একশ’ চার বছরে বাঙালির জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাতিঘর
পৃথিবীর নানা দেশ জ্ঞানের বিকাশ, গবেষণার আবশ্যকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন আর ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদে এবং সময়ের চাহিদা পরিপূরণ ও সমৃদ্ধ জাতি-গঠনের মানসে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন করেছে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার সংগ্রামী ইতিহাস আর ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার দিয়ে কোনো জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছে- বিশ্ব-ইতিহাসে তা বিরল। এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য মহিমা; যে তার ঐতিহাসিক সংগ্রামী বৈশিষ্ট্য দিয়ে বাঙালি জাতির ভাষার অধিকারসহ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশ-এর গোড়াপত্তনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। বাঙালির প্রাণের সেই বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠার একশ’ চার বছর উদ্যাপনের এক শুভলগ্ন অতিক্রম করছে। ১৯২১ থেকে ২০২৪; এই একশ’ চার বছরে পদার্পণকারী বিশ্ববিদ্যালয়টি বাঙালি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গবেষণা-উদ্ভাবন, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, প্রগতিশীল ভাবনা, জাতি-গঠন ও দেশাত্মবোধক চেতনার এক তেজোদীপ্ত আলোকবর্তিকা; বাঙালির সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার শতবর্ষী এক অনন্য বাতিঘর।
আজ ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এ বছর ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উচ্চশিক্ষা’ এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আরো অধিকতর মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠ ইতোমধ্যেই তার প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল শতবর্ষ অতিক্রম ও উদ্যাপন করে এসেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অর্গানাইজিং কমিটি’ কর্তৃক আয়োজিত ‘সেলিব্রেটিং দ্যা হান্ড্রেড ইর্য়াস অফ দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা: রিফ্লেক্শন্স ফ্রম দ্যা অ্যালামনাই-ইন্টারন্যাশনাল এন্ড ন্যাশনাল’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে শতবর্ষ উপলক্ষ্যে গৃহীত ছয়টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন গর্বিত শিক্ষার্থী, জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা সূচিত হয়েছিল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশের সর্বপ্রাচীন এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ উদ্যাপনকে আরো অর্থবহ ও কার্যকর করে তুলতে বেশকিছু ইতিবাচক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এসব গৃহীত কর্মসূচির আওতায় দৃষ্টি-নন্দন মল চত্বরে ল্যাণ্ডস্কেপিংসহ ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে একটি ‘সেন্টেনারি মনুমেন্ট’ নির্মাণের কাজ সমাপ্তির পথে রয়েছে। শতবর্ষ পূর্তিকে আরো স্মরণীয় করে তোলার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল নানা বিষয়ে গবেষণা মেলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও প্রত্যাশা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার রচনা প্রতিযোগিতা ও শীর্ষ ১০০ জনকে পুরস্কৃত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাইদের স্বরচিত কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করা, মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ, মৌলিক গ্রন্থাবলি রচনা ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পত্রিকাসমূহের আধুনিকায়ন ও শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, অত্যাবশ্যকীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংযোজনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারসমূহকে মানসম্মত করা, শতবর্ষের উপর বিশেষ স্যুভেনির প্রকাশ, প্রামাণ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকশপে স্যুভেনির কর্নার স্থাপন, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা, পৃথিবীর বিভিন্ন মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গবেষণা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম বৃদ্ধিকরণ, শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন ও সেরাদের পুরস্কৃতকরণ এবং সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনও শতবর্ষ উদ্যাপনের কার্যসূচিতে ছিল। এছাড়া বাঙালির ইতিহাস নির্মাণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং জাতি-গঠনের পরতে পরতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনস্বীকার্য অবদানকে কেন্দ্র করে বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক গ্রন্থ রচনাসহ বছরব্যাপী পালনের জন্য বিস্তর কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার আলোকে গবেষণা ও প্রকাশনার বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে। এসবের মধ্যে শতবর্ষ গ্রন্থ প্রকাশ প্রকল্প, গবেষণা প্রকল্প ও জার্নালের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তাবাবলি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে পরবর্তী অধিকাংশ কার্যক্রমই সম্পন্ন হয়ে গেছে; ইতঃপূর্বে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে এতো সংখ্যক শিক্ষক-গবেষক আর কখনোই জ্ঞান-গবেষণা কর্মকাণ্ডে এভাবে সমন্বিত রূপে নিয়োজিত থাকেননি।
এ বছর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে সকাল ৯:৪৫ মিনিটে উপাচার্য ভবনের সম্মুখস্থ স্মৃতি চিরন্তন চত্বর থেকে টিএসসি অভিমুখে শোভাযাত্রা, সেখানকার পায়রা চত্বরে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ও হলসমূহের পতাকা উত্তোলন, পায়রা, বেলুন ফেস্টুন উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে জাতীয় সংগীত, বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম সং ও অন্য একটি সংগীত পরিবেশিত হবে। অতঃপর টিএসসি মিলনায়তনে উপাচার্যের সভাপতিত্বে ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উচ্চশিক্ষা’ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এম.পি; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখবেন। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষ্যে উপাচার্য প্রদত্ত এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলা হয়- ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি এবং একটি জ্ঞাননির্ভর সচেতন সমাজ বিনির্মাণে অবদান রেখেছে। একইসাথে এ দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকাশ এবং মানবসম্পদ তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেদিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। তবে সে সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে বর্তমান শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও মোকাবেলা করার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন আঙ্গিকে রূপান্তর করতে হবে। র্যাঙ্কিং নামক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দৌড় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর হাতছানি থেকে আমরা নিজেদেরকে সরিয়ে রাখতে পারব না। কাজেই বর্তমান বাস্তবতা আর আগামীদিনের ভিশন পরিকল্পনার নিরিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান যুগের ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে হবে। বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশে উন্নীতকরণের জন্য বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহীত ‘রূপকল্প ২০৪১’ এবং ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ বাস্তবায়নেও প্রয়োজন হবে ‘স্মার্ট সিটিজেন’। এ সকল বাস্তবতাকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সকলের প্রত্যাশিত বিশ্বমানে উন্নীত হবে বলে আশা রাখি। কাজেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সদাশয় সরকার, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিল্প-কলকারখানার স্বত্বাধিকারী এবং সমাজের সামর্থ্যবান সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’ উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন তারিখে সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত উপাচার্যের অভিভাষণেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লম্বধর্মী রূপান্তরের (Vertical Transformation) জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বিবরণী তুলে ধরেছেন।
১৯২১ সালের ১ জুলাই ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক আর ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিল। রজতজয়ন্তী (২৫ বছর, Silver Jubilee), সুবর্ণ জয়ন্তী (৫০ বছর, Golden Jubilee), হীরক জয়ন্তী (৬০ বছর, Diamond Jubilee), প্লাটিনাম জয়ন্তী (৭৫ বছর ,Platinum Jubilee) শেষে এ বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই অতিক্রম করেছে তার গৌরবোজ্জ্বল শতবর্ষ জয়ন্তীর (Centenary jubilee) আনন্দঘন উদ্যাপন। এক শতাব্দীকালেরও অধিক সময়ের সাক্ষী আর ইতিহাসের তিন অধ্যায়ের (বৃটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ) পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার এক অনন্য রূপ পরিগ্রহ করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ছোট্ট জ্ঞানবৃক্ষটি স্বল্প পরিসরে তার যাত্রা শুরু করলেও কালের পরিক্রমায় আজ তা অভিজ্ঞতা, স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও খ্যাতির মানদণ্ডে বিশাল এক মহিরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ২০১৮ জন শিক্ষক (পুরুষ ১৩০৬, নারী ৭১২), ১১৩০ জন কর্মকর্তা, ১৩৮৯ জন তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী, ১৯৫৫ জন চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী এবং ৪০৮৩৭ জন শিক্ষার্থীর (ছাত্র ২৩৩৯৪, ছাত্রী ১৭৪৪৩) পদচারণায় মুখর; রয়েছে ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৬০টি গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র, ১৯টি আবাসিক হল ও ৪টি ছাত্রাবাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর পরিবার। অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ১৯৭টি; বিগত বছরগুলোতে দেশের বিখ্যাত সাতটি সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৮৫০৪২ জনে (ছাত্র ৮১২৩৪, ছাত্রী ১০৩৮০৮) এবং এসব প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট শিক্ষক সংখ্যা ১১৭২৬ (পুরুষ ৫৪৭৪, নারী ৬২৫২)। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ২৭৫.০৮৩ একর আর পূর্বাচলে রয়েছে আরো ৫১.৯৯ একর। দাতাদের অনুদানে বিভিন্ন সময়ে গঠিত ট্রাস্ট ফান্ডের সংখ্যা ৩৮৬। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২১৩০ জন গবেষক পিএইচ.ডি/ডিবিএ এবং ১৮৮৯ জন গবেষক এম ফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। উপরিউক্ত তথ্য-উপাত্তের আলোকে বলা যায়, এ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অন্যতম বৃহত্তম শিক্ষায়তন হিসেবে পরিগণিত। বাস্তবিক অর্থে এ বিশ্ববিদ্যালয় আজ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য বিনির্মাণ ও ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অভিযাত্রার সক্রিয় ও গর্বিত অংশীদার। শুধু পরিসংখ্যান আর কলেবরেই নয়, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক মানদণ্ডে এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ স্বীকৃত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন শিক্ষা, গবেষণাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানের মানকে আরো সমৃদ্ধ করার ব্রত নিয়ে নানামুখী সময়োপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন। এসবের সুফলও আমরা লাভ করতে শুরু করেছি; সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে আমরা এর প্রতিফলনও লক্ষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের শিক্ষা ও গবেষণাসহ সামগ্রিক কার্যক্রমের চলমান গতিধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার প্রত্যাশিত অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে- এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
মূলত, শতবর্ষ অতিক্রমকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে শত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও বৈশ্বিক সকল সূচকে প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটাতে প্রয়োজন একটি সুচিন্তিত, সুদূরপ্রসারী ও সামগ্রিক মহাকর্মপরিকল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে একটি সময়োপযোগী ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করেছেন। এবার প্রয়োজন সরকারের আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করে প্রণীত এই ‘মাস্টার প্ল্যান’-এর সফল ও কার্যকর বাস্তবায়ন; তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ফ্লোর স্পেস ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭০০ বর্গফুট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ বর্গফুট হবে। এছাড়া, আধুনিক গবেষণাগারের অভাব, লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা, জলাবদ্ধতার সমস্যা, যথাযথ ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেনের অভাব, যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, মানসম্পন্ন খেলার মাঠের স্বল্পতা (বিশেষ করে ছাত্রীদের কোনো নির্দিষ্ট খেলার মাঠ নেই) এবং ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন সংকটসহ বিদ্যমান বহুমাত্রিক সমস্যার বাস্তব সমাধান মিলবে। একইসাথে লাইব্রেরির সুবিধা বৃদ্ধি, সুইমিংপুল নির্মাণ, বৃষ্টির পানি ধারণ, সৌরশক্তি উৎপাদন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, গাড়ি পার্কিং সুবিধা, সৌন্দর্যবর্ধনসহ সবুজ চত্বর ও উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধি পাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মাতৃসম এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। মায়ের অসম্মান ও অমর্যাদা যেমন কেউ চায় না, বরদাশত করতে পারে না; ঠিক তেমনি আমরাও এ প্রিয় বিদ্যাপীঠের কোনো রূপ অবমাননা সহ্য করতে পারি না। বিগত সময়ে নানা মহল থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণা আমাদের নেহায়েত কষ্ট দেয়; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রলের শিকার হওয়া যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী একে আর বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করছেন না। তবে আমাদের উচিত, দেশের সর্ববৃহৎ, সর্বপ্রাচীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠের নাম-যশ-খ্যাতির সাথে সুবিচার করে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের উপযোগী কর্মপন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা যে, এটি কেবলই একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; বরং জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও মানসম্পন্ন গবেষণার সূতিকাগার হিসেবে এটি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বমানে উত্তীর্ণ এক অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়। আর এমনটি নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল আমরা দায়মুক্ত হতে পারি।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ- এতদাঞ্চলে এই তিন কালের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিগত এক শতাব্দীকালেরও অধিক সময় ধরে এদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গবেষণার বাতিঘর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ জাতি-গঠন ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দক্ষ ও উপযুক্ত মানবসম্পদও সৃষ্টি করে চলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গেরও স্মৃতিধন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শুভাগমন উপলক্ষ্যে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের নিমিত্তে রচিত ও অপঠিত মানপত্রে রয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি বা ইনস্টিটিউশন অবিনশ্বর নয়। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে, এই বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। আমাদের মতে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে, এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা কীভাবে গড় উঠবে তা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বহুলাংশে নির্ণীত হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। তাই এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতি আপনার, আপনার সরকারের ও বাংলাদেশের জনগণের সুদৃষ্টি ও সহানুভূতি আমরা আশা করি।’ দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবতা বিচারেও উপরিউক্ত বক্তব্য সমভাবে প্রযোজ্য; এমনকি যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ও ঈর্ষণীয় ভূমিকাও ততদিন পর্যন্ত দেদীপ্যমান ও অক্ষয় থাকবে।
এদেশের মানুষের সকল মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ এক যুগ পূর্বে ওয়ান ইলেভেন-এর ভয়াল দুঃসময়ে অন্ধকারের অগণতান্ত্রিক শক্তি যখন জগদ্দল পাথরের ন্যায় গোটা জাতির উপর চেপে বসেছিল, এ অবস্থার উত্তরণে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই গর্জে উঠেছিল; পালন করেছিল তার ঐতিহাসিক ভূমিকা। কারারুদ্ধ জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি, অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে অহিংস অথচ প্রবল গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল চত্বর থেকেই; ক্রমান্বয়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গণ-বিষ্ফোরণের রূপ পরিগ্রহ করে। শিক্ষকদের গ্রেফতার ও নির্যাতন, শিক্ষক সমিতির তলবি সভা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত মিছিল ও স্লোগান, কারাগারে বন্দি দেশরত্ন শেখ হাসিনার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে স্বল্প সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের স্বাক্ষর সম্বলিত ও গণমাধ্যমে প্রেরিত এবং প্রকাশিত প্রথম বিবৃতি, কলাভবনের শীর্ষ চূড়ায় প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিক্ষোভ প্রকাশের প্রতীক হিসেবে কালো পতাকা উত্তোলন- এসবই হয়েছিল বিপদাপন্ন দেশ, দুঃশাসন কবলিত জাতি, সংকটাপন্ন গণতন্ত্র ও বিপন্ন মানবতাকে সুরক্ষার মহান তাগিদে এবং সর্বোপরি দেশের গণমানুষের বৃহত্তর স্বার্থে; সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে দুঃসাহসী আন্দোলনে জীবন-মাল বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু অসম সাহসী মানুষ।
তাই দেশ ও জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম ও অনস্বীকার্য; একশ’ চার বছরে পদার্পণের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সরকার ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ দেশ ও জাতির পরম গর্বের এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সে আলোকেই মূল্যায়ন করবেন- এ আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
লেখক: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়