যুগে যুগে বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার: বিচিত্র জীবনের অধিকারী লর্ড ক্লাইভই শ্রেষ্ঠ
স্বাধীনতার (১৯৭১) পরের অর্থবছর থেকে বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়ার এক হিসাব তুলে ধরেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। প্রায় শেষ হওয়া ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বিকল্প বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনকালে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত এত বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে বলে দাবি করেন। পাচারকৃত এই টাকায় বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন বেগম পাড়া, পাঁচতারা হোটেল, মল, মার্কেট, ইত্যাদি। কানাডা, সিঙ্গাপুর, দুবাই, আবুধাবি, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ বিশ্বের নামিদামি শহর ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকে এ সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জমিয়েছেন বাংলাদেশের উঁচু শ্রেণীর কিছু নাগরিক। এ সকল সম্পদ সৃষ্টিতে কত টাকা তারা পাচার করেছেন?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক জানাচ্ছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এক লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। ইউএনডিপি জানাচ্ছে, অবৈধ পুঁজি পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষে। তাঁদের জন্যে মালয়েশীয় সরকার ২০০২ সাল থেকে ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি চালু করেছে। ২০০২ থেকে ২০১০ সাল অবধি কমপক্ষে এক হাজার ৮৬২ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় নাগরিকত্ব কিনেছেন (ডেইলি স্টার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২)। গত বছরের হিসাবে তাঁরা প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় নিয়ে গেছেন। এভাবে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ ধনী বিশ্বের অংশ হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক ধনী পরিবার। বিশেষত, বিগত জরুরি অবস্থার সময়ে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পর দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা ধনিকশ্রেণীর অনেকে একটা শিক্ষা নিয়েছেন: টাকা আর পরিবার দেশে রাখা যাবে না। বিশ্বের বহু দেশেই এভাবে ছড়িয়ে আছে তাঁদের সেকেন্ড হোম। বিশেষ করে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ই টাকা পাচার বেড়ে যায় বলে ইউএনডিপির সমীক্ষায় দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার সমান। তারা আরো উল্লেখ করে যে, ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার হয়েছিল। পাচারকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ। অপরদিকে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার তথ্য প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ. বি. মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এর মতে, সুইস ব্যাংক আমানতের যে তথ্য প্রকাশ করছে, সেটি পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ মাত্র।
সম্পদ পাচার ছাড়াও সম্পদ/টাকা আত্মসাতের আর একটি অপকৌশল হল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা যথানিয়মে ফেরত না দিয়ে ঋণখেলাপি বনে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৯ সালে দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। তারও এক দশক আগে ১৯৯০ সালে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গত মে মাসে জানিয়েছিল বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ আরও বেশি, প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার মতো। (সূত্রঃ (প্রথম আলো, ২৫ মে ২০১৩, ইত্তেফাক, ২৯ জানু ২০১৯, বিবিসি, ১২ ফেব্রু... ২০২০, বণিক বার্তা, ১১ এপ্রিল ২০২২, দুরবীণ নিউজ, ২৩ জানু ২০২৩) ।
বিদেশে টাকা পাচার ও ঋণখেলাপির যে চিত্র পাওয়া গেল তা একটি স্বল্পোন্নত (উন্নয়নশীল হওয়ার চেষ্টায় সংগ্রামরত) দেশের জন্যে কতটা ভয়াবহ তা বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন যে কোন মানুষের পক্ষে বুঝা কঠিন কিছু নয়।
