২০ জুন ২০২৪, ১৫:৫১

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা: সমস্যা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

লেখক এম এ মতিন  © টিডিসি ফটো

ভূমিকা
বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের বয়স অর্ধ শত বছরের কিছু বেশি। মহাকালের তুলনায় এই সময় খুব বেশি না হলেও এই বয়সেই মরণশীল জগতে অনেক মানব মানবীর জীবনের ইতি ঘটে। বিশ্বময় সুকীর্তির ছাপ রেখে এই বয়সে বিদায় হয়েছিলেন যীশু খ্রীষ্ট (২৭), স্বামী বিবেকানন্দ (৩৯), আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৩) , জন এফ কেনেডি (৪৬), মার্টিন লুথার কিং (৩৯), ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ার (৫২), বাংলার কবি  জীবনানন্দ দাস(৫৫), এমন আরও অনেকে। ব্যক্তির কথা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কথা বিবেচনা করলেও ভিন্ন চিত্র লক্ষ্যনীয়। উদাহরণস্বরূপ ভিয়তনামের কথা অনেকেই উল্লেখ করেন। দীর্ঘ যুদ্ধকলহের পর ১৯৭৬ সাল থেকে মূলত শান্ত হওয়া সংযুক্ত ভিয়েতনাম বিভিন্ন সূচকে এখন দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।  সুতরাং সময়কে দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারলে অর্ধশত  বছর সময়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। আর্থ-সামাজিক খাতে এই সময়ে বাংলাদেশের অর্জন অসামান্য না হলেও প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্বের অনেক মোড়ল সংস্থার এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির। বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, ইউনিসেফসহ আর্থ-সামাজিক খাতে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রশংসার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। প্রতিবেশী দক্ষিণ এশীয় দেশের  অনেক নেতাদের মুখেও বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা বলতে শোনা যায়। আর জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের গ্রস ন্যাশনাল ইনডেক্স (জি এন আই), হিউম্যান এসেটস ইনডেক্স (এইহচ এ আই) এবং একোনমিক ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স (ই ভি আই) শীর্ষক চলকসমূহ  বিবেচনা করে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সনদ দেয়ার কথা ইতোমধ্যে ঘোষনা করেছে (আসাদুল্লাহ, ২০২০)। চলকসমূহ যথানিয়মে অগ্রসর হলে ২০২৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নশীল দেশ  হিসাবে গণ্য হবে। জাতি আশা করছে, ২০৩১ সালের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’  এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত দেশে’র কাতারে বাংলাদেশ শামিল হবে।  ইতোমধ্যে বাংলাদেশে  মাথাপিছু আয় বেড়েছে কয়েকশ গুণ, জীবনায়ূ এবং জীবন মান বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমানে। শিক্ষার হার বেড়েছে বহুলাংশে।  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে তদনুরূপ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর এখানে  উচ্চ শিক্ষার জন্যে কেবলমাত্র ৪ টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী) ও ১টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন সেখানে ৬১টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও ১১৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে। ১৯৭১ সালে ৭.৫০ কোটি জনসংখ্যার স্থলে এখন হয়েছে ১৬.৫০ কোটি। পরিসংখ্যানগতভাবে জনসংখ্যা দ্বিগুণের চেয়ে সামান্য কিছু বেশী হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সে অনুপাতে বেড়েছে অনেকগুণ বেশী। এই বৃদ্ধিকে অবশ্যই সফলতা বলতে হবে।      

