গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা যেভাবে শিক্ষার্থীবান্ধব
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। এছাড়া ১টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ১টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেগুলিতেও একই পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। সেসময় শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণের পর এই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন একটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করতো।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টির বেশি। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটির ক, খ ও গ ইউনিটে পৃথক ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণে মোট ১৫০ দিন লাগবে। এখানে আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হলো ভর্তি পরীক্ষাগুলো ছুটির দিনে অনুষ্ঠিত হওয়া। সেক্ষেত্রে আমাদের ভর্তি পরীক্ষার জন্য দরকার ১৫০টি ছুটির দিন।
বছরে ৫২টি সপ্তাহ থাকলে দুইটি ছুটির দিন বিবেচনায় পরীক্ষা নিতে মোট দেড় বছর সময় লাগবে। এর ব্যত্যয় ঘটাতে হলে একই ছুটির দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। যা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। কারণ ন্যূনতম যোগ্যতা থাকলে একজন শিক্ষার্থীর প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত।
পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা দিতে হয়, তাহলে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ফি জমা দিতে হবে। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন ফি এক হাজার টাকা নির্ধারিত হলে পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে একজন শিক্ষার্থীকে গুণতে হবে পঞ্চাশ হাজার টাকা। গরীব বা নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীর জন্য যা একেবারেই অসম্ভব।
সম্প্রতি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিসিএস কর্মকর্তাদের ৭৫তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে বিসিএস উত্তীর্ণ জনৈক কর্মকর্তার ব্যক্ত অনুভূতি থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট। বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল প্রকৌশলী হওয়ার, কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব কিনা সেই আশঙ্কা ছিল। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নটা প্রায় শেষই হতে যাচ্ছিল, যদি না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ার সুযোগ পেতাম। কেননা অর্থের অভাবে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও আমি ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলতে পারিনি।’
দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আছে যাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে পারলে জাতি, দেশ তথা পৃথিবী উপকৃত হবে। গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা একটি শিক্ষার্থীবান্ধব প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একটি মাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন একটিতে ভর্তির সুযোগ পেতে পারে। এক্ষেত্রে পরীক্ষা দিতে এসে তাদের যাতায়াত, থাকা ও খাওয়া বাবদ গড়ে তিন হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ে না। জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি হবে আমাদের একবিংশ শতাব্দীর চালিকাশক্তি। একে উজ্জীবিত করতে গেলে আমাদের দরকার উচ্চশিক্ষার সুযোগকে সহজতর করা।
জিএসটি গুচ্ছ পরীক্ষার সাথে আমি তিন বছর যুক্ত আছি। নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখতে পেয়েছি যে গুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের আঞ্চলিক আধিক্যের পরিবর্তে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষম বন্টন হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মেধার চর্চার ক্ষেত্রে সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা স্বয়ংক্রিয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এখানে কোনরূপ ভর্তি জালিয়াতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না। তাছাড়া প্রভাব খাটিয়ে অমেধাবী কাউকে ভর্তি করার সুযোগ নেই এই পদ্ধতিতে।
তবে গুচ্ছের একটি অসুবিধা আমাদের চোখে পড়ছে। সেটি হল অনেক বিভাগে আসন ফাঁকা রেখেই ক্লাস শুরু করতে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন বিভাগগুলোতে আসন সংখ্যা পূর্ণ হচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। যেকোন বিষয়েই ঠিকমতো পড়াশোনা করলে মাস্টার্স বা পিএইচডির মতো গবেষণা অন্য যেকোন বিষয়েই করা সম্ভব।
এ বিষয়ে আমি নোবেল বিজয়ী একজন ফরাসী অধ্যাপকের কথা বলছি। নাম তাঁর অধ্যাপক ড. জ্যঁ তিরল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সমাবর্তন বক্তা হিসেবে। তাঁর ব্যাচেলর ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। কিন্তু তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী করেছেন অর্থনীতিতে। পরবর্তীতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন অর্থনীতিতে। ইচ্ছা থাকলে ব্যাচেলর ডিগ্রী এক বিষয়ে হলেও মানুষ অন্য বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষার্থী ভূগোল বিষয়ে পড়াশোনা করে পরবর্তী সময়ে নাসাতে গবেষণার সুযোগ পেয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্যাচেলর পর্যায়ে সাবজেক্ট মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হল পড়াশোনার একাগ্রতা। এই ধরণের মানসিক প্রস্তুতি শিক্ষার্থীদের মন ও মননে বপন করা জরুরি। নিজের পঠিত বিষয়ের শিক্ষাকে জীবিকায় রূপান্তরের আরো একটি উদাহরণ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার পূর্ব পরিচিত একজন আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী হয়েছিলেন। মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আবার দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি দেশে অবস্থান করেই অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত প্রবাসীদের সন্তানদেরকে জুমের মাধ্যমে আরবী শেখাতেন। এতে তার আয় ছিল উল্লেখ করার মত।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং গুচ্ছ, কৃষি গুচ্ছ, জিএসটি গুচ্ছ ও মেডিকেল গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমার মতে, সকল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষাকে একীভূত করার জন্য টেকসই সমাধান হতে পারে জাতীয় ভর্তি পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ বা ন্যাশনাল টেস্টিং অথারিটি। এনটিএ একটি পরীক্ষার পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক আলাদা আলাদা পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে।
যেমন: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, গণিত, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান প্রভৃতি। শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্য ও পছন্দ অনুযায়ী বিষয়সমূহের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে। প্রশ্ন পদ্ধতি এমন হবে, যাতে মেডিক্যাল, প্রকৌশল, সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের শর্ত ও প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পায়। ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ শিক্ষার্থীদের ডাটাবেজ অনলাইনে সংরক্ষণ করবে এনটিএ সার্ভার এবং শিক্ষার্থীদেরকে নম্বরপত্রের সনদ দেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের নিজ নিজ শর্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ভর্তির জন্য আবেদন আহ্বান করবে। এনটিএ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষাসমূহ এইচএসসি পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করবে। এতে ভর্তি কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে। এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। ফলে সেশনজট কমে আসবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রক্রিয়াটি শুরু করা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী শিক্ষার্থীবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু কি তাই! উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে পিছিয়ে পড়বে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।