০২ আগস্ট ২০২৪, ১০:৪১

কোটা আন্দোলন: বিশৃঙ্খলার মূল্য কত?

  © টিডিসি ফটো

পরিপ্রেক্ষিত: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলনে নামে ২০১৮ সালের জুন মাসে। ঐ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তৎকালীন (যিনি এখনও স্বপদে বহাল) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, “কোটা নিয়ে যখন এত আন্দোলন তখন চাকরিতে কোন কোটাই থাকবে না”। সংসদ কার্যবিবরণীতে তাঁর ঐ বক্তব্য রেকর্ড হয় এবং তার ভিত্তিতে ‘সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করা হয়’। পরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের অযাচিত আন্দোলনে বিরক্ত হয়ে অমন মন্তব্য করেছিলেন। যদিও শপথ অনুযায়ী কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। যাই হোক,  ঐ নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হয় এবং তৎপরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট উক্ত নির্বাহী আদেশ স্থগিত করে কোটার পূর্বাবস্থা  বহাল রাখেন। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার তানিয়া আমির অবশ্য বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে যে মামলাটি হাইকোর্ট নিলেন তা আইনানুগ ছিল না। কেননা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কিংবা নিবন্ধিত কোন গ্রুপ ছাড়া অন্য কারো মামলা করার এখতিয়ার নাই। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত কোটা বাতিলের নির্বাহী আদেশ স্থগিতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি।

সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জানা যায় যে, হাইকোর্ট নির্বাহী আদেশ স্থগিতের পাশাপাশি এও মন্তব্য করেন যে, ‘ … নির্বাহী বিভাগ প্রয়োজন বোধ করলে বিদ্যমান কোটা সংস্কার করতে পারবেন’। তবে কোন নীতি নির্ধারণী বিষয়ে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগকে অমন আদেশ/অনুরোধ করতে পারেন কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন রেখেছেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমির (প্র আ ১৮ জুলাই ২৪)। এবারকার (২০২৪) কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের দাবি ছিল, ‘কোটার যৌক্তিক সংস্কার’। দেখা যাচ্ছে, ছাত্রদের দাবির সাথে হাইকোর্টের রায়ের মিল রয়েছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে কোটা সংস্কার ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে। কোনো আদেশই চিরস্থায়ী নয়, সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে ও প্রয়োজনে সবকিছুই পরিবর্তনযোগ্য। পরিবর্তনই উন্নয়ন। ধরে নিলাম, ছাত্ররা কারও ইন্ধনে দীর্ঘ ছয় বছর পর দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে এই আন্দোলনে নেমেছে। অবস্থা দৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে দায়িত্বশীলদের কাজ কী ছিল? অবস্থা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে তা বিশ্লেষণ করা ও ত্বরিত করণীয় ঠিক করে পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে আনা। কিন্তু বাস্তবে যা দেখা গেল তা এর বিপরীত। এখন হাইকোর্ট যদি নির্বাহী বিভাগকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা তো বলেছিলাম, প্রয়োজনে নির্বাহী বিভাগ কোটা সংস্কার করতে পারবেন। ছাত্রদের দাবিও ছিল ঠিক তাই। আপনারা (নির্বাহী বিভাগ) তা করতে ব্যর্থ হলেন কেন’? আপনাদের ব্যর্থতার কারণেই কি দেশে এই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়নি’? যে বিশৃঙ্খলা শুধু আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকা! এখানেই শেষ নয়।

এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট শিক্ষার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হতে পারে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে সেশন জ্যাম তৈরি হবে তার আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা কি আদৌ সম্ভব।  হাল আমলের আলোচিত ও সাধারণ মানুষের হৃদ্য় নাড়া দেয়া ঘটনা আরও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – বেনজির-মতিউর এর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল অবৈধ সম্পদ উপার্জন, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পিয়নের অবৈধ অর্জিত ৪০০ কোটি টাকার সন্ধান ও তার হেলিকপ্টারে যাতায়াত, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন’র (পিএসসি) গাড়ি চালক আবেদ আলীর নেতৃত্বে বিসিএস এর প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এর মাধ্যমে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের চাকরির সন্ধান এবং সর্বোপরি দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এর কাহিনী। ঘটনাগুলোকে বিশৃঙ্খলা বলি কিংবা ছাত্র আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ বলি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র বলি কিংবা বহিঃশক্তির সরকার উৎখাতের পাঁয়তারা, যাই বলি না কেন – এর ফলশ্রুতিতে সংঘটিত অভূতপূর্ব বিপুল প্রাণহানি, মূল্যবান স্থাপনার বিনাশ, অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ড বন্ধসহ পুরোদেশ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া বিশৃঙ্খলারই নামান্তর। অতএব বিশৃঙ্খলা কী এবং কেন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় – কীভাবেই বা এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার করে ব্যক্তি, পরিবার, দেশ ও সমাজকে রক্ষা করা যায় তা আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে। 

বিশৃঙ্খলা শব্দের অর্থ
‘বি’ প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য পদ ‘শৃঙ্খলা’ শব্দটি ‘বিশৃঙ্খলা’ শীর্ষক বিশেষণ পদ হিসেবে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মূলত ‘শৃঙ্খল’ বা ‘শৃঙ্খলা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘শিষ্য’ শব্দ থেকে এসেছে। শৃঙ্খলা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে– ডিসিপ্লিন (Discipline)। ইংরেজি Discipline শব্দটির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি (ওইডি) অনুসারে শব্দটির ব্যবহার সর্বপ্রথম ১৩৯৮ সালে রেকর্ড করা হয়। চশার ১৪০৫ সালের প্রথমদিকে বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত হিসাবে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।  

শৃঙ্খল একটি নামবাচক শব্দ। এর অর্থ – শিকল, নিগঢ়, বন্ধন। এটি সংস্কৃত শব্দ। এর থেকে উদ্ভূত হয়েছে – শৃঙ্খলা – রীতি, নিয়ম (শৃঙ্খলা বজায় রাখাঃ নিয়মানুবর্তিতা, সুব্যবস্থা (কাজের শৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা), বন্দোবস্ত, শৃঙ্খল, ইত্যাদি। এর বিশেষণ হচ্ছে – বিশৃঙ্খলা, শৃঙ্খলাবদ্ধ, শৃঙ্খলিত অর্থাৎ - শিকল দ্বারা আবদ্ধ।

আর বিশৃঙ্খলা অর্থ হচ্ছে – শৃঙ্খলাহীন, এলোমেলো, বিপর্যস্ত, নিয়মশূন্য, সমস্যাগ্রস্ত, উচ্ছৃংখলঃ বি+(=বিগত)+শৃঙ্খলা অর্থাৎ যেখানে বা যে অবস্থায় শৃঙ্খলা গত হয়ে গিয়েছে এমন অবস্থাই হল বিশৃঙ্খলা। তাই শৃঙ্খলা শব্দটি নিয়মানুবর্তিতা, উপদেশ, শান্তি, শিক্ষা, তপস্যা, সংযম, নিয়মনিষ্ঠা, বিনয়, বিনতি, বিনম্রতা, মর্মযন্ত্রণা, বাধ্যতা, নিয়মানুগ অভ্যাস, কঠোর শিক্ষা, নিয়মানুবর্তিকরণ, শিক্ষা দেওয়া, নিয়ন্ত্রিতকরণ, অভ্যাস করানো, কৌশল খাটানো, নির্দিষ্ট ব্যবহারবিধি, নিয়মাধীন করা, চরিত্রবল, সমস্যার সমাধান করা, ইত্যাদি অনুরূপ শব্দ (সিনোনিম) হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব
‘বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব’ একটি গাণিতিক তত্ত্ব। সমাজবিজ্ঞান এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় এর প্রয়োগ রয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানে, ‘বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব’ হল সামাজিক জটিলতার জটিল নন-লিনিয়ার সিস্টেমের অধ্যয়ন। 