আর্থ-সামাজিক খাতে উন্নয়ন
বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) [২০০০ – ২০১৫] বাস্তবায়নকালে  মানব উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতির এক সফল উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত।  স্বাধীনতা পরবর্তী তিন দশকে পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বিবিধ সামাজিক সূচকে (যেমন : মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, জনসংখ্যার উর্বরতা হ্রাস, শিশু টিকাদান কর্মসূচি, নারীর গর্ভনিরোধক ব্যবহার এবং জন্মদান ক্ষেত্রে ছেলে সন্তান প্রীতি হ্রাস) বাংলাদেশের অর্জন ব্যতিক্রমী। এর সবটুকুই অর্জিত হয় সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বেই। আর সাম্প্রতিক উন্নয়নের কথা বলতে গেলে মাথাপিছু আয় (২৬৪৬ মার্কিন ডলার), স্বাক্ষরতা (৭৪.২৩%), বেকারত্ব হ্রাষ (৪.৬%), জি ডি পি প্রবৃদ্ধি (৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), সেই সাথে জি ডি পি প্রবৃদ্ধির হার ৭.২%, দারিদ্র নিরসন ১১.৩%, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে ৬০ লাখ জনসংখ্যার নিকট ৪২০৫ কোটি টাকা বিতরণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ২১.২ মিলিয়ন ছাত্র-ছাত্রীর নিকট বিনামূল্যে ৯৩.৮ মিলিয়ন বই বিতরণ, ইত্যাদির পরিসংখ্যান উল্লেখ করতেই হয়। এই সকল অর্জনের জন্যে বর্তমান সরকারেরে পক্ষ থেকে দাবী করা হচ্ছে যে, অর্জিত আর্থ-সামাজিক এ সকল উন্নয়নের ৭০% অর্জিত হয়েছে বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। যাই হোক, এই সময়ে  শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং কারগরি শিক্ষায় সফলতার দাবী করা হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে খুব একটা অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না।  অন্যদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়লেও বৃদ্ধি পায়নি স্বাক্ষর এবং কর্মদক্ষ জনশক্তি। ন্যূনতম দক্ষতাবিহীন সনদধারী জনশক্তির প্রবৃদ্ধি শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক বিচ্যুতির বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে ও নীতি প্রণয়ের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, বিভ্রান্তি, অসংগতি ও জনসম্পৃক্তির ঘাটতি,  শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি এবং প্রস্তাবিত রূপরেখা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা – এসব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটি বড় সংকটের মুখোমুখি বলে বিজ্ঞজনেরা  মনে করেন। 

শিক্ষার প্রসার এবং প্রবৃদ্ধি 
বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন অর্থ-সামাজিক গোত্রের শিশুদের স্কুলে ভর্তি করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। চার দশক আগে এক তৃতীয়াংশেরও কম শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতো। আজ সেই সংখ্যাটা প্রায় ৮০%। ছেলেদের তুলনায় শ্রেণীকক্ষে মেয়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। মাধ্যমিক পর্যায়ের মেয়েরাই অধিকতর হারে ঝরে পড়তো। ২০০০ এর দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির হার ছিল ৯০ শতাংশের উপরে। কিন্তু অধিক সংখ্যায় শিশু ঝরে পড়ায় প্রাথমিক চক্র সম্পূর্ণ করার  হার ছিল মাত্র ৫০ শতাংশ। ২০১৫ সাল নাগাদ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তি বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে — পিইসি তে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি আজ অন্তত একটি পরীক্ষা পাশের সনদধারী। শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির হারের বিস্ফোরক প্রবৃদ্ধি এবং অধিকমাত্রায় সমাপনী পরীক্ষা পাশের বিচারে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি অনেকটাই নজরকাড়া।

এই অর্জনের  পিছনে অবদান ছিল ১৯৯০ -এর দশকের একাধিক সামাজিক উদ্ভাবনী নীতির। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা” এবং মাধ্যমিক স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্যে ‘উপবৃত্তি প্রকল্প’ শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সফল হয়। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা কম খরচে ও অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তি পরীক্ষা (পিএসসি) চালু করে। প্রাথমিক চক্রের শিক্ষা সমাপ্তি নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ গ্রেডের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলত পরবর্তী বছরগুলোতে প্রাথমিক সমাপ্তির হারে একটি নাটকীয় প্রবৃদ্ধি ঘটে।

শিক্ষার মান
সফলভাবে স্কুলবয়সী শিশুদের উপস্থিতি ও তালিকাভুক্তির হারের প্রবৃদ্ধি এবং স্কুলব্যবস্থা সম্প্রসারণ করতে পারলেও  শিক্ষার মান বাড়াতে সরকার কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।  ‘লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে –“প্রাথমিকের  মোট ছাত্র-ছাত্রীদের  অর্ধেকের বেশি দশ বছর বয়সী বাংলাদেশি পড়ুয়াদের মধ্যে  স্কুলের পড়ায় দক্ষ নয় এবং ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের এক চতুর্থাংশেরও বেশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ নেই। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় শতভাগ শিশুর উপস্থিতির সাফল্য দৃশ্যমান হলেও শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে। মান খারাপ হওয়ায় অনেকেই পড়া, লেখা ও গণিতের মৌলিক সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা অর্জন না করেই বিদ্যালয় ত্যাগ করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণে এগিয়ে থাকলেও মানে যথেষ্ট পিছিয়ে। প্রাথমিকে ১১ বছর বয়সে বাংলাদেশের শিশুরা যা শিখে তা অন্য দেশের শিশুরা শিখছে সাড়ে ৬ বছরে। ফলে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তর শেষ করলেও তারা সাড়ে চার বছর পিছিয়ে থাকছে। তৃতীয় শ্রেণীর শিশুদের বাংলা পাঠের অবস্থা খুবই করুণ। তাদের ৬৫ শতাংশ বাংলা পড়তে পারে না। তৃতীয় শ্রেণীর ৩৫ শতাংশ শিশু কোনো রকম বাংলা পড়তে পারে। আবার পঞ্চম শ্রেণী পাস শিশুরা গণিতের মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না। মাত্র ২৫ ভাগ শিশু  নিজ শ্রেণীর উপযোগী গণিতের সমাধান করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মসূচির অভাবে এ অবস্থা” বলে বিশ্বব্যাংকের  উক্ত প্রতিবেদনে দাবী করা হয়েছে।

নিম্নমানের শিক্ষা পদ্বতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং গণশিক্ষায় অপর্যাপ্ততার কারণে প্রাথমিকের শিক্ষার মান বাড়ছে না বলে দাবী বিশ্বব্যাংকের। প্রতিবেদনে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বলা হয়েছে- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরের বাজেটের এক ভাগও গবেষণায় ব্যয় করা হয় না, যা খুবই হতাশাজনক। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক প্রকল্প থেকে গবেষণার জন্য বরাদ্দ পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন(ইউ জি সি) এর সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, দেশের ৪৩ টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে সর্বমোট ব্যয় করেছে ১২০ কোটি টাকা যার গড় অংক দাঁড়ায় ২.৭৯ কোটি টাকা। অপর দিকে ৮৭ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে একই সময়ে ব্যয় করেছে ২৮৮ কোটি টাকা যার গড় হিসাব দাড়াঁয় ৩.৩১ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ১০টি সরকারী ও ১৮ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উক্ত সময়ে গবেষণা খাতে এক পয়সাও খরচ করে নি। গবেষণায় পিছিয়ে থাকার কারণে (অন্য কারণও আছে) বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে (জি কে আই) বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। জি কে আই -এর ২০২৩ প্রতিবেদনে দেখা যায়, পৃথিবীর ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১২তম স্থানে। এই সময়ে বাংলাদেশ ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৩৬ পয়েন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়। অথচ অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রাপ্ত গড় পয়েন্ট হচ্ছে ৪৭.৫। গবেষণা এবং ইনোভেশন খাতে বাংলাদেশ ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ১৭.৩৬ পয়েন্ট অর্জন করতে পেরেছে। উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৫ পয়েন্ট। উল্লেখ্য ১৫৫টি চলকের ভিত্তিতে জি কে আই তৈরি করা হয় (আন্দালিব, ২০২৪)। 

শিক্ষা এবং শেখার মধ্যে অসঙ্গতি  
জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংস্থা, ইউনেস্কো প্রকাশিত  গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট “শিক্ষা এবং শেখা: সকলের জন্য গুণমান অর্জন” প্রতিবেদনটি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল  বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষায় প্রবেশাধিকার ও অশগ্রহণের হারের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে। তার পাশাপাশি একটি আসন্ন সঙ্কট বিষয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সেটা হলো “শেখার সংকট” (লার্নিং ক্রাইসিস)। এমডিজি পরবর্তী ২০১৫-২০৩০ সময়ের এসডিজি ক্যাম্পেইনের প্রস্তুতি হিসাবে ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের স্কুলে নিবন্ধনের পাশাপাশি শ্রেণী কক্ষে শেখার ও স্বাক্ষরতা বিষয়ে মনোযোগ বৃদ্ধির সুপারিশ করে।

