চাকরিতে প্রবেশসীমা বৃদ্ধি রাষ্ট্রের জন্য কেন জরুরি
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে চিঠি লিখে সুপারিশ করেছেন যেন, সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর পর্যন্ত করা হয়। জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয়, তাই প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন।
সংসদ অধিবেশনেও একাধিকবার বিভিন্ন সংসদ সদস্য দাবিটি নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন কিন্তু এখনও দাবিটি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বেশ কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিক ভাবে দাবি আদায়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ নামের সংগঠন।
সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের একজনকে তার শিক্ষা জীবনের অর্জিত সকল সনদ পুড়িয়েও আন্দোলন করতে দেখা গেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছেন শাহবাগ ও প্রেসক্লাবেও। তাদের দাবির সাথে বিভিন্ন সময় একাত্মতা পোষণ করেছেন কয়েকজন সংসদ সদস্যও।
এক সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদও চাকুরির প্রবেশ সীমার বয়স ৩৫ করার কথা প্রস্তাব করেছিলেন।শুধু তাই নয় বরং বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকারও বিষয়টি যৌক্তিক মনে করে ২০১৮ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি যুক্ত করেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও তাদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের দাবি, প্রতিযোগিতার এই সময়ে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিতে ৩০ পেরিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের কারণে বয়সসীমা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে আসে। এতে করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এতে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এছাড়া করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেশনজট বৃদ্ধিতে এই হতাশা বেড়েছে কয়েকগুণ।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই দাবিটি কি মানবিক কারণেই গুরুত্ব দেয়া উচিত নাকি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দাবিটি আসলেই যৌক্তিক।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই দাবি বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কোথাও ৩৫, কোথাও ৪০, আবার কোথাও কোথাও বয়সের কোন সীমাবদ্ধতাই নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা ৪০ বছর, আফগানিস্তানে ৩৫ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর, নেপাল ৩৫ বছর, ভুটান ৩৫, ভারত ৩৫/৪০ (রাজ্যভেদে)।
কিছু দেশে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের কোন সীমাবদ্ধতাই নেই, যোগ্যতা থাকলেই যে কোন সময় চাকরিতে আবেদন করা যায়। বিশ্বের প্রায় ১৬২ টি দেশেই এই বয়স সীমা ৩৫ বা তার অধিক। শুধুমাত্র ৩০ এর বিধান রয়েছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে। শুধু তাই নয় আমরা যাদের কে অনুসরণ করে উন্নত বিশ্বের অংশীদার হতে স্লোগান দেই বা টকশো কাঁপিয়ে উদাহরণ টানি সেসব ইউরোপ আমেরিকার দেশের সরকারি চাকুরির প্রবেশ সীমা আরও বেশি।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সরকারি চাকুরি বয়সসীমা ৫৯ বছর। মজার ব্যাপার হলো, আমরা যাদের কথায় কথায় শত্রু বলে আখ্যায়িত করি এবং ঐতিহাসিক ভাবে যারা আমাদের দেশের মানুষের মনে ক্ষোভের লালিমা রেখা একে রেখেছেন সেই পাকিস্তানের বয়স সীমার সাথেই কেবল আমাদের মিল রয়েছে।
যে দেশটি আমাদেরকে ২৪ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি করে রেখেছিল, যে দেশটি ত্রিশ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে, যে দেশটি এখনও ভঙ্গুর রাষ্ট্রের তালিকা থেকেই বেরোতে পারেনি আমরা কি না চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার নীতিমালায় সে-ই পাকিস্তানকেই অনুসরণ করছি। এই নীতিমালা স্বাভাবিক ভাবেই ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। যা অত্যন্ত দু:দুঃখজনক।
এছাড়াও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করলে দেখা যায়, যে সময়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ ছিল, তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪০ বছর। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ এ উন্নীত করা হয়, তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭২.৩ বছর হলেও, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ ই রয়ে গেছে।
২০১১ সালে চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা ৫৭ বছর থেকে ৫৯ করা হলেও বাড়ানো হয়নি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা। যেখানে গত ৩২ বছরে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে প্রায় ২৩ বছর অথচ সেখানে ৫ বছর বয়স বাড়ানোটাকে যৌক্তিক মনে করছি না। করোনা মহামারির ফলে বয়স বৃদ্ধির যে পদক্ষেপ ছিল সেটিও কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত ছিল বলা যাবে না। কারণ, এই করোনাকালীন পুরো বিশ্বই থেমে ছিল।
এখানে শিক্ষাজীবন হারিয়েছে সব বয়সের শিক্ষার্থীরা। অথচ এই সুযোগ দেয়া হয়েছে শুধু যারা শেষ সময়ে চাকুরির আবেদন বঞ্চিত ছিলেন তারা। যে শিক্ষার্থী অনার্স প্রথম বর্ষে ছিলেন সে কিন্তু এর কোনো সুবিধাই পায়নি কিন্তু দুবছর শিক্ষাজীবন ঠিকই হারিয়েছেন।
অর্থাৎ এই করোনা মহামারিতে যারা শিক্ষাজীবনের বয়স হারিয়েছেন তারা তা স্থায়ীভাবেই হারিয়েছেন অথচ সুবিধা পেয়েছেন মুষ্টিমেয় কিছু চাকুরি প্রত্যাশী। ক্ষতি যদি স্থায়ী ভাবে হয়ে থাকে তার ক্ষতিপূরণ কেন সাময়িক এবং একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি পাবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
অনেক বিশ্লেষক বলেছেন বয়স বৃদ্ধির সাথে নাকি দক্ষতা ও সফলতার হার কম তাই বয়স বৃদ্ধি কোনো সমাধান নয়। যদি এটিই হয়, তাহলে দক্ষতার অজুহাতেই কেন অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় এবং উন্নত বিশ্বের অধিক বয়স সীমা রেখেও কীভাবে উন্নয়ন ঘটাচ্ছে।
যেভাবেই বলি না কেন, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি যুবসমাজ। এ যুবসমাজ তখনই মানবসম্পদে পরিণত হয়, যখন রাষ্ট্র তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করে এবং নিজেদেরকে গড়ে তোলার সুযোগ দেয়। অন্যথায় এ বিশাল জনসম্পদ রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর সবচেয়ে মোক্ষম ধাপ হল ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। যা বাংলাদেশ এই মুহূর্তে চলমান। এটিকে সঠিক ভাবে কাজে না লাগাতে পারাটা যে কোনো দেশের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। অন্যদিকে, বাংলাদেশের যুবনীতি অনুযায়ী যুবকদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩৫ বলা হয়েছে।
আফসোসের বিষয় বাংলাদেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এ সীমাবদ্ধ করার কারণে আমরা উচ্চশিক্ষিত তরুণদেরকে ৩০ বছর পার হলেই অযোগ্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিচ্ছি। একজন যুবক তার যুব নীতির শেষ ৫ বছর পার করার আগেই চাকুরির বাজারে তাকে মধ্যবয়সী হিসেবে গণনা করা হচ্ছে।
যে সনদ অর্জন করতে সময় লাগছে জীবনের মহামূল্যবান ২৬-২৭ বছর, আমরা তার বৈধতা দিচ্ছি মাত্র ৩-৪ বছর। সেই একই নীতি অনুসরণ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো। সার্বিক বিশ্লেষণে এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, এতে রাষ্ট্রের বোঝা যেমন বাড়ছে, তেমনি রাষ্ট্র হারাচ্ছে একটি কর্মক্ষম বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে।
তাছাড়া বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য হলো তরুণ চাকুরি প্রার্থীদের দুর্নীতি মুক্ত চাকুরি উপহার। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেও সরকারের সুযোগের দরজা খোলা রাখা উচিত। যুবকেরা তাদের মেধার সততা দিয়েই সেটা অর্জন করুক। তাই মানবিক কারণেই নয় বরং যৌক্তিক কারণেই সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়স সীমা ৩৫ বছর দাবিটি ভেবে দেখুন। নাহলে হতাশায় আত্মহত্যা ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধ প্রবণতায় ডুবে যাবে আমাদের শিক্ষিত যুব সমাজ।
কাবিল সাদী
নাট্যকার ও কলামিস্ট