‘বিশৃঙ্খল তত্ত্ব’, ১৯৭০-এর দশকে আবির্ভূত হয়। তত্ত্বটি খুব দীর্ঘায়ু না হলেও এখন পর্যন্ত তার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর বাস্তব জীবনের বিভিন্ন দিক এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং কসমোলজিতে পূর্বে অমীমাংসিত সমস্যার উত্তর দিতে সাহায্য করে। এটি হার্ট অ্যারিথমিয়া এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বোঝার ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। খেলনা এবং গেমগুলি বিশৃঙ্খলার গবেষণা থেকে বিকশিত হয়েছে, যেমন - কম্পিউটার গেমের সিম লাইন (সিমলাইফ, সিমসিটি, সিমআন্ট, ইত্যাদি)। বাংলাদেশের ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনকে ‘বিশৃঙ্খলা’ তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা এই তত্ত্বের অনুরণন লক্ষ্য করি। একটি সমস্যার দিকে যথাসময়ে দৃক্পাত না করা, মূল্যায়ন না করে ফেলে রাখা এবং তার থেকে উদ্ভূত বিপরীত লক্ষণ তৈরি হওয়া এবং পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হওয়া।  

বিশৃঙ্খলা কিভাবে তৈরি হয়?
যে কোন বিশৃঙ্খলার মূলে রয়েছে অধীনস্তদের অসন্তোষ, অধিকারহীনতা, বৈষম্য, বিচারহীনতা, অসাম্য, ঘৃন্য আচরণ, ঠাট্টা-মশকরার পাত্র হওয়া, সর্বোপরি হত্যার শিকার হওয়া। এই মূহুর্তে বাঙ্গালী জাতির জনক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবদ্দশায় প্রদত্ত শৃংখলা ও মানুষের মৌলিক অধিকারসম্পর্কিত কয়েকটি বাণী এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, 

‘৯. দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব।

১১. এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।

১৩. যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।

১৬. গরীবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে।

১৭. জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?

সূত্রঃ https://vatintelligence.gov.bd/site/page/d54ad7ae-ab43-4acd-9a72-[শিরোনামঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন]

বঙ্গবন্ধুর দর্শনের আলোকে দেশে উদ্ভূত সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই প্রকারান্তরে তিনি এমন বিশৃঙ্খলার প্রতি বহু বছর আগে ইঙ্গিত করেছিলেন যার দুর্ভোগ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার এই দর্শন বিশ্বের সকল বিশৃঙ্খল নির্যাতিত মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।  

বঙ্গবন্ধুর বাণী স্মরণের সাথে সাথে মনে পড়ে সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ বাণী আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিব নগরে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন,  

“…আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি …”।

এই ঘোষণা সকল বিশৃঙ্খলা, অন্যায়, অবিচার, অসাম্য প্রতিরোধ ও বিনাশ করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিধানের রক্ষাকবচ বৈ কি? 

বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা
সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলা যখন শিথিল হয়ে আসে, সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে, মানুষ যখন নিজের অধিকারহীনতা অনুভব করে অস্থিরতা বোধ করে তখনই সমাজ আবর্তিত ও অস্থির  হয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক থাকে, অর্থাৎ -  একটা সম্পর্ক আর একটি সমস্যার জন্ম দেয় যা জটিল সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থার বিমূর্ত ধারণা। এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক, জৈবিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক কারণসহ আরও নানা অনুষঙ্গ। সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব এবং ফলত সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে  পরিবার। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। এছাড়া দুর্নীতির বিস্তার, সম্পদ ও সুযোগের অসম বণ্টন, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা ও সুশাসনের অভাব নানাভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে বৃদ্ধি পায় সামাজিক সমস্যা তথা বিশৃঙ্খলা। 

তবে সামাজিক যে কোনো সমস্যা বা বিশৃঙ্খলার পেছনে পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অনস্বীকার্য। কারণ বিশ্বায়নের স্রোতে জাগতিকভাবে অনেক কিছুর অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটার সাথে ভোগবাদিতার বিকাশ ঘটেছে। স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বীয় দায়িত্ব পালনে অনীহা, যৌথ পরিবারের অনুপস্থিতি, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার চর্চাহীনতা, মাদকাসক্তি, পুস্তক পাঠে অনীহা, ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি অধিকতর মনোযোগ ও নির্ভরশীলতাসহ আরও অনেক ভোগবাদী লক্ষণ আমরা আমাদের তরুণদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করছি। 