শিকাগো বিশ্ববিদালয় থেকে প্রকাশিত “কম্পারেটিভ এডুকেশন রিভিউ” জার্নালে প্রকাশিত  “গ্রামীণ বাংলাদেশে শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং সাক্ষরতা অর্জনের অসঙ্গতি” শীর্ষক (আসাদুল্লাহ, ২০১৫)  প্রবন্ধে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শেখার ঘাটতির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। ১০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক মানের ন্যূনতম গণনার যোগ্যতা বিচারে একটি বিশাল অসঙ্গতি ফুটে উঠে। দেখা যায় যে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে এক বছর সমাপ্তি সাপেক্ষে সংখ্যাতাত্ত্বিক দক্ষতার বৃদ্ধির হার মাত্র ৬.৩ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন ধারার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কম-বেশী এই ঘাটতির শিকার —প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণিতে প্রমোশন অনুপাতে শেখার প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক নয়  অর্থাৎ গ্রামীণ বাংলাদেশে সরকার পরিচালিত মাধ্যমিক স্কুলগুলোর “লার্নিং প্রোফাইল” দুর্বল (আসাদুল্লাহ, ২০১৫)। 

সাম্প্রতিক সময়ের সরকারি তদারকিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী “লার্নিং প্রোফাইলে” তেমন বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতি দুই বছর অন্তর “জাতীয় ছাত্র মূল্যায়ন” (এনএসএ) সমীক্ষা পরিচালনা করে। এতে  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের বাংলা পড়ার এবং মৌলিক পাটিগণিত সক্ষমতার মূল্যায়ন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত ২০১১ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে সমাপ্ত মূল্যায়নের ফলাফল বিবেচনায় তেমন কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়৷ উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালের এনএসএ সমীক্ষায়, ৫ম শ্রেণীর ৫৬ শতাংশ শিক্ষর্থীর অর্জন ছিল “মৌলিক” বা “বেসিকের নীচে” স্তরে।

পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংকের “শেখার দারিদ্র্য” (লার্নিং পভার্টি) সামষ্টিক মূল্যায়নে আমাদের শিক্ষার দুরবস্থার প্রমাণ মিলে। এই সূচক অনুযায়ী বাংলদেশে স্কুলে যাচ্ছে এমন  ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অর্ধেকই প্রাথমিক স্তরে ন্যূনতম মানের বিচারে একটি গল্প পড়তে অক্ষম। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে লার্নিং পভার্টির আনুমানিক হার ৫৮ শতাংশ। তুলনামূলক বিচারে মালয়েশিয়ায় যা কিনা মাত্র ১২ এবং এবং শ্রীলঙ্কা ১৫ শতাংশ।

শিক্ষাবর্ষ সমাপ্তি  এবং পরবর্তী শ্রেণিতে অন্তৰ্ভুক্তি সাপেক্ষে শেখার হারের অপর্যাপ্ত প্রবৃদ্ধি আমাদের গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত গভীর সঙ্কটের প্রতিফলন। পাশের হার উচ্চ এবং জিপিএ-৫ এবং ডিগ্রীধারির সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু বাড়ছে না কর্মদক্ষতা। এর মূল কারণ হল প্রাথমিক স্তরে ন্যূনতম দক্ষতাশূন্য ও জ্ঞানহীন শিক্ষার অপরিকল্পিত এবং একতরফা প্রসার।

বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যূনতম দক্ষতা ও সাক্ষরতা জ্ঞানের সঙ্কটের (যাকে বিশ্ব ব্যাংক বলছে “লার্নিং ক্রাইসিস”)  কারণ একাধিক। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো - শিক্ষক স্বল্পতা, পাঠদানে শিক্ষকদের অদক্ষতা ও অপারগতা,  অপর্যাপ্ত শিক্ষা বাজেট ও স্বল্প বেতন, অবকাঠামো ঘাটতি এবং শিক্ষাখাতে অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য।

শিক্ষক স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত শিক্ষা বাজেট এবং অবকাঠামো ঘাটতি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম দুই দশকে (১৯৭০-১৯৯০) পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ শিক্ষা বিনিয়োগকে পুঁজি করে টেকসই  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক চমক সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং হংকং – এই দেশগুলোতে শিক্ষামুখী উন্নয়ের বহুল সমাদৃত মডেলের মূলে ছিল রাষ্ট্র চালিত মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার। এই ধারার অনুসরণে অপেক্ষাকৃত কম উন্নয়নশীল দেশ,  যেমন-  ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া খুব অল্প সময়ে শিক্ষা ও অর্থনীতি দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। এই দেশগুলোতে সরকার সব সময় শিক্ষার্থী সংখ্যা এবং জাতীয় আয় অনুপাতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ এবং বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।

কিন্তু উন্নয়ের এরকম আঞ্চলিক সাফল্যের অভিজ্ঞতা উপেক্ষা করে ১৯৭১-২০২১ সময়ে বাংলাদেশর শিক্ষা ব্যাবস্থা অগ্রসর হয়  অনেকটাই উল্টো পথে। ১৯৪৭-১৯৭১ কালীন সৃষ্ট শিক্ষাব্যাবস্থা বৈষম্যে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাপেক্ষে বিদ্যালয়ের ব্যাপক স্বল্পতা দেখা দেয়। কিন্তু অধিক সংখক নতুন সরকারি বিদ্যালয় নির্মাণের পরিবর্তে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ১৯৭০এর দশকের গোড়ার দিকে কেবল ৩৭০০০ এরও বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারি স্কুলের যথেষ্ট প্রসার ঘটেনি। এই ঘাটতি পূরণ করতে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যাপক হারে স্থাপিত হয় বিভিন্ন ধারার বেসরকারি বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা। সাময়িকভাবে এই বহুমুখী ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি করলেও পরবর্তীতে তা নতুন সংকটের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার চার দশক পরে ২০১৩ সনে প্রায় ২৬১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখেরও বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়।

কেবলমাত্র জাতীয়করণের মধ্যে দিয়ে মূল অবকাঠামোগত অসামাঞ্জস্য ও বিদ্যমান ঘাটতিগুলো পূরণ হয়নি। একদিকে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষকদের বেতন কম, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাপেক্ষে শিক্ষকের স্বল্পতা। উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে শিক্ষার্থী মাথাপিছু শিক্ষকের সংখ্যা বাংলাদেশে সর্বনিম্ন– মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে ৪৫ জন ছাত্রকে সামলাতে হয়। শিক্ষকের মান ও সংখ্যার অপর্যাপ্ততা– এই দুই সংকট সার্বজনীন শিক্ষার নিম্নগতির অন্যতম কাঠামোগত কারণ। ইউনেস্কোর প্রস্তাবিত জিডিপির ৪-৬ % ব্যয় বরাদ্দের বিপরীতে বাংলাদেশর শিক্ষায় ব্যয় জিডিপির ২.১% যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় কম। 

বৈদেশিক রেমিট্যান্সের স্থির প্রবাহ, তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় এবং অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির হারের বিবেচনায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। অথচ সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা সৃষ্ট আর্থিক উদ্বৃত্ত এবং শিক্ষা বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, আমাদের শিক্ষা খাতে রয়েছে ব্যাপক বাজেট ঘাটতি। অতীতের তুলনায় মোট শিক্ষা ব্যয়ে বৈদিশিক সহায়তার অংশ ইতিমধ্যেই কমে দাঁড়িয়েছে ৬%। দেশব্যাপী সরকারি বিদ্যালয়ের অপর্যপ্ততা এবং সরকার ভর্তুকিপ্রার্প্ত (এমপিও) স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের স্বল্পতা শিক্ষা অর্থায়নের ক্রমবর্ধমান ঘাটতিরই প্রতিফলন।

শিক্ষাখাতে অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য
শিক্ষা খাতে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি রয়েছে ব্যয়ের অস্বচ্ছতা ও অকার্যকরিতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক দুর্নীতি ও অদক্ষতা। মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিবর্তে রাজনীতিকরণের সংস্কৃতি শিক্ষাখাতে বাড়তি সংকট সৃষ্টি করে। বিগত দশকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের মধ্যে জবাবদিহিতার অবনতি এসব সমস্যা সমাধানের পথ আরো সংকুচিত করেছে। 

সীমিত সরকারি বরাদ্দের অপব্যাবহার ও অপচয় এবং ব্যাবস্থাপনায় সুশাসনের অনুপস্থিতি আরেকটি কৃত্রিম শিক্ষা সংকট সৃষ্টি করেছে যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অপ্রতুলতায়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, অনিয়ম এবং ব্যাপক দুর্নীতি – সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষকদের মান নিন্মগামী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জরিপের উপাত্ত অনুযায়ীই, মাধ্যমিক স্তরের মাসিক পে-অর্ডার (এমপিও) তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে আবেদনকারীদের শিক্ষক নিয়োগের জন্য ৩.৫০ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা দিতে হয়।

মাঠ পর্যায়ের গবেষনায় দেখা গেছে যে,  সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ বেতনভোগী কর্মীদের মধ্যে শিক্ষক অনুপস্থিতির হার সর্বাধিক। শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি এবং প্রশিক্ষণ ও কর্মদক্ষতাজনিত কাঠামোগত সমস্যা উপেক্ষা করে জাতীয়করণ পরবর্তী সময়ে শিক্ষামানে কোনো বড়ো রকমের পরিবর্তন আসেনি। “সবার জন্য শিক্ষা” কর্মসূচির অর্জন  বিদ্যালয়ে নিবন্ধন ও সমাপনী পরীক্ষা পাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সার্বজনীনভাবে শিক্ষার মান নিম্ন যার প্রমান মিলে শিক্ষা এবং শেখার অসঙ্গতির  মধ্যে।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এই ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে। এক হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষায় মোট ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫৮% বোঝা বহন করে স্কুলগামী শিশুদের পরিবারগুলো। ইউনেস্কোর সমীক্ষা অনুসারে, সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলো সরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের তুলনায় বইয়ের জন্য কয়েকগুণ বেশি এবং মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য দরিদ্র পরিবারের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি প্রাইভেট টিউশনে ব্যয় করে। এর সামষ্ঠিক ফলাফল হলো শিক্ষাখাতে সামাজিক বৈষম্য এবং  শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে শিক্ষা মানের ব্যবধান বৃদ্ধি।

ভ্রান্ত শিক্ষা নীতি, অকার্যকর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ব্যর্থতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি কার্যকর ও প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন  ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষানীতি ঘোষনা করে। ১৯৮৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে আরো পাঁচটি নতুন শিক্ষানীতি হয়। এই নীতিগুলোর মধ্যে খুব কমই শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সর্বশেষে গঠিত ২০০৯ সালের  শিক্ষা কমিশন বেশ কিছু পরিবর্তনের পর ২০১০ সালে আরো একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশ করে। কিন্তু প্রস্তাবিত নীতির অধিকাংশই এখনোও অকার্যকর রয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালের মধ্যে আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা এবং এই লক্ষ্য অর্জনে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় ৬, ৭, এবং ৮ ক্লাশ অন্তর্ভুক্ত করার কথা। ‘সকলের জন্য শিক্ষা’র আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে শিক্ষা ব্যয়ের সুপারিশকৃত মাত্রা বিবেচনায় প্রেক্ষিত (২০১১-২১) পরিকল্পনার সময়সীমায় জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশে বৃদ্ধি করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটিই হয়নি।

২০১০ সালের শিক্ষা নীতি প্রকাশের এক দশক পরেও একদিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ হয়নি, অন্যদিকে আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১০ নীতিমালা অনুসারে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরেই শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত হবার কথা ১:৩০। অথচ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ১:৩৭, মাধ্যমিক স্তরে ১:৪৫। শিক্ষক সংখ্যার সংকটের সাথে যুক্ত হয়েছে অযোগ্য শিক্ষকের অপার্যপ্ততা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক সূত্র মতে ৪৬% মাধ্যমিক শিক্ষক তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না।

২০১০ সনের শিক্ষা কমিশনকে পাশ কাটিয়ে ও কোনো উম্মুক্ত আলোচনা ছাড়াই বাস্তবায়িত হতে চলেছে নতুন সিলেবাস। অতি সম্প্রতি ২০২২ সালে নীতিমালা সংস্কার করা হচ্ছে যার মূল ভিত্তি হলো একটি যোগ্যতা-ভিত্তিক (কমপিটেন্সি বেসড) জাতীয় স্কুল সিলেবাস প্রণয়ন এবং একই সাথে প্রাথমিক ও জুনিয়র মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার বদলে থাকবে বছরব্যাপী শিক্ষার্থীদের জ্ঞান এবং দক্ষতার মূল্যায়ন।  প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরি এবং অযৌক্তিকভাবে পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করার সংকৃতি বন্ধের জন্যে ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হতে চলেছে এই নতুন সিলেবাস। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনীতি-বান্ধব শিক্ষা নিশ্চিত করা  এবং একুশ শতকের উপযোগী কর্মশক্তি গড়ে তোলা। উচ্চ-বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কিছু দক্ষতা অর্জন। যেমন, কাঠের কাজ, গ্রাফিক ডিজাইন, গাড়ির মেকানিক্স, চাইল্ড কেয়ার এবং প্লাম্বিংয়ের মতো বিকল্পগুলোর বৃত্তিমূলক বিষয়। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ প্ৰাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার বিচারে এই পরিবর্তনগুলো অনেকটাই আকস্মিক ও শিক্ষা প্রশাসনের সক্ষমতা সাপেক্ষে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিগত ঘাটতি উপেক্ষা করে অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী পাঠসূচির সংস্কার হবে হিতে বিপরীত। যেখানে কার্যকর ও ন্যূনতম সাক্ষরতাই নিশ্চিত করা হয়নি, জাতীয় পর্যায়ে রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের বিশাল ঘাটতি এবং সরকারি বিদ্যালয়ের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর শিক্ষা নির্ভর করছে অনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা ব্যাবস্থার ওপর, তখন পাঠসূচিতে কম্পিউটার কোডিং চালু শিক্ষক ও শিক্ষকদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা ছাড়া কিছু নয়। সংলাপ, সুশীল ও নাগরিক সমাজকে পাশ কাটিয়ে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এরকম নীতির একপেশী নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি দ্বৈততা সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। একদিকে নীতিমালার বিপরীতে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় সর্বস্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার সরকারি প্রতিশ্রুতির প্রতি নাগরিকদের আস্থাহানি ঘটেছে, আর্থিকভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠী ব্যাক্তিখাতের বেসরকারী শিক্ষার দ্বারস্থ হচ্ছে যা কিনা শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে ২০১১ এর জাতীয় শিক্ষা কমিটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ২০২২ এর একপাক্ষিক ঝটিকা সংস্কার নীতি প্রণয়নে সংকুচিত জনপ্রতিনিধিত্ব ও গণতান্ত্রিক অংশীদারিত্বের বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। নীতি পরিবর্তন ও বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং এর মূল নীতি থেকে বিচ্যুতির একটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং দৃশ্যমান কিংবা জনপ্রিয় খাতে অর্থ অপচয়। আর একটি দিক হলো ‘ডায়গনিস্টিক ফেইলার’ বা সমস্যা নির্ণয়ে ব্যর্থতা এবং অত্যাবশকীয় ও ভিত্তিগত দক্ষতা ঘাটতি উপেক্ষা করে উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবতা বিবর্জিত লক্ষ্য নির্ধারণ।

আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ- দেশের তরুণ কর্ম শক্তিকে একুশ শতাব্দীর জন্য প্রস্তুত করা। এর জন্য প্রয়োজন ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম’ কর্তৃক শনাক্ত বিবিধ/ বহুমুখী দক্ষতার অর্জন। সুনির্দ্ধিষ্ট ভাবে বলতে গেলে এই দক্ষতা তালিকায় রয়েছেঃ  সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, যোগাযোগ দক্ষতা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, অধ্যবসায়, সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা, বিশ্ব ও বৈশ্বিক সচেতনতা, স্বতোঃপ্রনোদনা, সামাজিক দক্ষতা, নাগরিক সাক্ষরতা, সামাজিক দায়িত্ব, উদ্ভাবন দক্ষতা এবং চিন্তা করার দক্ষতা। আমদের শিক্ষার্থীদের এ সকল দক্ষতা অর্জনে সক্ষম করে তুলতে হবে যাতে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে কাজ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো আমরা এখনো সার্বজনীনভাবে উনবিংশ শতাব্দী  মানের সাক্ষরতা অর্জনে অক্ষম। এই বিবেচনায় এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালে পরিকল্পিত সংস্কার অনেকটা উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব (আসাদুল্লাহ, ২০০৯)।
 
আমাদের শিক্ষার উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ বেকার থাকছে। কোনো কাজ পাচ্ছে না। অর্থাৎ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। এ অবস্থায় মানবসম্পদের কাংখিত  উন্নয়ন আশা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন কৌশল বদলাতে হবে। সেই সাথে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ কাজ পায়। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানত যে বিষয়গুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে: ১. মানবসম্পদ ২. প্রাকৃতিক সম্পদ ৩. শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সে হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নও নির্ভর করছে মূলত দক্ষ জনশক্তির ওপর। বিশ্বব্যাংক (২০০০), ইউএনডিপি (২০০০), ইউনেস্কো (১৯৯৯) সালে তাদের  রিপোর্টে বলেছে, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নের আর কোনো পথ খোলা নেই। সব রিপোর্টেই বলা হয়েছে, দেশের এই অধিক জনগোষ্ঠীকে অতি জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার মাধ্যমে বিশাল শ্রমবাজারের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কথা।

দেশকে দ্রুত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষার প্রসার জরুরি। তাই প্রকৃতপক্ষে মানসম্মত, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা এখন সময়ে দাবি। এ দিক থেকে বিচার করলে অবশ্যই বলতে হবে যে, প্রত্যেক সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার মানোন্নয়নে অনেক কথা বলা হলেও শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য বা দর্শন এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়নি। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে জাতীয়ভাবে আমাদের এখনো কোনো শিক্ষার মডেল বা আদর্শ নেই। পশ্চিমা ধাঁচের যে শিক্ষা ধারাটি এখনো প্রধানভাবে চলছে বলে ধরা হয় তাকেও বর্তমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আধুনিক কোনো ব্যবস্থা বলে ধরা  যায় না। মূলত বহু দিন আগে ব্রিটিশ প্রবর্তিত এই শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং দেশের প্রয়োজন মেটাতেও সেভাবে সক্ষম নয়। 09

উপসংহার
বাংলাদেশের  স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল সার্বজনীন গুণগতমানের শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্যের নিরসন ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠমোগত ব্যাপক সম্প্রসারণ হলেও শিক্ষা ব্যাবস্থার কাঠামোগত কোনো মৌলিক পরিবর্তন হ্যনি। শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়লেও সাক্ষরতা, সংখ্যায়ন, গবেষণা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সূচকে এশিয়ার উচ্চ-মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের সাথে তুলনামূলভাবে  বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং এ পিছনের সারিতে। সরকারি পরিকল্পনা ও নথিপত্রে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষা অগগ্রযাত্রার এই অসঙ্গতি স্বীকৃত হলেও এর নিরসনে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও ইচ্ছাশক্তির ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, গত এক দশকে প্রবর্তিত পাঠ্যক্রমের অনেক পরিবর্তন এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান মানব উন্নয়ন অবকাঠামো অত্যন্ত ভঙ্গুর, যা বর্তমান পূর্ব এশিয়ার উন্নয়ন মডেলের সঙ্গেও সংঘাতপূর্ণ।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত শিক্ষার্থী-মুখী নতুন পাঠ্যক্রম আশাব্যঞ্জক। তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন একাধিক সম্পূরক সংস্কার — শিক্ষা প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন, শিক্ষাব্যাবস্থার অরাজনীতিকরন, সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি ও  ব্যয়ের স্বচ্ছতা। এসব কাঠামোগত ঘাটতি উপেক্ষা করে নীতির বিক্ষিপ্ত পরিবর্তন ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষার নীরব সঙ্কটের শিকড় শিক্ষা ও রাজনীতি উভয়ের সাথে বিবিধভাবে সম্পৃক্ত। তাই সংকট নিরসনে প্রয়োজন মৌলিক ও  বহুমুখী পদক্ষেপ, উদ্ভাবনী চিন্তা ও বর্ধিত পরিসরের কৌশল। তাহলেই নতুন পাঠ্যক্রম ভবিষ্যত প্রজন্মের  জন্য ইতিবাচক প্রমাণিত হবে  এবং ২০৩১ সাল নাগাদ আমরা মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ এর মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হবো এবং  মেধা, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফল হবো।

তথ্যসূত্র
1. Asadullah, M Niaz, Antonio Savoia and Wahiduddin Mahmud, 2014. “Paths to Development: Is there a             Bangladesh surprise?” World Development. Volume 62, October, Pages 138-154
2. Asadullah, M Niaz & Chaudhury, Nazmul 2009. “Reverse gender gap in schooling in Bangladesh: Insights from urban and rural households,” The Journal of Development Studies, 45(8):1360-1380.
3.  Asadullah, M Niaz and Chaudhury, N. (2015). “The dissonance between schooling and learning: Evidence from rural Bangladesh”,  Comparative Education Review. 59(3), 447-472.
5. Asadullah, M Niaz, Antonio Savoia and Kunal Sen (2020). “Will South Asia achieve the Sustainable Development Goals by 2030? Learning from the MDGs experience,” Social Indicators Research, 152, 165-189.
6. Andaleeb, Saad (2024). Public universities and research: In 2022 and beyond, The Daily Star, 12 Feb, 2022.

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd