ঢাবিতে নিয়োগের এমন প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞপ্তি কোথাও পাবেন না
গতকাল একটি পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিয়োগের একটি রিপোর্ট (বিজ্ঞপ্তি) দেখলাম, যার শিরোনাম হলো ‘প্রভাষক নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেতন স্কেল ২২ হাজার টাকা’ এবং কনসোলিডেটেড বেতন হলো ৩৬,৫০০-৩৬,৮০০ টাকা। কতটা লজ্জাজনক বুঝতে পারছেন? প্রভাষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা চেয়েছে এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ ৫ এর মধ্যে ন্যূনতম ৪.২৫।
আর অনার্স মাস্টার্সে ৪ এর মধ্যে ন্যূনতম ৩.৫! সাথে চেয়েছে ৭৫০ টাকার পে অর্ডার, প্রশংসাপত্র, মার্কশীট, সার্টফিকেট ইত্যাদির সত্যায়িত প্রতিলিপিসহ আট কপি আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। এই আট কপি কিংবা তারও বেশি কপি আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। পরবর্তী সকল প্রমোশনের জন্য আবেদনের সময়ও আট কপি কিংবা তারও বেশি জমা দিতে হয়।
আমি পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা পোস্ট-ডক নিয়োগের এই বিজ্ঞপ্তি দেখেছি। এরকম প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞপ্তি পৃথিবীর আর কোথাও পাবেন না, এমনকি আফ্রিকার অনুন্নত দেশের বিজ্ঞপ্তিতেও না। আমাদের এই বিজ্ঞপ্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের সময়ের বিজ্ঞপ্তির সাথে তেমন কোন পার্থক্য নেই।
এইটা হলো আমার প্রথম কথা যে, আমাদের শিক্ষক নিয়োগের বিধিমালা গত ১০০ বছরেও কোন পরিবর্তন বা বিবর্তন হয়নি। অথচ এই ১০০ বছরে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে নর্দমায় পরিণত হয়েছে। ফিজিক্স টুডে একটি নামক একটি ম্যাগাজিনে পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ছাপে। ইচ্ছুকরা ওই ম্যাগাজিনের একটা ইস্যু অনলাইনে খুলে আমাদেরটার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
গতকাল ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক আব্দুস সালামের প্রতিষ্ঠিত TWAS বা থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অফ সাইন্স থেকে প্রকাশিত মাসিক ম্যাগাজিনে কিছু পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল পোস্টে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। কলকাতা শহরে আমাদের সত্যেন বোসের নামে একটা ইনস্টিটিউট আছে। সেই ইনস্টিটিউট আর TWAS মিলে দুইটা প্রোগ্রাম চালু করেছে যার একটি পিএইচডি প্রোগ্রামের আর অন্যটি পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ প্রোগ্রামের।
একইভাবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর ফিজিক্স এবং TWAS মিলে দুইটা প্রোগ্রাম চালু করেছে যার একটি পিএইচডি প্রোগ্রামের আর অন্যটি পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ প্রোগ্রামের। কলকাতা প্রোগ্রামের একজন পিএইচডি ছাত্র প্রতিমাসে পাবে বাংলাদেশি টাকায় ৫৫ হাজার টাকা প্লাস এর ২৫ শতাংশ বাসা ভাড়া যা প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
আরো পড়ুন: প্রভাষক নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেতন স্কেল ২২ হাজার
আর আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক পায় ৫৩ হাজার টাকা। এইবার আসি পোস্টডক্টরাল ফেললোশিপের ক্ষেত্রে। একজন পোস্টডক পাবেন বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১ লাখ টাকা, যা আমাদের একজন অধ্যাপকের পূর্ণ বেতন প্লাস বাসা ভাড়া মিলিয়ে যা হয় তার সমান। মনে রাখতে হবে, কলকাতায় বাসাভাড়া ঢাকার চেয়ে অনেক কম। তাছাড়া সেখানে জিনিসপত্রের দামও কম।
এরপর আবার আমাদের আমলারা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরেকবার গলা চিপে ধরার ব্যবস্থা করেছে। এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটা পেনশন পেত। আমলারা সার্বজনীন পেনশন নামে নতুন একটা পেনশন নাজিল করেছে আর নিজেরা সেই পেনশনে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঢুকানো যায়, সে নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষণা করে বের করেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যে পেনশন এতদিন দিয়ে আসছিল তা বিধিসম্মত না। তাই এখন থেকে এটি আর দেওয়া চলবে না, তবে যারা পাচ্ছেন তাদেরটা চলবে।
আরো নাজিল করেছেন যে, এখন থেকে নতুন যারা নিয়োগ পাবেন- তারা সার্বজনীন পেনশনার আওতাভুক্ত হবেন। অর্থাৎ শিক্ষকতা পেশাকে আরেক ধাপ নামিয়ে দেওয়া হলো। শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে না নেওয়ার আরেকটি পলক যোগ হলো। তাহলে বেতনে মারছে, সুযোগ সুবিধায় মারছে, পেনশনে মারছে। শিক্ষায় বরাদ্দ কমাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম নামের শিক্ষার কারিকুলাম দিয়ে মারছে। মানে এদেশের শিক্ষার ১৪টা বাজিয়ে ছাড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)