যৌথ পরিবার ছিল আমাদের ঐতিহ্য। এটি এখন ভাঙনের পথে। ফলশ্রুতিতে বেড়েছে একক পরিবার।  একই সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা অহংবোধের কারণে স্বামী বা স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে এবং একই সাথে  বাড়ছে একক পরিবার বা লিভ টুগেদার সংস্কৃতি। আর ভগ্ন পরিবারের সন্তানেরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত বা কিশোর গ্যাং’র মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে। এমনকি একজন ঐশীর মতো অনেকে হয়তো বাবা ও মাকে নিজস্ব সত্তা থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। এ সবই পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা। প্রকৃতপক্ষে এর আর্থিক এবং মনস্তাত্বিক মূল্য অপ্রিমেয়।  শিক্ষা, পরিবার ও সমাজসংশ্লিষ্ট  বিশৃঙ্খলা থেকে এখন আমরা আরও কতিপয় জাতীয় সমস্যা তথা বিশৃঙ্খলার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। 

রাজধানী শহর ঢাকা’র জলাবদ্ধতা
গত ১৯ জুলাই ২০২৪ তারিখ রোজ শুক্রবার সকালে ঢাকাবাসী এক অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করল ঘুম থেকে উঠার পর যা আগে কখনও ঘটেনি। তাঁরা দেখলো কারো আঙিনাতে পানি, কারো ঘরে পানি, আশেপাশের রাস্তা পানিতে ডুবন্ত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঐ দিন  সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এরপরও  তা ভারী বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু তাতেই  ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, নিউমার্কেট, মতিঝিল, আরামবাগ, কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, দক্ষিণখান, কল্যাণপুর, বিজয় সরণি, মালিবাগ, মৌচাকসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার সড়ক ডুবে যায়।  

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে বিগত ৪ বছরে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ৩৬০ কোটি টাকা (দক্ষিণ) ও ৩৭০ কোটি (উত্তর) খরচ করেছেন। যার সুফল নগরবাসী ১৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে উপভোগ করলো। তাঁরা অবশ্য এজন্যে শহরের ড্রেন, খাল ও নর্দমাগুলোতে নির্বিচারে পলিথিন জাতীয় বর্জ্য ফেলাকে দায়ী করেছেন। প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক এ জন্যে দুই সিটি করপোরেশন এর গৃহীত ব্যবস্থা কী এবং কী কারণে তা কাজ করে নি? পরিবেশ দূষণের জন্যে পলিথিন কে দায়ী করা হলেও এর প্রতিকার চোখে পড়ে না। 

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার এই অবস্থাকে ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে? আর এর কি কোন আর্থিক মূল্য নেই? পলিথিন জাতীয় পদার্থ ফেলে ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই যদি এই জলাবদ্ধতা – তা হলে এর প্রতিকার প্রয়োজন। পলিথিন উৎপাদন তো ইতি পূর্বেকার সরকার বন্ধ করেছিলেন বলে জানি। এই সরকার পলিথিন উৎপাদনের অনুমোদন দেননি তাও জানি। তাহলে বাজারে পলিথিন আসে কিভাবে? আর যত্রতত্র পলিথিন না ফেলার যে শিক্ষা তা সাধারণ মানুষকে দেয়ার দায়িত্ব কার? ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান বুড়িগঙ্গা নদী পরিষ্কার করতে গিয়ে বলেছিলেন, বুড়িগঙ্গার তলদেশে পলিথিনে কয়েক ফুট উচু হয়ে আছে। এটি শুধু ঢাকা নগর কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীর সমস্যা নয় – জাতীয় সমস্যা বৈ কি? 

বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা/মাস ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (এমটিএস) 
নিরাপদ সড়ক যাত্রা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু ঢাকা শহরের রাস্তায় এই অধিকার নিয়ে চলা ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের  নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে।   ঢাকায় ২৯ জুলাই ২০১৮ তারিখে  রাজধানীর বিমান বন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল ও যাত্রীবান্ধব হলে এমন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কিংবা এমন আন্দোলনের প্রয়োজন হতো বলে মনে হয় না। 

