্র-ছাত্রী তথা সমাজ ও দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় শুধু শিক্ষক নয়। সব ধরনের পেশাজীবীকেই আজ ভাবতে হবে অর্থোপার্জনের বিষয়টিকে কিছু মাত্র উপেক্ষা না করে কীভাবে পেশাগত দায়িত্বের সাথে নৈতিকতা ও মানব-কল্যাণের মহান মনোবৃত্তিটি অক্ষুন্ন রাখা যায়, কী করে বিভিন্ন পেশাকে স্বার্থবাদী মহলের অশুভ আধিপত্য থেকে মুক্ত করে ব্যাপক মানবকল্যাণে নিয়োজিত করা যায়।

শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সম্মানিত শিক্ষকদের প্রত্যেককেই হতে হবে পুরোপুরি আন্তরিক, শিক্ষকতাকে গ্রহণ করতে হবে নিছক একটি জীবিকা নির্বাহের উপায় কিংবা সুযোগ পেলেই অন্য কোনও লোভনীয় পেশায় বদলি হয়ে যাওয়ার অস্থায়ী পর্ব হিসেবে নয়, বরং সুমহান ব্রত হিসেবে। আগেই বলেছি, একজন প্রকৃত শিক্ষকের লক্ষ্য হবে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও মূল্যবোধের চেতনাকে মজবুত ও সমৃদ্ধ করা। একই সঙ্গে তাঁকে প্রয়াসী হতে হবে সেসব নতুন প্রাণ বিদ্যার্থীকে সৎ মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলায়।

একজন শিক্ষক হিসেবে আমি শিক্ষাঙ্গনে নিয়মিত জ্ঞান চর্চার পরিবেশ ও সংস্কৃতি দেখতে আগ্রহী। একই সঙ্গে দেখতে চাই শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রগঠনের আয়োজন। মুক্তবুদ্ধির চর্চা, পরমতসহিষ্ণুতা প্রভৃতি মানবিক মূল্যবোধে মনন ও অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করবে শিক্ষাঙ্গন। এখানে শিক্ষাদানের পাশাপশি শিক্ষকদের ও ব্রতী হতে হবে সৎ মানুষ ও সুনাগরিক গড়ার সামগ্রিক আয়োজনে। এটি করতে হলে একদিকে যেমন বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে, তেমন যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা তথা মূল্যবিদ্যার (value education) উপরও আরোপ করতে হবে সমান গুরুত্ব। অন্যথায় ঈপ্সিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের পরও নৈতিক অবক্ষয় ও মানবিক বিপর্যয় রোধ করতে আমরা ব্যর্থ হব। শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সফল হব না। আমরা কিছুতেই এ অবস্থা মেনে নিতে পারি না।

লেখক: অনারারি অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ; সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।