নাগরিক সেবার প্রতিশ্রুতি ও আমলাতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ
আমলাতন্ত্র বিষয়টি একটি রাষ্ট্রকাঠামোতে অন্যতম বহুল আলোচিত এবং প্রায়োগিক বিষয়। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে আমলাতন্ত্র নিয়ে রয়েছে নানা মত এবং আলোচনা। তবে তৃতীয় বিশ্বের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমলাতন্ত্র জনসাধারণের বিতর্ককে অতিক্রম করতে পেরেছে সে দৃষ্টান্ত বিরল। এ সকল দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থার পটভূমিতে আমলাতন্ত্রকে অদক্ষতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অপশাসন, গোষ্ঠীতন্ত্র, পক্ষপাতদুষ্টতা ইত্যাদি বিষয়ে বারবারই সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে। অনাকাংঙ্খিত হলেও সত্য বাংলাদেশেও আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে ঔপনিবেশিকতার ধারা প্রবহমান আছে সে কথা চর্বিত চর্বণে পরিণত হয়েছে বেশ আগেই তবে উৎকণ্ঠার বিষয়টি হচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে এবং গণমাধ্যমে তা খবর হয়ে এসেছে বারংবার। প্রাসঙ্গিকভাবে এ কথাও বলা চলে আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ তবে রাষ্ট্রযন্ত্র বা সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয় যে সত্য প্রকাশ করতে আমরা কুণ্ঠিত হই।
এখন আসা যাক আমলাতন্ত্রের ধ্রুপদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনে। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং শাসনকার্যে আমলাতন্ত্রের ধারণা বেশ পুরাতন হলেও মূলত এর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভব এবং চর্চার বিষয়টি হয়েছে ইউরোপে। তবে পশ্চিমের বিদগ্ধ পন্ডিতদেরও এর পক্ষে এবং বিপক্ষে মতামত আছে। কেউ কেউ এটিকে বিদ্রুপ পর্যন্ত করেছেন। তবে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার যাকে আমলাতন্ত্রের জনকও বলা হয় কারণ প্রশিক্ষিত পেশাদারদের দিয়ে প্রশাসন পরিচালনার বিষয়টি সামগ্রিকভাবে তিনিই প্রথম সামনে আনেন।
উনিশ শতকে ম্যাক্স ওয়েবার উনার ‘এসেজ ইন সোশিওলজি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন আমলাতন্ত্র হতে হবে শ্রেণিবিন্যাসকরণ, ধারাবাহিকতা, নৈর্ব্যক্তিকতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন ম্যাক্স ওয়েবার আমলাতন্ত্রের সমালোচনায় একথাও বলেছেন এর নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে। অর্থাৎ উনার এই ব্যাখ্যা থেকে এটি স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায় যে আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ।
বাংলাদেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা আমলাতন্ত্রের ধারাটি বেশ পুরোনো। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান শাসন আমল পার করে এটি আজকের পর্যায়ে এসেছে। তবে কেতাবি অর্থে জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্রের যে রূপ প্রক্ষেপণ হয় তা এই ভূখণ্ডের মানুষ আজও দেখিনি। বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছে সিভিল সার্ভিস বা আমলাতন্ত্র আস্থার জায়গা না হয়ে আতঙ্কের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়েছে।
কেন এমনটা হয়েছে সে প্রশ্নের উত্তর আছে গণমাধ্যমের পাতায় পাতায় বা টেলিভিশন স্ক্রিনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রয়েছে এ সংক্রান্ত বিস্তর চর্চা। জনপ্রশাসনের জনস্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং দুষ্টচক্রের সাথে এর সম্পৃক্ততা জনসাধারণের উপর আস্ফালন হয়ে নেমে এসেছে বার বার তেমন ঘটনা আমাদের দেশে বেশ দৃশ্যমান। যার ফলে বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(২) ধারাটি লঙ্ঘিত হয় অবলীলায় যেখানে উল্লেখ আছে “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য”।
