ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ঈদ উৎসব পানসে করে দেওয়া হয়েছে
পবিত্র ঈদুল ফিতর দেশের সর্বোচ্চ আনন্দের দিন। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলেই এই উৎসব পরিবার স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে উপভোগ করেন। কিন্তু এই বছরেও আবার জনগণের ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র কেড়ে নেওয়ায় জনজীবনের এই উৎসব পানসে করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে চলমান সরকারের লুটপাট আর মহাদুর্নীতির কারণে মানুষের শেষ হাসিটুকুও বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ঈদে আনন্দ উদযাপনের বিপরীতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন মধ্যবিত্ত মানুষেরা। সমাজে তৈরি হয়েছে ধনী ও গরীবের বিশাল ব্যবধান। অধিকাংশ মানুষের সামান্য প্রয়োজন মিটানোই যেন দুঃস্বপ্ন। এক যুগের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি ভয়ানক কর্তৃত্ববাদী শাসক।
স্কুল-কলেজ পড়ার সময় বিএনপির শাসন আমলে দেখতাম সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায় নারী ও পুরুষদের মাঝে শাড়ি-লুঙ্গি, খাদ্যদ্রব্যসহ ঈদ উপহার সামগ্রী সরকার কর্তৃক বিতরণ করতে। আর বর্তমান সরকার অসহায় মানুষের পাশে থাকার বদলে ব্যস্ত রয়েছে লুটপাট, দুর্নীতি ও বিরোধীমতকে দমন-পীড়নে।
৬ বছরের বেশি সময় ধরে অসুস্থ অবস্থায় বিনা অপরাধে নাগরিক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বন্দি রাখা হয়েছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন আপোষহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। যিনি দেশের পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই জনগণের ভোটে তিনিই জয়ী হয়েছেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষকের সহধর্মিণী, সাবেক তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী যিনি দেশের জনগণের জন্য আজও অসুস্থ অবস্থায় লড়াই করছেন। এই ঈদেও পরিবার ছাড়া উনাকে পালন করা লাগবে। সত্যি বলতে এক যুগের বেশি সময় ধরে আমাদের ঈদ নেই। প্রতিদিন আমাদের কাউকে না কাউকে হত্যা, না হয় গুম, না হয় জেলে বন্দী করা হচ্ছে, না হয় মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পযার্য়ের নেতাদের ঘন্টার পর ঘন্টা আদালতে সময় পার করতে হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ মানুষের চাকারি নেই, বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা।
১ লাখ ৫০ হাজারের ওপরে মিথ্যা মামলা, কীভাবে মজলুম নেতাকর্মীদের ঈদ ভালো যাবে? অপরদিকে দেশের মানুষ নিরানন্দের ভয়াবহ সরকারের লুণ্ঠন ও অব্যস্থাপনায় দুর্দশাগ্রস্ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। গণতন্ত্র ও অধিকারবিহীন পরিবেশে দুঃশাসনের কবলে মানুষ অতিষ্ঠ, স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উদযাপন করতে পারে মানুষ এই উপলক্ষ্যে নেই সরকারের কোনো উদ্যোগ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ফলে প্রতিদিন ছিনতাই অথবা নিহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ।
এই মাসেই নরসিংদীতে নগদের ২ কর্মীকে গুলি করে ৬০ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়েছে। বাংলাদেশের সড়ক এখন মৃত্যুপুরী। সড়কে প্রতিবছর ১২ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। ঈদসহ বিশেষ দিনে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। এইবারের ঈদ যাত্রায় কেবল ঢাকা ছাড়তেই ৯৮৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে যাত্রীদের। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে বাসের টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। বাস পরিবহণ খাত আপাদমস্তক অনিয়ম দুর্নীতির কারখানা। ঈদ উপলক্ষ্যে চলছে সড়কে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি। শ্রমিকলীগ ছাত্রলীগের কালোবাজারি টিকিটের ব্যবসা নামে চলছে লুটতরাজ।
ঈদ যাত্রায় এখন ব্লাক টিকিটের চড়া দাম, ভোগান্তি, হয়রানি প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। বর্তমানে রেল টিকিটের হাহাকার, অধিকাংশ যাত্রী স্বাভাবিকভাবে টিকিট কাউন্টার অথবা অনলাইনে ক্রয় করতে পারে না। প্রতিবারের ঈদ যাত্রায় ৪২ দশমিক বেশি নারী কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানি শিকার হতে হয়। দেশে উচ্চশিক্ষিত প্রায় অর্ধেকই বেকার। বেকারত্ব হারে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকাই দুর্নীতি বাড়ার কারণে চাকরি নেই। মেধাবী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছে না সরকার দলীয় সন্ত্রাসী পরিচয়ে শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে সন্ত্রাসীদের মতো ছাত্রকে শিক্ষক গুলিকরে আহত করছেন।
সাম্প্রতিক সিরাজগঞ্জ শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রলীগ কোটায় শিক্ষক রায়হান শরিফের গুলিতে আহত হয় এক শিক্ষার্থী। এসব দুর্নীতি কর্মসংস্থানের কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হতাশা হয়ে বাড়ি জমি বিক্রি করে পরিবার সন্তান দেশে রেখে দেশ ছাড়ছে তরুণরা। এই দেশ ছাড়তে গিয়ে কেউ কেউ সমুদ্রে ডুবে নিহত হচ্ছেন। প্রায় পত্রিকায় দেখা যায় অভাবের কারণে মা নিজ সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছেন আবার অভাবের তাড়নায় বেকার, স্বামীসহ স্ত্রী, যুবক-বয়স্ক মানুষ আত্মহত্যা করছেন।
এই ২৮ রমজানে ছেলে ও মেয়েকে গুলি করে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এক প্রকৌশলী বাবা আত্মহত্যা করেছেন। অভাবের তাড়নায় মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হাটহাজারীতে আত্মহত্যা করেছেন। এই এপ্রিলে চিকিৎসা ওষুধ কিনতে না পেরে মগবাজারে ৪৫ বছর বয়সের এক যুবক নিজের পেটে চাকু ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গাইবান্ধায় মুক্তিযোদ্ধা টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে ট্রেনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। দুদকের প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় ভূমি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। এই সব নিরীহ মানুষের আত্মহত্যা দায় অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে।
সারাদেশে প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে বোবা কান্না। অথচ সরকারি দল জোর করে ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে আওয়ামী লীগের নেতারা ব্যাংক মেগা প্রকল্পগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। যা ১৪-১৫ বছরে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে। জেলা পর্যায়ে নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত দেশের জনগণের টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছে। ফরিদপুরে ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামিম ২ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। পুলিশের সাবেক আইজিপি র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ মাসিক ১ হাজার ৪৭০ টাকা বেতনে চাকারি শুরু করে আওয়ামী লীগের সরকারের আশীর্বাদে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ তৈরি করেছেন।
অথচ দেশের গরীব মেহনতী মানুষেরা সন্তানদের জন্য ঈদে ফুটপাত থেকে পুরাতন কাপড় ক্রয় করতে পারছেন না। সারা বছর টাকা জমিয়ে মাংস সমিতি নাম দিয়ে সমিতি চালু করছেন রাজশাহী পবা উপজেলায় বাসিন্দারা। শুধুমাত্র ঈদে পরিবার সন্তানরা মাংস খেতে পারবে এই আশায়। অপরদিকে সাবেক আওয়ামীলীগের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্রিটেনে হাজার কোটি টাকার সম্পদ, একাধিক বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে যা দেশের গরীব মেহনতী মানুষের থেকে লুটপাট করা টাকা। বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত চলছে লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাট। আমরা মহান আল্লাহ তায়ালা কাছে সকলে দোয়া করব এই অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য নির্যাতন থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করুন।
তবুও ঈদ আনন্দের। না পাওয়ার মাঝেও অনেক কিছু পাওয়া। তাই ঈদ প্রতিটি মানুষের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, হাসি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক, এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। সবাইকে ঈদুল ফিতরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন।
লেখক: আহ্বায়ক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল।