অন্যরা কোটি টাকার গাড়িতে অফিসে যায়, শিক্ষা ক্যাডারে ছাত্র-ছাত্রীরা কেন আসবে?
গতকাল গিয়েছিলাম কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে। অনেক আদর, আপ্যায়ন আর ভালোবাসা পেয়েছি। পুরো হলরুম শিক্ষক আর শিক্ষার্থী দিয়ে কানায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। লেকচারের সময় কখনো কখনো ছাত্রীদের প্রশ্ন করেছি এবং একদম সঠিক উত্তর পেয়েছি। সব কিছু ছাপিয়ে কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক লিয়াকত আলী লিকু যখন কলেজটি একটু ঘুরিয়ে দেখাতে গিয়ে যখন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গেলাম, মনটা একদম কেঁদে উঠলো। কি জরাজীর্ন রুম।
ছোট দুটো রুম হলো শ্রেণিকক্ষ, ছোট আরেকটি রুম হলো ল্যাব। আর অন্য আরেকটি রুমে চার-পাঁচ জন শিক্ষক বসেন। এরাও বিসিএস ক্যাডার আর বিসিএস প্রশাসনও বিসিএস ক্যাডার। আমার ছাত্র এখন মাত্র সহকারী অধ্যাপক। তার সহপাঠীরা যারা বিসিএস অন্য ক্যাডারে যোগ দিয়েছে, কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে অফিসে যায়, সরকারি বাগানবাড়িতে হয়তো থাকে, তেল খরচ ও ড্রাইভার পায়, ডেকোরেটেড অফিস পায়। শিক্ষা ক্যাডারে ছাত্র-ছাত্রীরা কেন আসবে?
এ মহিলা কলেজটি কুমিল্লা জেলা শহরে। কুমিল্লা একটি বিখ্যাত জেলা। এখানকার অনেক মন্ত্রী আমলা আছে। এ কাজে এইচএসসি, ডিগ্রি পাস, অনার্স এবং মাস্টার্স আছে। আর সবকিছুর জন্য মাত্র দুই/তিনটা রুম। আর সেই তিনটা রুম দেখতে যেন দুর্ভিক্ষে মানুষ যেমন কংকালসার হয়, তেমনি এই তিনটি রুমের অবস্থা। সেখানে হোয়াইট বোর্ডের অবস্থাও খুব খারাপ। চেয়ার টেবিলের অবস্থা আরও খারাপ। পুরো ভবনটি ডেম্প, আস্তর খুলে খুলে পড়ছে।
এ তিন রুমের একটি বিভাগ যেখানে মাত্র চার পাঁচজন শিক্ষক আছে। সেখানে কীভাবে এইচএসসি, ডিগ্রী পাস, অনার্স এবং মাস্টার্স পড়ানো সম্ভব? বড়জোর শুধুমাত্র এইচএসসি থাকা সম্ভব। তার জন্যও শ্রেণীকক্ষগুলো আর সুন্দর করা উচিত। এ রুমে ছাত্রীরা কিছুক্ষণ বসে থাকবে কীভাবে? আবার সেখানে বসে লেখাপড়া?
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন শ্রেণিক্ষক দিয়ে প্রশাসনের লোকজন এসির মধ্যে বিলাসবহুল অফিসে বসতে লজ্জা লাগে না? কুমিল্লায় এত এত ক্ষমতাবান এমপি মন্ত্রী আছেন, তাদের লজ্জা লাগে না? একজন ইচ্ছে করলেইতো সব বদলে দিতে পারতেন। কিন্তু শিক্ষায় কারো কোন দরদ নাই। তাহলে এই দেশে দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ তৈরী হবে নাতো কোন দেশে হবে?
দেশে যুগ্ম সচিবের পদ আছে ৫০২টি। কিন্তু যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত আছেন ৯০০ জনের বেশি। সচিব, উপসচিবসহ অন্য সব পদের চিত্র একই। শুধু পদ না। সুবিধার দিকেও এরা চরম এগিয়ে। তারা কোটি টাকার এসইউভি ছাড়া অফিসে যেতে পারেন না। দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকটকালেও কোটি টাকার গাড়ি কেনার প্রকল্প পাস হয়েছে মাত্র কদিন আগে।
আর কলেজে যেখানে এইচএসসি, ডিগ্রি পাস, অনার্স এবং মাস্টার্স পড়ানো হয়, সেখানে শিক্ষক থাকার কথা ন্যূনতম ২৫ জন, আছে চার-পাঁচ জন শিক্ষক। যেখানে ন্যূনতম ১০টি স্টেট অফ আর্ট ক্লাস রুম থাকার কথা, আছে দু’টি জরাজীর্ণ শ্রেণীকক্ষ। এ দেশ যারা চালায় তাদের লজ্জা হয় না?
আরো পড়ুন: বিসিএস ক্যাডার ছেড়ে পুলিশের এসআই হলেও আশ্চর্য হবো না
পাশেই আরেকটি নতুন ১০ তলা ভবন হচ্ছে। সেটির কাজ নাকি ২০১৭ সালে শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় তলা তুলে এখন কাজ প্রায় বন্ধ। শুনলাম ঠিকাদাররা খুব ক্ষমতাবান। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে যে দামে কাজ পেয়েছিল, সে দামে এখন কাজ করবে না। এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে এইসব তারা তোয়াক্কা করে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণে আরো বেশি করে টাকা মারার ধান্দায় থাকে সংশ্লিষ্টরা।
শুনলাম এ কলেজের অবস্থাতো বাংলাদেশের শত শত কলেজের চেয়ে ভালো। এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সংখ্যা অনেক। আসলে শিক্ষা আমাদের কোন সরকারের প্রায়োরিটির মধ্যে ছিল না এবং এখনো নেই। ভালো করার ইচ্ছে নাই বলেই প্রতি বছর শিক্ষায় বরাদ্দ আগের বছরের চেয়ে কমায়।
এবার জিডিপির মাত্র ১.৬৯ শতাংশ! অথচ ইউনেস্কো শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ দিতে বলে। কোরিয়া, ইসরাইল, জাপান জিডিপির ৫.৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। এমনকি ভিয়েতনামও জিডিপির ৪.৫ শতাংশ দিয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। বেশি বরাদ্দের ফলও তারা পাচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)