সরকারি অফিসে নাগরিক সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়া বা রূঢ় আচরণের শিকার হওয়া স্বাভাবিক হয়ে পড়লেও আরও কিছু আলামত সচেতন নাগরিককে এই পুরো ব্যবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে যেমন- শুধুমাত্র ‘বিশেষ সম্বোধন’ না করার কারণে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবী মানুষকেও সরকারি অফিসে হেনস্তা হতে হয়েছে এবং হচ্ছে বা খোলা বাজারে কোনো ব্যবসায়ীর যৌক্তিক জিজ্ঞাসার বিপরীতে দেখা গিয়েছে কোনো নির্বাহীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
বিভিন্ন সময়ে এই তালিকা থেকে বাদ পড়েননি বৃদ্ধ, নারী, মুক্তিযোদ্ধা এমনকি সরকারি চাকুরিজীবীরাও। কাজেই নাগরিক সেবা প্রত্যাশী সাধারণ মানুষের সিভিল সার্ভিসে এখন আস্থার চেয়ে অনাস্থার জায়গাটিই বেশি গুরুতর হয়ে উঠেছে। অথচ আমলাতন্ত্র বা জনপ্রশাসনের স্বাভাবিক ব্যাখ্যার চর্চা থাকলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব নাও হতে পারত।
আবার এমন নজিরও মেলে যেখানে দেখা যায় আচরণবিধি মেনে চলা এবং সঠিক নীতিমালা অনুসরণ করে চলা কোনো কর্মকর্তাকে নিজের সিস্টেমের কাছেই লাঞ্ছিত হতে হয়েছে শুধুমাত্র নেতিবাচক স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষকে সহযোগিতা না করার জন্য যা বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের অন্যতম ব্যর্থতা। তবে লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে এমন নির্বাহীর সংখ্যাটা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অপ্রত্যাশিত আচরণকে আড়াল করার জন্য নগণ্য।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশে নাগরিক সেবা দানকারী কর্তৃপক্ষগুলো একটি প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন নিয়েই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যার প্রেক্ষিতে বলা যায় আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা আমলাতন্ত্র প্রত্যাশা অনুযায়ী অভিযোজিত হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় বাজেটেই ‘ঘাটতি বাজেট’ নির্ধারণ করার পরেও বাজেটের বড় একটি অংশ বরাদ্দ করা হয় জনপ্রশাসন খাতে। সেই বিবেচনায় নাগরিক সেবার মান পুরোপুরি প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারলেও অন্তত সন্তোষজনক হবে সেটি সাধারণ মানুষের কামনায় থেকেই যায়।
এই বিড়ম্বনাপূর্ণ পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় নিয়ে সচেতন নাগরিক এবং সুধী সমাজের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে তাদের মতামত উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সিভিল সার্ভিসে কর্মী অন্তর্ভুক্তকরণ এবং পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে নানাবিধ পরামর্শ ও সমালোচনা। কারণ তত্ত্বগত ভাবে একটি সংস্থার সামগ্রিক মানব সম্পদের মূল্যবোধ, চিন্তার স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা, বিশ্বাস বা শিক্ষা জীবনে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষভাবে কৌশলগত নীতিনির্ধারণীতে প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ যেহেতু একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ সুতরাং যথাযথ উপায়ে এখানে নাগরিক সেবা প্রদান করাটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এদেশের জনপ্রশাসনের সকল পর্যায়ের দফতর সাধারণ মানুষের ভীতির কারণ না হয়ে আস্থার স্থান হয়ে উঠবে সেটি এখন সময়ের দাবি। আর সেটা করা সম্ভব হলেই যুগের পর যুগ চলে আসা আমলাতন্ত্রের সাথে গণমানুষের সংঘাতের সমাপ্তি টেনে সাম্যাবস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে এবং সুশাসন এবং জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: প্রভাষক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।