বিশৃঙ্খল যানবাহন চলাচলের সবচেয়ে বড় ক্ষতি মনুষ্যজীবনের অতঃপর অর্থনীতির। প্রতি মাসে গড়ে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় কয়েক শত মূল্যবান জীবনের হানি ঘটে (এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট) । ২৫/৩০ বছর বয়সী একজন যুবকের অকাল মৃত্যুর আর্থিক মূল্য কত? অনুরূপভাবে বছরে মৃত ৭৯০২ জন, আহত দ্বিগুণেরও বেশি  মানুষের মৃত্যুর আর্থিক মূল্য অনেক বিলিয়ন ডলার হবে নিশ্চয়ই। ২০২৩ সালে সারা দেশে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসার ৭৯০২ জন, পুলিশের মতে ৪৪৭৫ জন, বিআরটিএ’র মতে ৫০২৪ জন ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর মতে ৬৫২৪ জন মানুষ মারা গেছেন (প্র আ ১৭ জানু ২০২৪)। এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট বাস্তবানুগ গবেষণ পরিচালনা করে এই অযাচিত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নিরূপণ করে প্রতিকারের সুপারিশসহ সরকারের নিকট দাখিল করেছে। তাদের ওয়েবসাইটেও এসকল কারণ দৃশ্যমান। ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহণ বিভাগ, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এবং যানবাহন মালিক ও সংশ্লিষ্ট যান চালকদের। যান চালকগণ স্পিড লিমিট অতিক্রম করে অতি দ্রুত গাড়ি চালান। কোনোভাবেই এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে,  ৮০’র  দশকে যখন প্রতিদিন দ্রুতগতির ট্রাক অযাচিত দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রাণহানীর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন সরকার ট্রাকের গতিরোধের জন্যে ইঞ্জিনে গভর্নর সিল লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এতে ট্রাক দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমেছিল বলে তথ্য বিদ্যমান। যাত্রীবাহী বাসের (বিশেষ করে দূরপাল্লার) স্পিডলিমিট অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হাইওয়েতে তিন চাকার যানবাহন বাস দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট উল্লেখ করেছে। হাই কোর্টের এক রায়ে হাইওয়ে থেকে তিন চাকার যান সরানোর নির্দেশ থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা আমলে নিচ্ছে না। সুতরাং মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা রয়েই গেছে। ঢাকা শহরে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় যখন ২/৩টি বাস রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে তখন এই বিশৃঙ্খলা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া নিরীহ নাগরিকদের আর কীই বা করার থাকে? এই বিশৃঙ্খলা দূরীকরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র প্রচলিত বিজ্ঞানভিত্তিক এমটিএস চালু করা ও এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। 

রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বৃহৎ শহরে এম টি এস চালু প্রসঙ্গে 
একটি দেশের আধুনিকতা ও অগ্রসরতার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে সেই দেশের প্রধান বিমানবন্দর ও তার ব্যবস্থাপনা এবং রাজধানীসহ বৃহৎ শহরগুলোর গণপরিবহন ব্যবস্থা (এমটিএস)। সে হিসেবে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবস্থা যাই হোক – রাজধানী শহর ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থা কোন চলকেই আধুনিক ও অগ্রসর দেশের পরিচয় বহন করে না। উন্নত দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম – দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন রাজধানী শহরের এমটিএস ঢাকা শহরের চেয়ে ঢের ভাল। যারা মিয়ানমার গিয়েছেন – তারা বলেন, ইয়াঙ্গুন’র এমটিএস ঢাকার চেয়ে অনেক উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন। মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা তাদের রাজধানী শহরের এমটিএস উন্নতমানের ও আকর্ষণীয় করতে পারলে আমরা পারি না কেন?  সহজ ও এক কথার উত্তর হল অতিলোভী, দল বাজ বাস মালিকদের অসহযোগিতার কারণে! তাহলে বাংলাদেশের বাস ও মিনিবাস মালিকরা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাশালী? ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির হিসেবে কয়েকটি কোম্পানির অধীনে ঢাকায়  ২৯১ টি রুটে ৫/৬ হাজার বাস-মিনিবাস চলে। এগুলোর অধিকাংশই লক্করঝক্কর ও রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী। যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা শহরে চলাচলকারী এই বাসগুলোকে লক্করঝক্কর মার্কা বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। 

ঢাকা শহরের এমটিএস সংক্রান্ত এক অতিসম্প্রতি বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, "পুরনো বাস ব্যবসায়ীরা এখন আর তেমন নেই। তারা ঝরে গেছেন। নতুন যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের অনেকেই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। ব্যাংক লোন, রুট পারমিট পাওয়াসহ নানা কারণে বাস সেক্টরটাই রাজনীতির মধ্যে চলে গেছে যেটি এ খাতে নৈরাজ্যকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে"।

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘মানুষকে জিম্মি করে ধর্মঘট দিয়ে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টা বাস ও লঞ্চ মালিকদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়, কারণ এসব সমিতিগুলোতে রাজনৈতিক নেতাদেরই আধিপত্য’। তিনি আরও বলেন, "একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ঢাকার বাস চলাচল"। এ চক্র ভাঙ্গতে না পারলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা কঠিন হবে। ঢাকার দুই মেয়র চেষ্টা করছেন কিছুটা। তারা সফল হলে বোঝা যাবে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে কিনা"। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এমটিএস চালুর পদক্ষেপ নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। বাস মালিকদের তিনি অনেকটাই এমটিএস এর পক্ষে আনতে পেরেছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল এমটিএস এর অনুপস্থিতিতে রাজধানী শহরসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে সৃষ্টি হয় অযাচিত ও অভূতপূর্ব যান জট। এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট, এর তথ্যানুসারে বছর কয়েক আগে ঢাকা শহরে যেখানে গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২০ কি.মি. সেখানে বর্তমানে তা ৫ কি.মি. এ নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়,  অসহনীয় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ৭৩টি মোড়ে আটকে যাচ্ছে যানবাহন। এতে করে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি পুরছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। এই হিসেবে শুধু ঢাকা শহরের যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশে। অর্থমূল্যে বছরে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা(প্র আ ৬ মে, ২০২৩)। ছাত্রছাত্রীদের যে মূল্যবান সময় নষ্ট হয় তার আর্থিক মূল্যও অপরিমেয়। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, যানজটে বসে থাকা যাত্রীদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কারণে হৃদরোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এরও আর্থিক মূল্য রয়েছে। সুতরাং উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে হলে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য বৃহৎ শহরগুলোতে এমটিএস চালুর কোন বিকল্প নেই। 

এমটিএস চিত্র
এমটিএস চালু হতে পারে একটি বিধিবদ্ধ কোম্পানির অধীন (হোল্ডিং কোম্পানি)। একাধিক ব্যক্তি এর পরিচালক হতে পারেন। এতে সকারেরও শেয়ার থাকবে। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ বি আর টি সি।  ছোট ছোট বাস মালিকরা কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করবেন।  ছয় রুটে ছয় রঙ -এর এসি ও নন-এসি বাস চলবে সারা শহরজুড়ে। সকল বাসই হবে যাত্রীবান্ধব (বর্তমানে চালু ডাবল ডেকার কিংবা ইতঃপূর্বেকার ভলভো বাসের অনুরূপ, এসি নন-এসি, এক তলা, ডাবল ডেকার)। চালক ও সহকারী কোম্পানি থেকে বেতন গ্রহণ করবেন। বাস নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়াবে – শান্তিপূর্ণভাবে যাত্রীরা উঠানামা করবেন – কোন হুড়োহুড়ি, ডাকাডাকি, প্রতিযোগিতা  থাকবে না। পরিবেশ হবে সম্পূর্ণ শান্ত ও বন্ধুত্বপূর্ণ তথা উন্নয়নশীল দেশের পরিচায়ক। প্রতি স্টপেজে টিকেট কাউন্টার থাকবে। যাত্রীরা ইচ্ছে করলে অগ্রিম কার্ড ক্রয় করতে পারবেন। এখানে একটি কথা বলা দরকার – তা হলো – এমটিএস চালু হলে যাত্রীসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে বেশি বৈ কম হবে না। কেননা বর্তমান বিশৃঙ্খল প্রতিযোগিতাপূর্ণ, হুড়োহুড়িময় পরিবেশে  লক্করজক্কর বাসে অনেক যাত্রীই উঠতে চান না। প্রাইভেট স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, বয়স্ক ও শিশুরাতো না-ই। এমটিএস চালু হলে প্রাইভেট কার, রিকশা স্কুটার এর পরিবর্তে বাসের ব্যবহার বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা আস্তে আস্তে হ্রাস পাবে। শহরে যানবাহনের গতি বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বাস সার্ভিস থেকে এখন বিশৃঙ্খল প্রতিযোগিতার মধ্যে যে আয় হয় এমটিএস চালুর পরে এই আয়, আশা করা যায়, দ্বিগুণ হবে এবং রাজধানী শহরের চেহারাও পাল্টে যাবে। 

বিশৃঙ্খল মোটরসাইকেল- সহজ মৃত্যু
রাস্তায় বিশৃঙ্খলার আর এক নাম মোটর সাইকেল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। আর বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার ৩৯ শতাংশই মোটরসাইকেলের কারণে হয়েছে। এর পেছনে অবৈধভাবে লাইসেন্স পাওয়া, লাইসেন্স ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া চালানো আর ঝূঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালানোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ২ হাজার ৭৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জনের। লক্ষণীয়,  ২০২০ সালের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ২০২১ সালে বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশ। নিহতদের বেশিরভাগের বয়স ৩০ বছরের নিচে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়, এমন ১৬টি দেশের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলছেন, ''মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলতে না দেয়া, সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লাইসেন্স দেয়া, প্রয়োজন যাচাই করে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেয়া- নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এখন তো বরং মোটরসাইকেল সবার জন্য সহজলভ্য করে তোলা হয়েছে। সেখানে পরিবর্তন আনা না গেলে এভাবে বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু, হতাহত হওয়া বন্ধ হবে না'' (প্র আ ৯ মে ২০২২) ।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় উদীয়মান সম্ভাবনাময় তরুণদের অকাল মৃত্যুর আর্থিক মূল্য ও তাদের পরিবারের বেদনার মনস্ত্বাত্ত্বিক ক্ষতির মূল্য কত আমাদের সে সম্পর্কে চিন্তা করা দরকার।

ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি সারা বিশ্বে স্বীকৃত। ১৯৭৩ সালের ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি বর্তমানে (২০২৩) ৪৬০ বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সুশৃংখলভাবে  এগোলে এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারতো। কিন্তু নানা বিশৃঙ্খলার কারণে বাংলাদেশের আর্থিক খাত আজ সমূহ ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত। অর্থমন্ত্রী নিজেই গত মাসে বাজেট বক্তৃতার সময় বলেছেন,  দেশের বর্তমান ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান অস্থিতিশীলতা বা ভঙ্গুরতার লক্ষণগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক রিজার্ভের পতন, রাজস্ব সংগ্রহের স্বল্পতা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের স্থবিরতা, পুঁজি পাচার, ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম-অপচয়, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ খাতের ঋণের সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান দায় এবং সর্বোপরি জবাবদিহিতার অভাব উল্লেখযোগ্য।

ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে - অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা যা দেশের ২০২৪ -২৫ সালের ঘোষিত বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, কোনো একটি দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যের অবস্থা সবল থাকলে মোট ঋণের ২ বা ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে সেটা ৯ শতাংশ। এ ছাড়া দেশের মোট ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রস্তাবও উঠেছে এবং আগামী এক বছরে ১০টি ব্যাংককে একীভূত করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে। এ অবস্থা বিশৃঙ্খলার পরিচায়ক বৈ কি?

এ ছাড়া ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট এখন চরমে। বাংলাদেশ ব্যাংক’র মতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ব্যাংকের তারল্য সংকট মানে হল ব্যাংক খাত ভঙ্গুরতার মধ্যে নিপতিত। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে সংকট, আমানতের ধীরগতি, কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থার অভাব, রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও ঋণ আদায়ে ধীরগতি, ইত্যাদি তারল্য সংকটের প্রধান কারণ।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বর্তমানে দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান সার্বিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে - কমেছে এগুলোর আয়, বেড়েছে ব্যয়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে। মূলধনে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। (সেলিম জাহান, বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে কিছু কথা। বনিকবার্তাঃ ৬ এপ্রিল ২০২৪।

দেশের ব্যাংক ও  আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের   দুর্বল হওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া; সরাসরি জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ লুণ্ঠন; ব্যাংকমালিক হয়ে লুটপাট, অর্থাৎ স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে ব্যাংক উদ্যোক্তা হয়ে জনগণের হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন; ব্যাংকের টাকা লুটে ব্যাংকমালিক এবং পরবর্তী সময়ে আরও লুটপাট; রাজনৈতিক মদদে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি বা পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংকঋণ ও লুটপাট; ব্যাংক লুটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেমন - অনিয়ম–দুর্নীতির প্রশ্রয় প্রদান, লুণ্ঠনের হোতাদের বিচার না করা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা, উদারভাবে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান, বছর বছর জনগণের করের অর্থ লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোতে ঢালা,  ইত্যাদি। ঋণ খেলাপির সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে - ডিসেম্বর ২০২৩ শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণ করা ৩১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, অর্থাৎ খেলাপির ঋণের হার ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এ সময়ে সোনালী ব্যাংকের ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। (এবার সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে বিডিবিএল ও রাকাব, প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল ২০২৪)

