কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে মাভাবিপ্রবিয়ানদের ভাবনা
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনরায় সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, এতে সংহতি প্রকাশ করছে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিবর্গ। এই বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
তাদের মধ্যে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ইমরান কায়েস বলেন, “আমরা অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীই আছি যারা দিনরাত রিড়িংরুমে ঘাম ঝরাচ্ছি, রিডিং রুমের বাতাস ভারী করছি। যে আমরা এতোটা পরিশ্রম করে মেধার চর্চা করছি সেই আমরাই যদি কোটা নামক বৈষম্যের শিকার হয়ে নিজেদের মেধার জানান দিয়ে চাকুরিতে প্রবেশ করতে না পারি তাহলে দেশ পরিচালিত হবে একটি মেধা শূণ্য জাতির দ্বারা, যা দেশ এবং জাতির জন্য চরম হুমকি। আমরা ছাত্র সমাজ কোনো প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথানত করবো না। আমরা এই বৈষম্য চাই না। আমরা চাই এমন একটি দেশ, যেখানে কোটা নামক কোনো বৈষম্য থাকবে না এবং মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হবে।”
বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, “একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কখনোই সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬% কোটা থাকতে পারেনা, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অসম্মান করে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক, কিন্তু যে চাকরির যুদ্ধ, ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধ,যেগুলো বাংলাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী দিনরাত কঠোরভাবে পরিশ্রম করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, এই ধরনের প্রতিযোগিতায় কোনভাবেই বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিচার বিভাগ স্বাধীন, তাই মহামান্য আদালত বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে রায় প্রদান করতেই পারে, কিন্তু সেই রায় আমাদের ছাত্র অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করায়, আমরা আজ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছি। একই সাথে বলতে চাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নির্বাহী বা শাসন বিভাগ যেটির প্রধান হচ্ছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, তার কাছে আমাদের সকল সাধারণ শিক্ষার্থীর দাবি তিনি যেন এই কোটা ব্যবস্থা বাংলাদেশ থেকে চিরতরে বন্ধ করে দেন। সকল চাকরিতে মেধাবৃত্তিক যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রকৃত মেধাবীকে চাকরি প্রদান করা হোক। একমাত্র প্রতিবন্ধী এবং উপজাতি ব্যতীত কোন প্রকার সুস্থ মানুষের জন্য কোনরকম কোটা চাকরি প্রতিযোগিতায় থাকবে না। আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষাও নির্ভরতার একমাত্র ঠিকানা, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের করজোড়ে অনুরোধ তিনি যেন আমাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে, সকল শিক্ষার্থীকে আবার পড়াশোনায়, সকল প্রকার পরীক্ষায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন”
অর্থনীতি বিভাগের শাইরা মোবাশশিরা রীতি বলেন, “প্রতিবছর দেখা যায়, যেকোনো পাবলিক পরীক্ষায় রেজাল্টের দিক থেকে মেয়েরাই এগিয়ে । তাহলে চাকরির ক্ষেত্রে একটা মেয়ের কোটার কেন প্রয়োজন পড়বে? মেয়েদেরকে আগেই কেন দুর্বল হিসেবে গন্য করা হবে? এই কোটা ব্যবস্থার জন্য অনেকেই চাকরির পড়াশোনায় অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে। মেধা পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে । বরং মুক্তিযোদ্ধা সহ সকল কোটা বাতিল হোক, দেশ পরিচালিত হোক মেধাবীদের হাত ধরে।”
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী বন্ধন দত্ত বলেন, “এই বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়, এই পদ্ধতিতে সংস্কার না আনলে ন্যায়সঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা সম্ভব হবে না। বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া যুবক ও ছাত্ররা তাদের পরিবার ও সমাজের প্রতিনিধি, এই আন্দোলন দেশের প্রত্যেকটি সাধারণ জনগনের আন্দোলন।”
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাতিরাও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে। তাদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেও সমালোচনার শিকার হয়েছেন। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোটা সংস্কারে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থী মো. নাজমুল হাসান ভূঁইয়া বলেন, “আমার দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ১০০ জনের মধ্যে ৫৬ জন কোটা সুবিধা নিচ্ছে এবং ৪৪ জন প্রশ্নপত্র চুরি করে সফল হচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশ উন্নতির মুখ দেখবে না, বরং পিছনের দিকে যেতে বাধ্য হবে। আমি কখনোই আমার ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য দেশের ক্ষতি চাইবো না। তাই, আমি কোটা আন্দোলনের পক্ষেই আছি। মেধাই হোক সর্বোচ্চ কোটা।”
মুক্তিযোদ্ধার নাতি লাইফ সাইন্সের অনুষদের শিক্ষার্থী জীবন আহমেদ (ছন্দনাম) বলেন, কোটা বাতিল না, সংস্কার প্রয়োজন, আমি এটা মনে করি। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে কোটা ৫৬% থাকাটা আমার কাছে অযৌক্তিকই মনে হয়। কিন্তু আপনারা যেই আন্দোলন করতেছেন, ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রাখার জন্য, এইখানে আমার ব্যক্তিগতভাবে দ্বিমত আছে, আপনাদের আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
নাতি/নাতনিদের কেনো কোটা থাকাটা যুক্তিযুক্ত? স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ১৯৭৫-৯৬ এই ২১ বছর কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল না। ২০০১-৯ পর্যন্ত ৮ বছর কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল না। এরপর ১৮ সাল থেকে ২৪ সাল এই ৬ বছর কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল না। এর মানে প্রায় ৩৮ বছর কোটা ব্যবস্থা কার্যকর ছিলনা।
এই সময়ে কত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গিয়েছিলো সেটাও আপনাদের মাথায় রাখা উচিত!! প্রশ্নপত্র ফাঁস, চাকরির বাজারে দুর্নীতি বন্ধ করে, কোটা সংস্কার করে যদি সেটা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, আমার মনে হয় না যে মেধাবীরা বঞ্চিত হবেন। আন্দোলনে এই জায়গাটায় জোর দেওয়া জরুরি বলেও আমি মনে করি।
আর একটা কথা আমি বলতে চাই, আমরা তো আপনাদেরই ভাই, বোন, বন্ধু, সহপাঠী। আমাদের বাবা/দাদা/ নানা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এটা অবশ্যই সম্মানের। এই আন্দোলনে আপনাদের অনেকের বক্তব্য / ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং ট্রল যেটা করেন, ডিরেক্টলি, ইনডিরেক্টলি উনাদের এবং উনাদের পরিবারের (সন্তান, নাতি/নাতনীদের) অপমান করা হয়। এটা কোনোভাবেই ঠিক বলে আমি মনে করি না। আমার নানা একজন মুক্তিযুদ্ধা, এটার পরিচয় দিতেও আমার এখন কেমন যেনো মনে হয়, আমাদের সহপাঠী, ভাই, আপনারা এটা নিয়ে ট্রল করেন। এটা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুবই মর্মাহত করে। আপনাদের আন্দোলন হবে কোটার বিরুদ্ধে,আপিল বিভাগ এর রায় এর বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি করে, প্রতি ক্যাম্পাসে কমিটি করে, পরিকল্পনা মাফিক আন্দোলন করা উচিত। ৯৮% স্টুডেন্টই সাধারণ শিক্ষার্থী, আপনারা চাইলে কি না সম্ভব!!
সর্বশেষে বলতে চাই, কোটা থাকা উচিত, তবে সেটা অবশ্যই ৫৬% না, কোটা সংস্কারের প্রয়োজন, বাতিল না।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী রমজান আলী (ছন্দনাম) বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার একজন নাতি হয়ে বলছে সরকারি প্রতিটা সেক্টরে কোটার আগে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে দেখবেন দেশ এগিয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। মোটকথা কোটা সংস্কারের প্রয়োজন, ক্ষেত্র বিশেষে কোটা প্রয়োজন তবে সেটা খুবই বেশি নয়।”