এ তো গেল বাংলাদেশের স্থায়ী, প্রতিষ্ঠিত, গণ্যমান্য ব্যক্তি বলে পরিচিত নাগরিকদের দেশের সম্পদ অন্যায় ও বেআইনিভাবে বিদেশে পাচারের কাহিনী। কিন্তু ভিনদেশি দখলদার/আক্রমণকারী যারা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ শাসন করেছে তারাও এ দেশের সম্পদ কম লুঠ/পাচার করেনি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুদূর অতীতকাল থেকে বাংলাদেশ বিদেশি শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। ইংরেজ আমলের আগে বাংলা শাসন করেছে মোগল, তার আগে লোদী, সৈয়দ, তুগলক, খিলজি, মামলুক, এবং তারও আগে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজিই প্রথম বিদেশি আক্রমণকারী/দখলদার হিসাবে বাংলা দখল করেন এবং শাসন করেন। এদের সবাই কিন্তু বহিরাগত। বিদেশী বহিরাগত এ সকল শাসকরা কেউ কেউ এ দেশে স্থায়ী হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন আবার অনেকে নিজ দেশে বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছেন। তবে তারা যা নিয়েছেন তা খাজনা বা করের আকারে। এই কর দিতে গিয়ে বাংলার মানুষকে অপরিমেয় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে যুগের পর যুগ।
এই কর আদায়ের অত্যাচার দেশীয় শাসক হিন্দু জমিদাররাও বাংলাদেশি প্রজাদের উপর কম করেনি। সে আর এক বিরাট কাহিনী! সর্বশেষ বিদেশি শাসক ইংরেজ। ব্যবসার নামে তারা এ দেশে এসে শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন সম্রাট নওয়াব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ ভারতবর্ষ শাসন করে এবং এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজ দেশে পাচার করে। সে কাহিনীই এখানে বলার চেষ্টা করবো।
ভারতবর্ষে বৃটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ হচ্ছেন রবার্ট (লর্ড) ক্লাইভ। ১৭৪৩ সালে ১৮ বছর বয়সে ক্লাইভ লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ অফিসে ক্লার্ক-কাম বুক কিপার পদে যোগদান করেন। বছর দুই এই পদে চাকরি করে ১ম কার্ণাটিক যুদ্ধ (স্পেন, ফ্রান্স, সুইডেন, ব্রাভিয়া বনাম ইংল্যান্ড ও ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্র) শুরুর সময় ১৭৪৬ সালে ক্লাইভ বৃটিশ সেনা বাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। সে সময় দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ফ্রান্স ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য ছোটখাট লড়াই চলছিল। ক্লাইভ বৃটিশদের পক্ষে সে সকল লড়াই এ পারঙ্গমতা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কোম্পানির কর্ণধারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন । ফলত ১৯৪৯ সালে ক্লাইভ ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
লর্ড ক্লাইভ’র (২৯ সেপ্টেম্বর ১৭২৫ – ২২ নভেম্বর ১৭৭৪) নাম এ দেশবাসী প্রায় সবাই কম বেশী জানেন। তাঁর মূল পরিচয় হচ্ছে, তিনি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গোড়া পত্তনকারী । ভারতে প্রথম ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ। ব্রিটিশ সরকার ক্লাইভ কে দুই দুই বার ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গভর্নর নিয়োগ করেন (১৭৫৫ - ১৭৬০ এবং ১৭৬৪ - ১৭৬৭)। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার, ঊড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করে তিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিলেন । ব্রিটেনে তিনি ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া নামে পরিচিত।
ক্লাইভ দশ বছরেরও অধিক সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে ভারতবর্ষ শাসন করেন। এ সময়ের মধ্যে ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধসহ প্রায় ৯/১০টি যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং অপরিমেয় জান-মালের ক্ষতি করে জয়লাভ করেন। এ জন্যে অবশ্য ইতিহাসে ক্লাইভ বীর বলেই খ্যাত – যুদ্ধাপরাধী হিসাবে নয়। এমন কি ভারতবাসীও ক্লাইভকে যুদ্ধাপরাধী/ দখলদার হিসাবে চিহ্নিত করেন না। ভারতবাসী অনেক উদার, মহৎ। তা না হলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হরণকারী লর্ড ক্লাইভ’র নামে এখনও তাদের দেশে রাস্তা থাকে, সদর্পে দাঁড়িয়ে থাকে ক্লাইভ’র আপাদমস্তক মূর্তি? ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী’র প্রায় কেন্দ্রস্থলে একটি এভিনিউ’র নাম ‘ক্লাইভ স্কয়ার (অনেক আলোচনা-সমালোচনার পরে ক্লাইভ স্কয়ারকে ‘নেতাজি সুভাস রোড বলা হচ্ছে)’।
এদিকে নূতন কলকাতা’র ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’র প্রবেশদ্বারে ক্লাইভ’র বিরাটকায় এক মূর্তি সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে আজও। অথচ লন্ডনের রাস্তা থেকে ক্লাইভ’র মূর্তি অপসারণের আন্দোলন হয়েছে অনেক আগেই। লেখালেখি হয়েছে গার্ডিয়ান পত্রিকা, বিবিসি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে! কিন্তু কেন? ক্লাইভ কি আসলেই বিতর্কিত ব্যক্তি?
ক্লাইভ’র জন্ম ইংল্যান্ড’র শ্রেসবারি এলাকায়। শৈশবে নিজ এলাকায় বখাটে, ডানপিটে বলে পরিচিত ছিলেন ক্লাইভ । বেশ কয়েকটি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরিবার ব্রিটেনে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাঁদের পরিবারের ছেলে ক্লাইভ যে কোন কারণেই হোক লেখাপড়ায় আশানুরূপ ফলাফল করতে না পারায় সবাই ছিলেন হতাশ। এদিকে এই বখাটে, ডানপিটে ছেলে ইতোমধ্যে পরিবারের সুনাম নষ্টকারী দুই একটি কাজও করে ফেলেছে। ঠিক এ সময়েই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি পাওয়া গেল। ১৭৪৩ সালে ১৮ বছর বয়সে ক্লাইভ লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ অফিসে ক্লার্ক কাম বুক কিপার পদে যোগদান করেন – একথা আগেই বলা হয়েছে। ১৭৫৩ সালে মার্গারেট মায়স্কালিন –এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । তাদের ঔরসে ৯টি সন্তান জন্মেছিল। ইতোমধ্যে দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের খবর ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় ক্লাইভ’র সম্মানে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় ব্রিটেন’র দুই দুই বার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ক্লাইভ’র প্রশংসা করে বক্তৃতা করেন। তাতে পিট ক্লাইভ কে “স্রষ্টা প্রেরিত জেনারেল” বলে অভিহিত করেন।
অতঃপর ১৭৫৫ সালে ক্লাইভ গভর্নর হিসেবে পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত দৃঢ়তর করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ দৌলা’র সাথে সংঘটিত ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ উদ দৌলা কে পরাজিত করে ক্লাইভ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পথ কণ্টকমুক্ত করেন এবং বাল্যকালের “বখাটে বালক’ উপাধি ভুলিয়ে ব্রিটেনবাসীর নিকট নিজেকে ‘ অবতার’র ভূমিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন । এতে ক্লাইভ’র আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়ে যায় যে, তার অতীত ভুলে তিনি তার এলাকায় (শ্রেশবারি) পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন । প্রথমবার পরাজিত হলেও দ্বিতীয়বার (১৭৬০) বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন । এ ছাড়া ১৭৬২ – ৬৩ সালে তাঁর নিজ এলাকা শ্রেসবারির মেয়রও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তনকারী এবং দুই দুই বারের গভর্নর পদপ্রাপ্তির বিনিময়ে ক্লাইভ ব্রিটেনবাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসাই কুড়িয়েছেন তাই নয়, নিজের ভাগ্যকেও সুপ্রসন্ন করেছিলেন। প্রায় খালি হাতে পরিবার এবং সমাজের নিকট অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য যে ক্লাইভ ভারতের মাদ্রাজ এসে জাহাজ থেকে নেমেছিলেন এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লার্ক হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন মাত্র ২৫-২৬ বছরের ব্যবধানে তিনিই হতে পেরেছিলেন ব্রিটেন’র অন্যতম প্রশংসিত ব্যক্তি। প্রায় কপর্দকশূন্য ক্লাইভ অর্থসম্পদেও হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটেনের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সম্পদের পরিমাণ তখন নগদ প্রায় ১,৮০,০০০ পাউন্ড (বর্তমান হিসাবে ২,৪৭,০০০০০ পাউন্ড)। এ ছাড়া ভারত থেকে লুট করা হীরা, মণিমাণিক্য, সোনা, গহনা, ইত্যাদি সহ বিপুল সম্পদের মালিক ক্লাইভ। বর্তমান টাকার হিসাবে ক্লাইভ’র সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার কোটি টাকার উপর। ক্লাইভ’র পরে যারা গভর্নর জেনারেল হয়ে এ দেশ শাসন করেছে তারা কেউই অর্থ/সম্পদ পাচার থেকে পিছপা হননি। রমেশ দত্ত তার, ‘ইন্ডিয়া ইন দ্যা ভিক্টোরিয়ান এইজ’ শীর্ষক বই এ ১৮৩৫ – ১৮৭২ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে যে পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে তার একটি বার্ষিক গড় হিসাব তুলে ধরেছেন। হিসাবটি এরকমঃ
ইংরেজ শাসকরা ১৮৩৫–১৮৪৪ সালে ১১ লক্ষ পাউন্ড, ১৮৪৫–১৮৫৯ সালে ১৫.৫০ লক্ষ পাউন্ড, ১৮৬০-১৮৬৪ সালে ৩৫ লক্ষ পউন্ড, ১৮৬৫-৬৯ সালে ৫০ লক্ষ পউন্ড এবং ১৮৭০–১৮৭২ সালে ৯১ লক্ষ পাউন্ড পাচার করেছে (সূত্রঃ কে টি হোসেন, সিপাহী বিপ্লবের অর্থনৈতিক পটভূমি। শতাব্দী পরিক্রমা সংকলন, ঢাকা, ১৯৭৪। পৃ ৫১) ।
যাই হোক, এত সম্মান, এত সম্পদ এবং ৯ সন্তানের পরিবার থাকার পরও ক্লাইভ –এর জীবনে এমন কি অপ্রাপ্তি ছিল – যার ফলে তিনি আত্মহত্যা করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন?
১৭৬৭ সালের দিকে ভারত এবং ব্রিটেনে সদা স্মরণীয় ক্লাইভ যখন ভারত শাসনের পাঠ চুকিয়ে ব্রিটেনে ফিরে গেলেন তখন থেকে শুরু হয় ক্লাইভ’র জীবনের তৃতীয় এবং শেষ অধ্যায়। এই অধ্যায়টি অতি করুণ, অতি নিষ্ঠুর কিন্তু শিক্ষণীয়। ক্লাইভ’র ব্রিটেনে ফেরার কিছুদিন আগে থেকেই লন্ডন ও দিল্লী-কলকাতা’র কতিপয় সংবাদপত্র ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও এর সর্বশেষ গভর্নর এর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফিরস্তিসহ প্রতিবেদন বের হতে থাকে। যেসব খ্যাতনামা লেখক ও সাংবাদিক তখনকার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ক্লাইভ সহ এর বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রামাণভিত্তিক অভিযোগ লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন – হোরেস ওয়ালপোল, বারসেল ডেভিড, উইলিয়াম ডাল রিম্পল, স্যামুয়েল জন্সন, ব্রুস মেলসন, স্যার উইলিয়াম ফর উড এবং বিখ্যাত ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। যে সকল কাগজ ক্লাইভ’র অপকর্ম ফাঁস করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সেগুলোর মধ্যে লন্ডনের গার্ডিয়ান ও দি নিউজ ইন্টারন্যাশনাল অন্যতম।
ক্লাইভ’র পরে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন লর্ড হ্যানরি ভান্সিটার্ট । ক্লাইভ’র ভারত ত্যাগের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের নিকট কোম্পানি ও ভারতবর্ষকে ক্লাইভ’র সীমাহীন দুর্নীতির দরুন প্রায় দেওউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করার আহবান জানায়। জনস্বার্থবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি পার্লামেন্টে উঠে এবং ভারতবর্ষের এই দুরবস্থার জন্যে ক্লাইভ কে দায়ী করা হয়। পার্লামেন্ট কমিটিতে প্রায় ২ বছর ক্লাইভ’র বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত চলে এবং ক্লাইভকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে বিশেষ বিবেচনায় ক্লাইভ কে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও এই দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া তাঁর দেহ ও মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অনেকে মনে করেন, এ কারণেই অপ্রকৃতিস্থ ক্লাইভ গভীর আত্মশ্লাঘায় ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর মাত্র ৪৯ বছর বয়সে নিজ গলায় নিজে ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক স্যামুয়াল জনসন ক্লাইভ’র মৃত্যুর পর এক প্রতিবেদনে লিখেন, “১৭৭৪ সালে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ক্লাইভ নিজের গলায় নিজে ছুড়ি চালিয়ে যখন নিজেকে হত্যা করেছিলেন তখন তিনি ব্রিটেনের সর্বস্তরের জনগণের নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। মৃত্যুর পর তাঁকে রাতের অন্ধকারে কোন এক অজানা সিমেট্রিতে, নামফলকহীন কবরে কবরস্থ করা হয়”।
জনসন আরও বলেন, “ক্লাইভ যদিও কোন সুইসাইড নোট রেখে যান নি তবে অনুমান করা যায় যে, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিকভাবে ভারত থেকে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন তা যখন ব্রিটিশ সরকার এবং জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়ে গেল তখন তীব্র অপরাধবোধ থেকেই তিনি তাঁর নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন”। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রীষ্মকালে লন্ডনে একটি কৌতুক বের হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, “একজন লর্ড শকুন (লর্ড ক্লাইভ) যে মৃত ভারতীয়দের হাড্ডি কুঁড়িয়েছে”। [The Lord Vulture picking the bones of the Indian dead]. ক্লাইভ সম্পর্কে আরও বলা হয়, জীবিতাবস্থায় ক্লাইভ ছিলেন ‘অপ্রকৃতিস্থ সাম্রাজ্যবাদী এক দানব’। মানবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি যার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না এবং সে ছিল সীমাহীন লোভী। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এমন একজন ঘৃণিত ব্যক্তির মূর্তি স্থাপনের বিষয় বিবেকবান কোন লোক কল্পনাই করতে পারে না - বলেছেন উইলিয়াম ডালরিমপল। তিনি আরও বলেন, “আমি মনে করি তাঁর মূর্তিগুলো সরানো উচিত। তিনি একজন দুষ্ট এবং নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন। তার মূর্তিগুলো নামিয়ে যাদুঘরে রাখা উচিত এবং ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুকর্ম সম্বন্ধে বৃটিশদের শিক্ষা দেয়া উচিত (The anarchy: the relentless rise of East India Company, by Dalrymple, William)।
ক্লাইভ’র মূর্তি অপসারণের এই বিতর্ক আজও থেমে নেই। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক নিক রবিন্স EIC: The corporation that changed the world শীর্ষক এক নিবন্ধে এই মত ব্যক্ত করেন যে, “ ক্লাইভ’র মূর্তিগুলো নামিয়ে মিউজিয়ামে রাখা দরকার( Hindustan Times, dated: 20 July 2020).’। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ক্যাম্পেইন’ নামীয় মানবাধিকার গ্রুপটি হালে ক্লাইভ’র মূর্তি অপসারণের জন্যে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের তরফে ক্লাইভ’র মূর্তি অপসারণের দাবিতে গণস্বাক্ষর দিয়ে শ্রেসবারি কাউন্সিলে আবেদন দাখিল করা হয়। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্সিলের ডেপুটি লিডার স্টিভ শার্ম লি বলেন, “আজ আমরা আমাদের ইতিহাসের এক বেদনাময়, লজ্জাজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করছি। যেখানে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজেরই কিছু সদস্য অন্য নাগরিকদের উপর অমানবিক আচরণ করেছেন। জুলাই ২০, ২০২০ তারিখে কাউন্সিলে বিষয়টির উপর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং ক্লাইভ’র মূর্তি অপসারন করা হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়”। এ সবের মধ্যে স্যার উইলিয়াম ফরউড “টাইমস পত্রিকায়’ এই মর্মে নিবন্ধ লিখেছেন যে, ক্লাইভ’র মূর্তি অপসারণের আন্দোলন অযৌক্তিক ও অর্থহীন।
ক্লাইভ’র মৃত্যুর পর তাঁর মূর্তি অপসারণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র বাদানুবাদ এবং আন্দোলন শুরু হয়। ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি স্থানে ক্লাইভ’র মূর্তি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে লন্ডন ডাউনিং স্ট্রিটে ফরেন অফিস প্রাঙ্গণে, সিটি অব ওয়েস্ট মিনিস্টারে এবং তাঁর নিজ এলাকা শ্রেসবারিতে ক্লাইভ’র মূর্তি আজও সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়াও ব্রিটেনের বিভিন্ন মিউজিয়ামে ক্লাইভ’র মূর্তি রয়েছে। ভারতের কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর সদর দরজায় ক্লাইভ’র মূর্তি দেদীপ্যমান আজ অব্দি ।
ঈশ্বর প্রেরিত এই জেনারেলের মূর্তি তাঁর দেশে থাকতে পারলেও ভারতবর্ষে থাকা আদৌ যৌক্তিক কিনা ভবিষ্যতই তা নির্ধারন করবে। ক্ষমতা আর ধন – কোনটিই চিরস্থায়ী নয় - এ কথাই চিরসত্য। বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচারকারীরা আজ সমাজের চোখে অসম্মাননীয় না হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের নিয়ে কী ভাববে, কিভাবে তারা চিত্রায়িত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট – সে চিন্তা তাদের আজই করা দরকার। রবার্ট ক্লাইভ’র জীবনেতিহাস সম্পদ পাচারকারীদের জন্যে শিক্ষণীয় হোক।
লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)
ই-মেইল:amatin@aub.ac.bd