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী  গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়ায় ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। কয়েকটি ব্যাংক ব্যাপক অঙ্কের মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলেছে। অনেক ব্যাংকের ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশে নিরাপত্তা তালাশ করছেন। অনেকে পরিবারকেও বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ব্যাংকের দেনা পরিশোধের ধারে কাছেও যাচ্ছেন না অনেকে। এদিকে সুদাসল অনাদায়ী থাকায় সুদের হার কেবল স্ফীতই হচ্ছে। সম্প্রতি এ রকমই এক দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের দুর্নীতির অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব আর্থিক অপরাধ দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে কিভাবে’? (নয়াদিগন্ত ১৭ মে, ২০২৪)।

এ তো গেল কোটা সংস্কার আন্দোলন, শিক্ষা, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা, রাস্তায় যানবাহন চলাচল, মোটর সাইকেলের দৌরাত্ম্য ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার খণ্ডচিত্র। এ ছাড়া অন্যান্য খাত – যেমন, বাজার ও দ্রব্যমূল্য, পরিবেশ ও জলবায়ু, ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাজমান বিভিন্ন সূচকে সম্মানজনক স্থান অর্জন, ইত্যাদি ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনাপ্রসূত বিশৃঙ্খলা আমাদের উন্নয়নকে প্রতিনিয়ত বাঁধাগ্রস্ত করছে এবং দেশ ও জনগণকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।   

উত্তরণের উপায়
ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র এবং সকল রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। শৃঙ্খলার শাব্দিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্যক্তিকে হতে হবে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত, সুশিক্ষিত, আত্মসচেতন, নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রতি তাকে হতে হবে দায়িত্বশীল। এ সকল গুণাবলি অর্জনে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র তাকে সাহায্য করবে যথাযথভাবে গড়ে উঠার জন্যে। এ কাজে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র যত সক্রিয় সেই রাষ্ট্রের মানুষ, সমাজ তত শৃঙ্খল। আমাদের সংবিধান ঘোষণা করেছে,

“… ১৫। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ নিশ্চিত করা যায়ঃ ক. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; খ. কর্মের অধিকার...; গ. যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার, এবং ঘ. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিতকিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধ্যক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিতে আয়ত্বাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার”। 

এই যদি হয় সংবিধান প্রদত্ত আইন তাহলে সমাজে ও দেশে বিশৃঙ্খলা থাকে কিভাবে? নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকার ব্যক্তির অধিকার প্রদানে যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছেন না যার ফলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে এবং এর কুফল জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার যদি সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তির অধিকার প্রদানে সফল হন তাহলে এর সুফল জনগণই ভোগ করে। সংবিধান যে কোন দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং ব্যক্তি, সমাজ ও সরকার এর বিধানাবলি মানতে বাধ্য। গোটা সমাজব্যবস্থা মার্জিত, পরিশীলিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গভীর মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তাই সমাজকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার জন্য প্রথমে দরকার পারিবারিক সুশিক্ষা। একই সাথে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানুষ হিসেবে আমার যা কিছু কর্তব্য আছে সে সম্পর্কে চেতনার বিকাশ ও নিজের শক্তিকে উপলব্ধি করার চেতনা জাগ্রত করা। একই সাথে বিজ্ঞান–মনস্কতা, সংস্কৃতি-মনষ্কতা, ও ইতিহাস সচেতনতার মাধ্যমে একটা যুক্তিবাদী মন তৈরি করা। রাষ্ট্রযন্ত্রেরও উচিত নাগরিকদের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ ও সুশাসনের মাধ্যমে, সম্পদের সুষম বণ্টনে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।

সুতরাং সমাজের এবং রাষ্ট্রের তাবৎ অনিয়ম, অপশাসন, অন্যায়-অপরাধ, বিশৃঙ্খলার মূলোৎপাটন করতে হলে আমাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ আইনের দিকে ফিরে যেতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। 

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd