আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ, আমি মেধাবী হতে চেয়েছিলাম
আমি মারা গেলে এই রাষ্ট্র দায়ী। আমি আসলে ভয়ঙ্করভাবে হতাশ। এক বোন চার ভাই আমরা। সবার ছোট আমি। বাবা-মায়ের সাধ থাকলেও সবাইকে পড়ালেখা করাতে পারেনি অর্থের অভাবে। সবাই দারুণ মেধাবী থাকা স্বত্বেও টাকার কাছে থেকে গিয়েছে অন্য ভাই-বোনদের মেধা।
বাবা ছিলেন খুবই সাদাসিধে। সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন কেবল আমাদের মুখে দুবেলা খাবার যোগানোর জন্য। মাকে দেখেছে কত-শত দিন যে না খেয়ে ছিলেন তা আসলে বলতে গেলে প্রচন্ড রকম কান্না পাচ্ছে এই মূহুর্তে, আমি আসলে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। বন্যার দিনে আমাদের ঘর পানিতে তলিয়ে যেত।
মনে আছে আমার বন্ধুদের পুরনো স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে গিয়েছি। কখনও সৌভাগ্য হয়নি আমার একটা নতুন ড্রেস পড়ার। ছাত্র হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না। টিউশন পড়তে পারিনি টাকার অভাবে। একবার মনে আছে কেউ আমাকে বিনা পয়সায় পড়াতে চায়নি। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। বড় ভাইয়া বলেছিলো, 'মনু এইবার যদি তোর রোল পাঁচের মধ্যে থাকে তাহলে প্রতিদিন সানোর দোকান থেকে একটা করে রুটি খাওয়াবো তোরে।' একটা রুটি খেতে পারবো বিষয়টা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দিনরাত এক করে পড়ালেখা করেছি শুধু একটা রুটির জন্য। সেবার যখন রেজাল্ট দেয় আমার রোল ২৯ থেকে ২ স্থানে চলে যায়।
কোলার( জমি) মধ্যে ছুটে যাই ভাইয়ার কাছে রেজাল্ট নিয়ে। সেইদিন থেকে প্রতিদিন একটা করে রুটি পেতাম। তারপর থেকে আমার স্কুলে টাকা দিয়ে পড়তে হয়নি কোনদিন। যা বুঝতাম না স্যারদের বাড়িতে গিয়ে বুঝে আসতাম। মাধ্যমিকে যখন ক্লাস এইটে পড়ি বাবা বলবো আমি তোমারে আর পড়াতে পারবো না বাবা আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও। আমার আর পড়ালেখা হবেনা বিষয়টা মানতেই পারছিলাম না। অনেক খুঁজে একটা টিউশন ম্যানেজ করলাম। সেই থেকে শুরু হলো নিজের সাথে যুদ্ধ। ইন্টারমিডিয়েটের পরে আমার অন্যসব বন্ধুরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন নেওয়ার জন্য ঢাকায় যাচ্ছিলো আমি তখনও জানতাম না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কোন প্রতিষ্ঠান আছে।
পরে এক বড় ভাই আমায় বললো বিষয়টা। ঢাকায় আমি জীবনেও আসিনি তার আগে, নাই কোন আত্মীয় স্বজন। বাবা তখন আমাদের জমিতে কাজ করে গিয়ে তার পা জড়ায়ে ধরলাম। বললাম বাবা আমারে খালি কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার টাকাটা দাও আর কিছু লাগবে না। অবশেষে বাবা কথা শুনলেন। চাষের জমি বন্ধক দিয়ে টাকা আনলেন আমার জন্য। অথচ তারা জানেনা কি খাবে এরপরে। তবু স্বার্থপরের মতো আমি টাকাটা নিলাম। কিন্তু কোথায় থাকবো কি খাবো জানিনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া এক বড় ভাইয়ের খোঁজ পেলাম যে কিনা জিয়া হলে থাকে। যোগাযোগ করলাম তার সাথে। তার পজেটিভ উত্তর পেয়ে ঢাকায় আসলাম জিয়া হলে। ছোট একটা রুম তাতে অন্তত ২৫-৩০ জন থাকে। আমাকে বললো সেই রুমে থাকতে। সারাদিন জিয়া হলের রিডিংরুমে পড়ালেখা করে যখন ঘুমাতে গেলাম দেখলাম আমার শোয়ার মতো তিল পরিমান জায়গাও ফাকা নাই। পড়ে একটা বেডসিড নিয়ে রুমের বাইরে ওয়াশরুমের পাশে একটা জায়গায় শুইলাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো তখন। এভাবেই দিনের পরে দিন রাতের পরে রাত কাটাতে লাগলাম।
তখন স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার গানটা শুনতাম আর প্রতিদিন রাতে অঝোরে কাঁদতাম যে কোথায় এলাম আমি। কিছুদিন পরে পকেটে যা টাকা ছিলো সব শেষ ঐ ভাইকে কোথাও পাচ্ছিলাম না। একদিন রিডিংরুমে রেইড পড়লো। বহিরাগতরা এখুনি বের হয়ে না গেলে পুলিশে দেয়া হবে। এই কথা শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। অনেক কষ্টে ওই ভাইয়ের সাথে কন্টাক্ট হলো। সে বললো হল প্রশাসন যদি এই কথা বলে থাকে তাহলে কিছু করার নাই তুমি চলে যাও ভাইয়া।কোথায় যাবো কিছুই চিনিনা আমি। দিশা না পেয়ে সবকিছু নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবুজ চত্বর আসলাম। ওখানে একটা ল্যাম্পের নিচে বসে পড়লাম।
ওখানেই পড়ালেখা করে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি। সকাল হয়েছে ফার্মগেট যাবো ক্লাস করতে পকেটে আছে কেবল পাঁচ টাকা। পাঁচ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে ফার্মগেট গেলাম পরীক্ষা দিলাম কোচিংয়ে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আবার ক্যাম্পাসে আসলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে আমাকে বের হয়ে যেতে হলো পড়তে হলে এখানেই পড়বো না হলে আর পড়ালেখাই করবো না। এভাবে তিনদিন চলে গেল। বাসায় কল দেওয়ার ও টাকা ছিলো না। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের ভাইদের অনুরোধ করে বাসায় কল দিতাম। আম্মা আমার ভয়েস শুনেই বুঝতে পারতো আমি খাইনি। আম্মার কান্না সহ্য হতো না। বাবা বলতো ভার্সিটি আমাদের জন্য না বাবা তুই চলে আয়।
তিনদিন আমি কেবল পানি ছাড়া আর কিছুই পাইনি খাওয়ার জন্য। এর মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলাম। আমার এলাকার এক বড় ভাই হঠাৎ আমায় দেখল এফ বি এস এর সামনে। সে আমায় জগন্নাথ হলে নিয়ে গেল। তারপর থেকে তার রুমেই থাকতাম, সে খাবারের বিল দিত। কিন্তু এতো অসুস্থ হলাম যে বাড়ি না গিয়ে উপায় নেই। বাড়ি গিয়েও যখন কিছুটা সুস্থ হলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এপ্লাই শুরু হয়ে গেছে। আমার কাছে কেবল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করার মতোই টাকা আছে। তাই আর কোথায় আবেদন করতে পারলাম না।
সি ইউনিটের পরীক্ষার সময় আমার গায়ে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর আবার। পরীক্ষা দিলাম কিন্তু চান্স পেলাম না। তখন কেবল ডি ইউনিট বাকি। যাতে লজ্জ্বায় ঘর থেকে বের না হতে পারি তাই মাথার চুল ন্যাড়া করে ফেললাম। দিনরাত পড়ালেখা করলাম। অবশেষে চান্স পেলাম। কিন্তু যে সাবজেক্ট পেলাম তা পছন্দ হলো না। তাই অন্য সাবজেক্ট নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো এতগুলো টাকা পাবো কোথায় ভর্তি হওয়ার জন্য। অবশেষে বোনের জন্য রাখা সিজারের টাকা দিয়ে ভর্তি হলাম।
কিন্তু সমস্যা এখানেই থেমে থাকলো না। কয়েক মাস চলতে পারলেও আর টাকা নেই। বাধ্য হয়ে ড্রপ দিতে হলো। বাড়ি গিয়ে টিউশন করে টাকা জমিয়ে রিএড নিলাম। দ্বিতীয় বর্ষের সেমিস্টার ফাইনালের আগের রাতে বাবা মারা গেলেন। বাবাকে শেষবার দেখবো সেই টাকাটাও হাতে নেই। বন্ধু সোহান এসে হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললো তুই যা আমরা পরীক্ষার দিকটা দেখছি। গিয়ে দেখলাম বাবার নিথর দেহটা আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। শেষবারের মতোও আর কথা বলতে পারলাম না আমার বাবার সাথে। বিভাগ থেকে বললো ২ দিন পরে পরীক্ষা হবে।
আমি বাবাকে কবরে রেখে পরদিন ঢাকা আসলাম। পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট আসলো ৩.৮৬। বাবা নেই আজ চার বছর। আল্লাহর অশেষ রহমতে অনার্স শেষ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি মাস্টার্স পরে করবো আগে চাকরীর জন্য পড়া শুরু করি। একদিকে রিএড,আবার করোনায় জীবনটা তছনছ করে দিছে তাই চাকরীর পড়া শুরু করলাম। মা আজ অসুস্থ। ভাইদের নিজেদের সংসার চালাতেই হিমশিম অবস্থা। বোনটা বিভিন্ন রোগে ধুঁকছে।
আমি কারো জন্য কিছুই করতে পারছি না। এতো কষ্ট করে না খেয়ে চাকরীর পরীক্ষার এপ্লাইয়ের জন্য টাকা দিয়ে আজ যদি কোটা নামক এমন বৈষম্য আর প্রশ্ন ফাঁসের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় রাস্তায় জীবন কাটাতে হয় তবে আমি এই জীবন আর চাইনা। আমি চাইনা এই দেশে কোন মেধাবী শিক্ষার্থী থাকুক। এই দেশ আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। এখানে কেবল বৈষম্য, অরাজকতাকারী, দুর্নীতিবাজদের অধিকার। এদেশে কৃষক, শ্রমিকদের ছেলে মেয়েদের কোন অধিকার নেই। আমায় যদি কেউ প্রশ্ন করে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ কি আমি বলবো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ আমি মেধাবী হতে চেয়েছিলাম আর বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিলাম। আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই আমি যদি মারা যাই তাহলে আমার মৃত্যুর জন্য এই রাষ্ট্র দায়ী।
ফেসবুক থেকে নেয়া