০২ জুন ২০২৪, ২৩:১৩

আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের নিরিখে ভাষার নতুন সংজ্ঞা

ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির  © টিডিসি ফটো

ভাষা হলো সংযুতি প্রসূত সাংজ্ঞাপনিক মাধ্যম যার একটি গঠনগত ও দক্ষতাগত দিক রয়েছে, যা প্রেক্ষাপট ভেদে নানান প্রপঞ্চ হিসাবে প্রতিভাত হয়। ভাষার প্রথম পরিচয় হলো এই যে, এটি একটি সাংজ্ঞাপনিক মাধ্যম, যার সহায়তায় মানুষ পরস্পর তথ্য, ধারণা ও ভাব বিনিময় করে থাকে।

সাংজ্ঞাপনিক মাধ্যম হিসাবে ভাষা দুই প্রকার: বাচ্য সাংজ্ঞাপনিক মাধ্যম ও লেখ্য সাংজ্ঞাপনিক মাধ্যম। সংজ্ঞাপন সম্পাদনের জন্য ভাষিক সাংজ্ঞাপনিক দক্ষতা প্রয়োজন। বাচ্য সংজ্ঞাপন সম্পাদনের জন্য বাচন ও শ্রবণ— এই দুই দক্ষতার সমন্বয়ে গঠিত বাচ্য সাংজ্ঞাপনিক দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।

অপরপক্ষে লেখ্য সংজ্ঞাপন সম্পাদনের জন্য লিখন ও পঠন— এই দক্ষতার সমন্বয়ে গঠিত লেখ্য সাংজ্ঞাপনিক দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। ভাষাবিজ্ঞানে বাচন ও লিখনকে একত্রে উৎপাদন বলে বর্ণনা করা হয়। অন্যদিকে শ্রবণ ও পঠনকে একত্রে অনুধাবন বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ভাষার সাংজ্ঞাপনিক দক্ষতার চিত্রটি নিম্নে উপাস্থাপন করা হলো:

এই ভাষার একটি গঠনগত রূপ রয়েছে, যা বাগধ্বনি, রূপমূল, বাক্যবিন্যাস ও বাগর্থ—এই চার ধরণের ভাষিক উপাদানের সাহায্যে দৃষ্ট হয়। ব্যক্তিবিশেষকে কোনও ভাষাকে আয়ত্ত্ব করতে হলে, এই চার ধরণের অবয়বগত উপাদানকে আয়ত্ত্ব করতে হয়।

মানব ভাষা প্রেক্ষাপটভেদে নানাবিধ প্রপঞ্চ হিসাবে প্রতিভাত হয়। একটি ভাষা প্রেক্ষাপটভেদে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানান প্রপঞ্চ হিসাবে প্রতিভাত হয়। এটি প্রভাবক হিসাবে সমাজের গতিশীলতার দিক ও মাত্রা নির্দেশ করে। অর্থ, ধর্ম ও যৌনতা যেমন মানব সমাজ ও সভ্যতার চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে, তেমনিভাবে ভাষাও মানব সমাজ ও সভ্যতার চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে। 

এটি একদিকে, জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―ক) বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম, খ) সামাজিকীকরণের মাধ্যম, গ) জাতীয়তাবাদের প্রতীক, ঘ) সভ্যতার বাহন, ঙ) সামাজিক সম্পদ ও চ) সাংস্কৃতিক সম্পদ। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―ক) সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার, খ) ভিন সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার, গ) অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার বিশেষ।

মানব ভাষার উপর প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নানান বিশেষণ আরোপ করা হয়ে থাকে। আবার কোনোকোনো ক্ষেত্রে ভাষাকে নানান অভিধা আরোপ করা হয়ে থাকে। মানবিকী বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের নানান শাখায় ভাষার প্রতি এমন বিশেষণ বা অভিধা আরোপ করা হয়ে থাকে। ভাষানীতি বিদ্যায় ভাষার উপর রাষ্ট্র, জাতীয়, প্রাদেশিক ও দাপ্তরিক ইত্যাদি শব্দ আরোপ করে রাষ্ট্র ভাষা, জাতীয় ভাষা, প্রাদেশিক ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা ইত্যাদি বিশেষায়িত ভাষারূপকে বর্ণনার জন্য গ্রহণ করা হয়।

অন্যদিকে ভাষা আয়ত্ত্বকরণ বিদ্যায় ভাষার উপর মাতৃ, প্রথম, দ্বিতীয় ও আন্ত: ইত্যাদি শব্দ আরোপ করে মাতৃভাষা, প্রথম ভাষা, দ্বিতী ভাষা ও আন্ত:ভাষা ইত্যাদি ভাষারূপকে বর্ণনার জন্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে। অপরপক্ষে ইন্দোআর্য ভাষাবিজ্ঞানে কালানুক্রমিক রূপান্তরের ধারায় সৃষ্ট ভাষারূপকে বুঝাতে সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ ও অবহটঠ ইত্যাদি পরিভাষা সৃষ্টি করা হয়েছে।     

লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।