কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাদর্শন
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) একাধারে কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, সাংবাদিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বাংলা সাহিত্যে তাঁর দীপ্ত আবির্ভাব। উপনিবেশিত ভারতবর্ষের শৃঙ্খলিত সমাজ প্রবাহে তিনি দেখা দেন বিপ্লবীর ভূমিকায়। স্বীয় লেখনীকে তিনি পরিচালনা করেন যাবতীয় অসত্য, অন্যায়, অকল্যাণ, অমঙ্গল ও সাম্প্রদায়িক-সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে।
তিনি কেবল লেখনী পরিচালনা করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, সক্রিয়ভাবে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী ও সংগ্রামশীল রাজনীতি, সংগঠন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রযুগে জন্মগ্রহণ ও সাহিত্য রচনা করেও তিনি সর্বাধিক আলোচিত, জনপ্রিয় ও বিতর্কিত এবং স্বীয় সৃষ্টি বৈচিত্র্যের এক স্বতন্ত্র উত্তরাধিকার নির্মাণে সক্ষম সাহিত্যিক-ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) পরেই স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে স্বল্প পরিধি-সম্পন্ন হলেও তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বহুমুখী প্রতিভার একটি বলয় নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।
পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ রচনা করছেন এবং কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে বিভিন্ন স্থানে অভিভাষণ প্রদান করেছেন। সে সকল প্রবন্ধ ও অভিভাষণে প্রকাশিত হয়েছে শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা যা শিক্ষা বিষয়ে তাঁর নিজস্ব দর্শনকে প্রকাশ করে। সেখানে তিনি ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষালয় ও স্বদেশি শিক্ষার কথা বলেছেন। ঔপনিবেশিক প্রতিকূল পরিবেশ-প্রতিবেশে স্বীয় জীবৎকাল অতিবাহিত করলেও তিনি ছিলেন আপাদমস্তক উপনিবেশবিরোধী।
কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাদর্শন সম্পর্কিত অধিকাংশ প্রবন্ধই প্রকাশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সংঘটিত অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের পটভূমিতে। তবে এই শিক্ষাদর্শনের মূল প্রোথিত রয়েছে বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী স্বদেশি আন্দোলনকালে। তাঁর শিক্ষাদর্শনের মূলসূত্র অন্বেষণের সুবিধার্থে শিক্ষাক্ষেত্রে স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যক বলে বিবেচনা করি।
স্বদেশি আন্দোলন শিক্ষা, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করলে কতিপয় জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্র গঠন, মানসিক শক্তির বিকাশ, জাতীয় ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন ও দেশীয় অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞানদান ছাড়াও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বল্পকালের মধ্যেই এই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন সমগ্র ভারতে বিস্তার লাভ করে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে। ১৯০৬ সালের ১৪ আগস্ট রাসবিহারী ঘোষ এর সভাপতিত্বে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ National Council of education ও Society for the Promotion of Technical Education (S.P.T.E) গঠিত হয়।
এই পরিষদদ্বয় মাতৃভাষার মাধ্যমে সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার সুপারিশ করে এবং কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। প্রতিষ্ঠান দুটি পৃথক হলেও উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল একই; তা হলো ঔপনিবেশিক শক্তির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানচর্চা। শিক্ষাক্ষেত্রে এ জাতীয় ভাবনা ছিল স্পষ্টতই পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথে দৃপ্ত পদক্ষেপ।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মোট প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ চারটি। প্রকাশিত এই চারটি প্রবন্ধগ্রন্থের প্রবন্ধসহ বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় তাঁর যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, সব মিলিয়ে মোট প্রবন্ধের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫টির অধিক। এছাড়া রয়েছে রাজবন্দির জবানবন্দি নামে একটি ভাষণ, ২২টি অভিভাষণ, ০৯টির অধিক ভূমিকা ও গ্রন্থালোচনা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ যুগ-বাণী (১৯২২)। তাঁর প্রকাশিত অপর প্রবন্ধগ্রন্থ তিনটি হল : দুর্দিনের যাত্রী (১৬২৬), রুদ্রমঙ্গল (১৯২৭) ও ধূমকেতু (১৯৬১)। যুগ-বাণী প্রবন্ধ-গ্রন্থে মোট প্রবন্ধের সংখ্যা একুশ।
গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধসমূহ বিষয় ও বক্তব্য বিচারে সমকালের জীবন-প্রতিবেশের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে শাশ্বত আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। উক্ত গ্রন্থের জাতীয় শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সত্য শিক্ষা প্রবন্ধে তাঁর শিক্ষা চিন্তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি তাঁর এসব চিন্তার বাস্তব পরিসমাপ্তি ঘটেছে ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন সার্বভৌম ভারতবর্ষ পত্তনের মধ্য দিয়ে।
কাজী নজরুল ইসলাম একটি উপনিবেশিত দেশের অধিবাসী হয়েও আদ্যোপান্ত ছিলেন উপনিবেশবিরোধী। অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের বাস্তব পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি উপনিবেশমুক্ত স্বাধীন স্বদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে বিদেশি পণ্য ও বিদেশিদের সঙ্গ পরিত্যাগ করার যে পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল, তার প্রতি নজরুল ইসলামের সমর্থন থাকলেও আন্দোলনের সামগ্রিক কর্মসূচির প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল না। এসময়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের গণ্ডিমুক্ত করার প্রয়াস ছিল। তিনি স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারেননি।
তবে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবকে কাটিয়ে জাতীয় বিশেষত্ব বহুল শিক্ষা ও সংস্কৃতি-চর্চার পথ উন্মুক্তকরণে তাঁর চিন্তা ও সর্বাত্মক প্রয়াস কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সরকারি বিদ্যালয়ে প্রচলিত বিজাতীয় পাঠক্রম বর্জন করে, জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশীয় জীবন-পদ্ধতি এবং সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পৃক্ত পাঠদান কর্মসূচির প্রতিই তাঁর সমর্থন ছিল। সরকারি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তাও তিনি অনুভব করেছেন। আর এর সফল বাস্তবায়নের জন্য জনমানুষের সর্বাত্মক ও সম্মিলিত সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা তাঁর একান্ত কাম্য ছিল। কেবল ঝোঁকের বশে, উদ্দেশ্যবিহীন ও বিশেষত্বহীন প্রতিষ্ঠান গঠনের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর অবস্থান।
স্বদেশি ও অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ গৃহীত হয়, তাতে নজরুল ইসলাম সর্বৈব সমর্থন প্রদান করেননি। কারণ তিনি মনে করতেন, শুধু আন্দোলনের সমর্থনে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। জাতীয় জীবনের প্রয়োজনে অনেক আগেই এ ধরনের উদ্যোগ গৃহীত হওয়া উচিত ছিল বলে তিনি মনে করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কেবল আন্দোলনের প্রয়োজনে ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজাতীয় শিক্ষা গ্রহণের বিরুদ্ধে সাময়িক আন্দোলন না করে দেশ ও জাতিকে দীর্ঘমেয়াদে ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত রাখার জন্য ও ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গি-রুচি’র প্রভাবমুক্ত জাতি গড়ে তোলার জন্য আমাদের এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত। তাঁর এ জাতীয় চিন্তাভাবনা অবশ্যই তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচয় বহন করে।
কাজী নজরুল ইসলাম মনে করেন, দেশীয় ইতিহাস ঐতিহ্য ও সৃষ্টিশীলতা-চর্চার পরিবর্তে বিজাতীয়-বিদ্যার অন্ধ অনুকরণে এবং তা থেকে লব্ধজ্ঞান দেশীয় ঐতিহ্যকে অপসারিত করে এবং নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে ব্যক্তির রুচি-পছন্দ ও মানসিকতার যোগ সৃষ্টিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ বিবেচনা না করে বিজাতীয় শিক্ষাকে গ্রহণ করা, নিজস্ব শিক্ষার চিরায়ত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার শামিল। আর এ জাতীয় শিক্ষা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ব ও মনীষারই চরম অবমাননা।
তাই এই পাশ্চাত্য-প্রভাব বর্জনের দিনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের কালে নজরুল ইসলামের প্রত্যাশা শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা কেবল বাহিরে না হয়ে অন্তরেও যেন হয়। আজকের কিশোর ও তরুণ দল— যারা এ দেশের আগামী দিনের কর্ণধার তারা যেন দেশীয় শিক্ষাটা পাই। দেশের সাথে যেন তাদের নাড়ির যোগ তৈরি হয়। কাজী নজরুল ইসলামের প্রত্যাশা আমরা যেন হুজুগে মাতাল না হয়ে, গলাবাজি করে স্টেজ না ফাটিয়ে ভাব ও কাজর মধ্যে সমন্বয় সাধন করি। ভাবের স্রোতে ভসে গিয়ে আমরা যেন কর্তব্যকে, উচিত-অনুচিতকে ভুলে না যায়।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, দেশীয় উপাদানবহুল শিক্ষা যেভাবে জাতীয় চরিত্রের রূপগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে, চাপিয়ে দেয়া বিজাতীয় শিক্ষা সেভাবে জাতীয় চরিত্রের রূপগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। স্বদেশের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনা সম্পৃক্ত শিক্ষার সংস্পর্শেই ব্যক্তির সুপ্ত-প্রেরণা নির্ভীক স্পর্ধায় জেগে ওঠে; পক্ষান্তরে বিজাতীয় শিক্ষায় মানুষের আত্মসুখ ও আত্মপ্রেরণা নির্জীব হয়ে যায়। তিনি মনে করতেন, সর্বপ্রথম আমাদের সেই ধরনের শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যাতে থাকবে দেশের মাটির গন্ধ ও বীরদের বীরত্বের বিজয়গাথা। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় স্বদেশের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি কিশোর ও তরুণদের হৃদয়ে জ্বেলে দিতে পারে মহাশিক্ষার আলোকবর্তিকা।
নজরুল ইসলাম শুধু জ্ঞানার্জনের নামে শিক্ষাগ্রহণ-এর পক্ষপাতী ছিলেন না। বস্তুত, বিজাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির অন্ধ-অনুকরণ ও অপপ্রয়োগের ফলে দেশীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে শিক্ষার যে সম্পর্কচ্যুতি, সেই সম্পর্কচ্যুতিকে রোধ করে দেশীয় অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে তার যোগসূত্র স্থাপনই তাঁর শিক্ষাভাবনার মূল প্রতিপাদ্য
নজরুল ইসলাম গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও প্রত্যয়কে দেশি ঐতিহ্যের পরিসীমা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আর নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত শিক্ষার দ্বারা মানুষের জীবনের অভ্যন্তর ও বাহ্যিক মুক্তি অলস ও অকেজো হতে বাধ্য। তাই তিনি প্রথমেই দেশের মাটি ও মানুষ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পৃক্ত শিক্ষা প্রবর্তনের প্রয়োজন উপলব্ধি করেছেন। তবে দেশীয় জীবনপদ্ধতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শিক্ষা তাঁর পরম কাঙ্ক্ষিত হলেও বিদেশি শিক্ষাকে ঢালাওভাবে বর্জনের পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিংবা দেশীয় চেতনা বা বোধের পরিপন্থি নয়, এমন ধরনের বিদেশি শিক্ষা উপাদান তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। যেটুকু প্রয়োজনীয় ও গ্রহণযোগ্য তা দেশি হোক বা বিদেশি ভাল-মন্দ জ্ঞান-এর কষ্টিপাথরে তাকে যথার্থরূপে যাচাই করে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রত্যাশা করেছেন বিদেশি শিক্ষার প্রভাব মুক্ত এবং স্বদেশ-সংস্কৃতির প্রতি চিন্তাশীল, সৃজনশীল ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান মানুষ। কারণ তিনি জানতেন, দেশীয় শিক্ষা-ইতিহাস-সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে জাতিসত্তার মৌল, উপাদান, বীরত্ব ও বিজয়গাথা। জাতিসত্তা-সম্পৃক্ত শিক্ষাকেই তিনি প্রকৃত শিক্ষা মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতিসত্তার বোধশূন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে জাতীয় জীবনের সার্বিক কল্যাণ সাধন অসম্ভব। সার্বিক জাতীয় কল্যাণের জন্য জাতীয় ঐতিহ্যের গর্বে উজ্জীবিত তরুণ ও যুবকদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ঈদ-সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণেও তিনি একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।
স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) কালে প্রচলিত বিলেতি শিক্ষার শুধু উপরিকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নব-প্রস্তাবিত জাতীয় বিদ্যালয়ে সেই শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থায় খুবই সামান্য দেশীয় উপাদান উপকরণ ছিল, বেশির ভাগই ছিল বিলাতি উপকরণ। পরবর্তীতে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনকালে আবারও জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এদেশীয়দের পুনর্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল ইসলাম নব প্রস্তাবিত শিক্ষার স্বরূপ সম্পর্কে ভাবিত হয়েছেন। এ থেকে বুঝা যায়, একান্তভাবেই দেশীয় মানসিকতা, আবহাওয়া ও উপাদান সম্পৃক্ত শিক্ষাই কাজী নজরুল ইসলামের কাঙ্ক্ষিত। এই শিক্ষা একটি জাতির সম্পূর্ণ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার গড়া শিক্ষা; কোনো বিলেতি-চিন্তা ও কর্মের উপর নতুন করে লাগানো চাকচিক্যময় প্রলেপ সর্বস্ব শিক্ষা নয়।
শুধু স্বদেশি-শিক্ষা প্রবর্তনের মধ্যেই নজরুল ইসলামের শিক্ষা ভাবনা সীমিত থাকেনি। তিনি এই প্রয়াসকে সঠিকরূপে বাস্তবায়নের জন্য যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেছিলেন। কিন্তু স্বজনপ্রীতিমূলক শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতিতে নব প্রবর্তিত শিক্ষা ও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব নব প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার সকল কল্যাণকর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় যে ধস নামাবে এ জাতীয় ভাবনা নজরুল ইসলামের দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায়নি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতার মধ্যে আন্তরিক সম্পর্কের প্রতিও তিনি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
লেখখ: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