ভারতের নির্বাচনে মমতা কী মোদির পক্ষে না বিপক্ষে?
ভারতের রাজ্য রাজনীতিতে মোদি বিরোধী অন্যতম প্রধান মুখ বনে যাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড জনগণের মাঝে প্রশ্নের অবতারণা ঘটাচ্ছে। আসলেই কী মমতা মোদি বিরোধী? নাকি ভোটের ময়দানে পোড় খাওয়া মেঠো রাজনৈতিক কুশলী। বিশ্লেষকদের মতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ধরনের ভোলবদল নিঃসন্দেহে জাতীয় রাজনীতিতে আদর্শের জায়গাকে অনেকটাই দুর্বল করবে।
গণতান্ত্রিক ধারা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক আদর্শ হচ্ছে মূল মাপকাঠি। বিহারের নিতেশ কুমারের মতো ঘোড়া বেচা কেনার সস্তা রাজনীতিতে কী নাম লেখালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি নিছক মাঠের রেফারি হতে চাচ্ছেন? নির্বাচনের ফলাফলই হয়ত প্রকাশ করবে মমতার ভূত ভবিষ্যৎ। সাম্প্রতিক সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রচার মঞ্চে বিভিন্ন ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ উক্তি জনগণের মধ্যে এক ধরনের দোলাচলের সৃষ্টি করছে।
যেমন মোদি এবার ২০০ এর কম আসন পাবে কিংবা কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের জোটসঙ্গী হবে কিন্তু তৃণমূলের কেউ মন্ত্রী হবেন না। অনেক বিরোধীরা মনে করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলো বিজেপির ‘বি’ টিম। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মোদির টিমকে ভোট কাটাকাটি করে সহযোগিতা করতে যে দলগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তাদের মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। নেত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে মমতার যে ধরনের রাজনৈতিক উত্থান হয়েছে, জাতীয় স্তরে কি সে ভাবে পৌঁছাতে পেরেছে তা কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়।
বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত তাদের সাতটি ধাপে ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে যাচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও কৃষ্টিগত অনেক মিল রয়েছে। সেই হিসেবে ভারতের নির্বাচনকে ঘিরে যেমন আগ্রহ আছে তেমনি পশ্চিমবঙ্গে কে সরকার গঠন করছে তা নিয়েও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে আমাদের। সে আগ্রহের পারদ অনেকটুকু বাড়িয়ে দেয় যখন নেপথ্যে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
তার রাজনৈতিক উত্থান বামদের বিরোধিতায় হলেও চড়াই উতরাই পেরিয়ে তিনি নিজে তৈরি করেন তৃণমূল কংগ্রেস নামে একটি দল। একসময় তিনি বিজেপির বাজপেয়ী সরকারের রেলমন্ত্রী ও ছিলেন। এরপর তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। পূর্বে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক থাকলেও বর্তমান কেন্দ্রীয় বিজেপির সাথে রসায়ন অনেকটা উইন উইন পরিস্থিতির মধ্যে আছে। কেন্দ্রীয় বিজেপির সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক অহি নুকুল সমান। এর নেতৃত্বে আছেন তৃণমূল কংগ্রেস হতে দলবদলু নেতা শুভেন্দু অধিকারী।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপির সভাপতি ড. সুকান্ত মজুমদার ও শুভেন্দু অধিকারীর নিগূঢ় রসায়নে অনেকটা ব্যাক ফুটে তৃণমূল। কেন্দ্রে সুললিত পারস্পরিক বোঝাপড়া দেখালেও রাজ্যে অনেকটা ফ্যাকাশে। কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে ৪২ এ ৩২ টি আসনের টার্গেট যা বঙ্গ বিজেপিকে অনেকখানি চাঙ্গা করেছে। মমতার ৪২ এ ৪২ পাওয়ার নিদানে ভেজাল দেখছেন অনেকেই। উপরন্তু মমতার উত্তরসূরি হিসেবে দলে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রতিষ্ঠা করলেও খোদ দলের মধ্যে রয়েছে বিস্তর আপত্তি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড হওয়ার পেছনে রয়েছে মমতার পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক কৌশল।
ভারতের ১৮তম সাধারণ লোকসভা নির্বাচনে যদি তৃণমূল কংগ্রেস খারাপ ফলাফল করে তার দায়ভার নিতে হবে কিন্তু কথিত এই যুবরাজকে। তৃণমূল কংগ্রেস দলে অভিষেকের নিয়ন্ত্রণ কর্তা হিসাবে অধিষ্ঠান যা পুরাতন অনেক তৃণমূল কর্মীদের মনঃক্ষুণ্ন করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের রাজনীতিটি ভালো করে বুঝেন। বিরোধীদের অভিযোগ তিনি ভোটব্যাংকের রাজনীতি করেন। রাজনীতির ক্ষমতায় টিকে থাকতে, তিনি সাম্যবস্থা রাজনৈতিক বলয়ে থাকতে চান বারংবার। তাই কখনো এন ডি এ জোট কিংবা ইন্ডিয়া জোটের নৌকার পালে ভাসতে চান তিনি। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যে কোনো মুহূর্তে সমীকরণ পরিবর্তন হতে পারে। তবে নিগূঢ় পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব তারা নিজেরাই ডেকে আনছে। ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব থেকেও জোট সরকারে শামিল না হওয়া তৃণমূলের চাতুর্য ছাড়া আর কিছুই না।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক