অর্থনৈতিক সংকটে কার দায় কতটা?
করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নকে চলমান অর্থনৈতিক অবনতির জন্য দায়ী করা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু বর্তমানে এর কোনোটিই প্রভাবক হিসেবে কাজ না করলেও দেশের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক। প্রতিনিয়তই কমছে রিজার্ভ আর বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। ব্যষ্টিক বা সামষ্টিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ জনগণ। কিন্তু এই অর্থনৈতিক সংকটের দায়ভার কার? রাষ্ট্রের, সরকারের অবিবেচক সিদ্ধান্তের নাকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারী খামখেয়ালিপনার?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং চলমান অর্থনৈতিক সংকট
একটি দেশের অর্থনীতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ভূমিকা রাখে ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে দেশের অর্থনীতিতে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করার কথা বলেন।যার ফলস্বরূপ, ওইসব ব্যাংকের গ্রাহকরা ব্যাপক হারে টাকা তুলে নিতে থাকেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক দুর্বল ঘোষিত হওয়ার পর একটি ব্যাংকের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও ২০২৪ এ এসে আবারও জোরপূর্বক কতিপয় দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলাফল আবারও আগের মতো আতঙ্কে নিজেদের টাকা তুলে নেন আমানতকারীরা।
২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আশ্বাস দেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যেই কেটে যাবে ডলার সংকট।এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও ডলার সংকট কমেনি বরং আরও প্রকট হয়েছে। ডলারের দাম বেড়ে সর্বশেষ ১১০ টাকা থেকে হয়েছে ১১৭ টাকা। রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করে চলতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ২০২২ সালের শেষের দিকেও মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যা এখন কমে দাড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে। যদিও ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান সময়ে চলমান অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, তদারকি না করে কিছু পরিচালককে ব্যাংকগুলো খারাপ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পুরো খাতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক ও কঠোর সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় আজ ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। কাউকে দুর্বল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত নয়। এর চেয়ে সঠিক তদারকির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর উন্নতির দিকে নজর দেওয়া দরকার। জোরপূর্বক একীভূত না করে ব্যাংকগুলোর নিজেদের উদ্যোগে এক হওয়ার সুযোগ রাখা উচিত। কাউকে ধরা, কাউকে ছাড়ার নীতি আর চলতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, ডলারের দাম আরও আগে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সমস্যাটা কেটে যেত। এরপরও সর্বশেষ যা হয়েছে, তা মন্দের ভালো।
সরকারের নেয়া ঋণ এবং বাণিজ্যঘাটতি
বৈদেশিক রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। যার প্রভাবও পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জুনের হিসাব মতে বৈদেশিক ঋণের ৭৭ শতাংশ সরকারি খাতের এবং বাকি ২৩ শতাংশ বেসরকারি খাতের। যার মধ্যে কিছু ঋণে রয়েছে উচ্চ সুদের হার ও কঠিন শর্তাবলি। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঋণ সরকারি বা বেসরকারি যেই খাতেই নেয়া হোক, সেটা পরিশোধের চাপ পড়বে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।
বিশ্বব্যাংক, জাপান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি), চীন প্রভৃতি দেশ ও সংস্থা থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে বিভিন্ন বহুপক্ষীয় সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯২৩ কোটি ডলার। দ্বিপক্ষীয় অর্থাৎ কোনো দেশের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলার। বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৮৫ কোটি ডলার।এর বেশিরভাগ ঋণই সরকার নিয়েছে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য।
বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপও। তবে সেই তুলনায় বাড়েনি প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ। বিগত আট বছরের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যায় বৈদেশিক ঋণের হার বেড়েছে ১৩৫ শতাংশ। অপরদিকে প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬০ শতাংশের মতো। যার ফলে প্রতি বছরই বাজেটে একটি বড় অংশ রাখতে হচ্ছে ঋণ পরিশোধের জন্য। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার ৩২২ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাড়িয়েছে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা।
এছাড়াও বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র থেকে আমদানির চেয়ে রপ্তানির হার নিতান্তই কম হওয়ায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বাণিজ্যঘাটতি। শুধু চীন থেকেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১ হাজার ৯৮১ কোটি ডলারের পণ্য, যার বিপরীতে রপ্তানি ছিল মাত্র ৬৮ কোটি ডলার। ফলস্বরূপ চীনের সাথে বাণিজ্যঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের চেয়েও বেশি।
অর্থনৈতিক সংকটে রাষ্ট্র ও ভোগান্তিতে জনগণ
বাড়ছে মাথাপিছু ঋণ, বাড়ছে দ্রব্যমূল্য কিন্তু এই ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না জনগণের আয়। অর্থনীতিতে এই আকস্মিক চাপ ও দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্য সীমার সামান্য উপরে থাকা অনেক পরিবারই আবার গরিব হয়ে পড়ছে। জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য ও বিভিন্ন সেবার দামবৃদ্ধি হওয়ায় অসহায় হয়ে পড়ছে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এছাড়াও বিগত বছরজুড়েই ছিলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। ২০২৩ সালের শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার ছিলো ৮.৫৭ যা বছর শেষে দাঁড়ায় ৯.৯৩ এ।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি চলমান গত বছর থেকেই, তবে দিন দিন তা আরও প্রকট হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বাধ্য হচ্ছে তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে ও ধারদেনা করতে। পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় খরচ কমিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের ৩৭ শতাংশ পরিবার তিন বেলার মধ্যে এক বেলা খেতে পারছে না। ৪০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এমন অনেক দিন তাদের ঘরে কোনো খাবার ছিল না। এ সময় এমনও দিন গেছে, পুরো দিন না খেয়ে কেটেছে ১৮ শতাংশ পরিবারের।
বছর তিনেক আগেও মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিলো এক লাখ টাকা। যা এখন বেড়ে দাড়িয়েছে দেড় লাখ টাকায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেয়া এসব স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রভাব ফেলছে দেশের অর্থনীতিতে। এসব ঋণ দেশের অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কার মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুঈদ রহমান বলেন, দেশের দুই রাজনৈতিক শক্তি এখন ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। এ রাজনৈতিক পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একমাত্র সময়ই তা বলতে পারবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের দিকে দৃষ্টি না দিলে তা কারও জন্যই মঙ্গল হবে না। আমরা চাই, অর্থনৈতিক সংকটকে আমলে নিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের ন্যূনতম চেষ্টা করা হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।