কোরবানি তাৎপর্য ও পশুর যত্নে করণীয়
মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বড় দুইটি উৎসবের মধ্যে প্রথমটি হলো ঈদ-উল-ফিতর এবং দ্বিতীয়টি ঈদুল আজহা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ মহান আল্লাহ তায়ালার উপর ভয়, নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের দশম দিনে পশু জবেহ করার নাম হচ্ছে কোরবানি।
এক হাদিসে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘কোরবানি হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত। কোরবানির পশুর প্রত্যেক লোমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব দেওয়া হবে’ (মুসনাদে আহমাদ)।
মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞাণী এবং অন্তরজ্ঞাপী। তিনি প্রত্যেক বান্দার অন্তরের খবর রাখেন এবং তার জন্য রিযিকের ব্যবস্থা করেন। রাব্বুল করীম কোন বান্দার পশু ছোট নাকি বড় তা দেখেন না। বরং বান্দার অন্তরের স্বচ্ছতা, তার প্রতি ভালোবাসা এবং একাত্মবাদ দেখেন। মহান রবের নিকট পশুর মাংস, রক্ত, চামড়া প্রভৃতির কিছুই পৌঁছায় না বরং বান্দার অন্তরের তাকওয়া পৌঁছায়।
যে সকল বান্দার জিলহজ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখে নিজেদের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ ব্যতীত অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ এর সমপরিমাণ অর্থের মালিক তাদের উপর কোরবানি ফরজ। আবার ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো ব্যক্তির সামর্থ্য থাকলে সেও পশু কোরবানি দিতে পারবে। ১০ জিলহজ পশু কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব।
এই দিনে কোরবানি হচ্ছে মহান রবের নিকট পছন্দের আমলের মধ্যে একটি। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেন, ‘যার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটও না আসে (ইবনে মাজাহ)’।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে আগামী ১৭ জুন দেশে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা উদযাপিত হবে। পবিত্র দিনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে বাজার জমে উঠেছে পশুতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গবাদিপশু শহরের হাটে আসতে শুরু করেছে। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান বাজারের ভিড় সহনীয় না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন খামারে গিয়ে পশু ক্রয় করছেন।
আবার অনেকে মুসলমান পছন্দের পশু ক্রয় করার জন্য হাট থেকে হাটে ঘুরছেন এবং দর কষাকষি করছেন। পশু ক্রয় করার পর হাট থেকে বাড়িতে আনার পূর্বে ও পরে এবং কোরবানি সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত পশুর যত্ন নিতে হবে। কারণ প্রাণীর ও প্রাণ আছে, সেও কষ্ট অনুভব করে।
নবী করীম (সা.) প্রাণীর প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই জন্য যে সকল বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি তা হল-
১. হাটে প্রচণ্ড তাপ থাকায় পশু অনেক নিস্তেজ ও অবসাদগ্রস্ত থাকে। সুতরাং বাড়িতে আনার পূর্বে হাঁটিয়ে আনা যাবে না। পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে আসতে হবে।
২. বাড়িতে আনার পর পরিমাণ মতো বিশুদ্ধ পানি, খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভব হলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করাতে হবে।
৩. পশুকে যতটা সম্ভব উঁচু, শুকনো এবং ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
৪. সংক্রামক রোগ যাতে না ছড়াই সে দিকে নজর দিতে হবে। প্রয়োজন মতো ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পশুর স্থান পরিষ্কার করতে হবে।
৫. গবাদিপশুকে প্রতিদিন প্রয়োজন মতো পুষ্টিকর খাবার খৈল, ভুসি, চালের কুড়া প্রভৃতি ব্যবস্থা করতে হবে। বদ্ধ পরিবশে পশুর আরামের করার জন্য পাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. কোরবানির দিন সকাল সকাল পশুকে গোসল এবং বিশুদ্ধ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল ধরনের ওষুধ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। জবাই করার পূর্বে কোনো ভাবেই পশুকে বিরক্ত করা যাবে না।
৭. গবাদিপশু জবেহের পূর্বে চাকু বা ছুরির পর্যাপ্ত ধারালো কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। পশুর সম্মুখে চাকু ধার দেওয়া এবং অন্য পশু জবেহ করা যাবে না। এতে করে উক্ত প্রাণীটি আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারে।
৮. জবেহ করা প্রাণী পুরোপুরি নিস্তেজ হওয়ার পর চামড়া ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে সেখানে পশুর বর্জ্য যেমন রক্ত, চামড়ার অবশিষ্টাংশ প্রভৃতি ফেলে রাখা যাবে না। কারণ এতে করে পরিবেশ দূষণ এবং সংক্রামক রোগ ছড়াতে পারে।
৯. প্রাণীর শারীরিক কোন সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে
১০. পশুর মাংস সমানভাগে ভাগ করে গরীব দুঃখীদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। কোন ভাবেই গরিবের হক নষ্ট করা যাবে না । এতে করে আপনার কোরবানী সঠিক নাও হতে পারে
১১. কাঁচা মাংস কোন ধরনের প্রাণিজ বর্জ্য বা রাসায়নিক সংস্পর্শে না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বন্যপ্রাণী এবং র্যাবিস কিংবা অন্য কোন ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত পশু জবেহ থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে করে প্রানী থেকে মানুষের দেহে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে
১২. কোরবানির পর যতটুকু সম্ভব উঁচু স্থানে পশুর বর্জ্য প্লাস্টিক ব্যাগের মোড়কে রাখতে হবে। যাতে করে বৃষ্টির পানির সাথে না ধুয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানির সাথে না মিশে। পশুর বর্জ্য সঠিক মতো পরিষ্কার হচ্ছে কিনা নজরদারিতে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে পৌরসভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।