ন্যায়যুদ্ধ ১৯৭১

 মো. ছানাউল্লাহ
মো. ছানাউল্লাহ  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বাঙালি জাতির বিশেষ তাড়নায়। সেই তাড়নাটি ছিল বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই। বাঙালির এই মহান যুদ্ধকে নিছকই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত কোনো মারামারি বা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কাতারে ফেলা যাবে না। এই মহান ঘটনাটিকে ইতিহাসে যথাযথ স্থান তখনই দেয়া হবে যখন এই লড়াইয়ের মর্ম অনুভব করা যাবে। ইতিহাসে সত্য ও ন্যায়ের জন্য, অধিকারের জন্য লড়াইকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ বা ন্যায়যুদ্ধ। ধর্ম হলো সত্য, প্রকৃতি, সৃষ্টি ইত্যাদি আর ন্যায় হলো অন্যায়ের বিপরীত, সঠিক, প্রকৃত, সহজাত, সত্য ইত্যাদি। 

১৯৪৭ সালে ভারতের জনগণের একাংশ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভারতকে দুইভাগ করে পৃথক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে যেটি আবার অভ্যন্তরীণভাবে দুইটি পৃথক ও দূরবর্তী ভূখণ্ডে বিভক্ত ছিল। এই অভ্যন্তরীণ দুটি ভূখণ্ডের মধ্যে সাদৃশ্য ছিল শুধু ধর্ম। ধর্ম ছাড়া কোনো সাদৃশ্য না থাকায় খুব দ্রুতই দুই অংশের মধ্যে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হতে থাকে। বিশেষ করে যখন একটি অংশ অন্য অংশকে অন্যায়ভাবে শোষণ ও বঞ্চিত করার পাঁয়তারা করে তখন এই বিশ্বাস একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। যেই উদ্দেশ্য নিয়ে একটি ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে বের হয়ে স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে একটি ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য জোরালো প্রচেষ্টা করা হয় সেই উদ্দেশ্য ভন্ডুল হলে রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে যায়। সাতচল্লিশের পাকিস্তান সৃষ্টির অন্যতম মোটো ছিল গণতন্ত্রের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা যেই প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রের গতিপথ নির্ধারণ করবেন। অর্থাৎ চূড়ান্ত বিচারে জনগণই তাদের প্রতিনিধিদের কাজের মূল্যায়ন করবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পকিছুদিন পরেই দেখা গেল জনগণের প্রকৃত ক্ষমতা জনগণের নিকট রইল না। এই ক্ষমতা একটি এলিট শ্রেণির নিকটে পৌঁছে গেল যারা ক্ষমতার খুব নিকটে অবস্থান করত। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল মোটো শুরুতেই বাধাগ্রস্ত হলো। এর ফলে দেখা গেল বাংলা ভাষার দাবিতে বাঙালির আন্দোলনের কারণ বুঝতে পাকিস্তানি এলিট গোষ্ঠী ব্যর্থ হলো।

নতুন রাষ্ট্রে বাঙালিদের যেখানে স্বার্থ আছে সেগুলো বাধাগ্রস্ত হতে লাগল। শুধু শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সমুন্নত রইল। বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিকারী হওয়ায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা হলো পশ্চিম অংশে। উন্নতমানের রাস্তাঘাট প্রতিষ্ঠা হলো পশ্চিমাংশে। উন্নয়ন বাজেটের অধিকাংশ ব্যয় হলো একাংশে যদিও অন্য অংশ রাজস্ব আয়ের দিক থেকে সর্বাধিক অবদান রাখছিল। শুধু অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোর দিক থেকেই না শিক্ষা খাতেও পূর্বের তুলনায় পশ্চিমে অনেক বেশি ব্যয় হয়েছে। শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্বাংশ পশ্চিমের তুলনায় যোজন-যোজন পিছিয়ে পড়ে। সকল বৃহৎ শিল্পকারখানার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিমাংশের উদ্যোক্তাদের হাতে। সকল ব্যাংকের বেশিরভাগ সম্পদ বিনিয়োগ হতে লাগল পশ্চিমাংশে। স্বাস্থ্যসেবার মূল অবকাঠামো হাসপাতাল তৈরিতেও এমন বৈষম্য ছিল চাক্ষুষ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বাঙালিদের অবিশ্বাসের দোলাচলে বন্দি করে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হলো। বাঙালিরা ক্ষমতার চাইলেই বলা হত এবার রাষ্ট্র ভাঙবে। এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হলো যেখানে বাঙালিদের ভাগ্য জুটলো শুধু বঞ্চনা। একটি জাতির প্রতিটি সদস্য এই কাঠামোতে বঞ্চিত হতে শুরু করল। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের এই বঞ্চনার প্রেক্ষিত অনুধাবন করলেন। তিনি এমন একটি ব্যবস্থার ডাক দিলেন যেই ব্যবস্থাটি নতুন কোনো ফরমুলা নয় বরং পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি যেই প্রস্তাবের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সেই লাহোর প্রস্তাবের মূলকথাকেই তিনি নতুন করে সামনে নিয়ে এসে বাঙালির বঞ্চনাকে দূর করতে সচেষ্ট হলেন। 

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাঙালির এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সমর্থনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমবারের মত একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল বঞ্চিত বাঙালিকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা। বাঙালি জনতা তাঁর এই দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে তাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর রায় দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের এলিট গোষ্ঠী আবারও জনগণের রায়কে অস্বীকার করে কীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিজের হাতে রাখা যায় সেটির বন্দোবস্ত করতে বাঙালির উপরে রাতের আধারে কাপুরুষোচিত ভঙ্গিতে ঝাপিয়ে পড়ে। সংঘটিত করে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন স্বাধীন বাংলার। ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র, যুবক, বৃদ্ধ, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, পুলিশ, সেনা সকলেই। শুরু হয় এক জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের যুদ্ধ, সত্যের বিরুদ্ধে অসত্যের যুদ্ধ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমতার যুদ্ধ। এই মহান যুদ্ধ নিছক কোনো ভূমি দখল বা ক্ষমতার গদি দখলের যুদ্ধ নয়। এটি ছিল কোটি বাঙালির অধিকার আদায়ে ন্যায়যুদ্ধ। 

বস্তুত বঙ্গবন্ধু ন্যায়ের পক্ষে লড়েছেন। তিনি কোনো চটকদার বিজ্ঞাপনের জন্য কথার ফুলঝুড়ি ওড়াতেন না। তিনি বাঙালির বঞ্চনার বিরুদ্ধে উচ্চকিত করেছেন নিজের আওয়াজ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পাকিস্তান যেই ভুল করেছে তিনি সচেতনভাবেই সেটি এড়িয়ে গেছেন। উন্নয়ন খাতের ব্যয়ে ন্যায্যতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি অনুধাবন করেছেন যে যেই বাঙালির জন্য তিনি পাহাড় সড়ালেন বা অসাধ্য সাধন করলেন সেই বাঙালিকে নতুন করে বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু সচেতনভাবে দেশের অভ্যন্তরে সকল ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির পথ থেকে দূরে থেকেছেন। তিনি সকল অঞ্চলের সকল ধরনের মানুষের জন্য সমানাধিকার নিশ্চিতে কাজ করেছেন। তাঁর প্রণীত নীতিগুলো ছিল সার্বজনীন অধিকার রক্ষায়। প্রতিটি ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল সমুজ্জ্বল। 

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল ন্যায্যতার লড়াই। এটি ছিল ন্যায়ের লড়াই। বর্তমান বাংলাদেশে এই লড়াই এখনও প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তির আইনি অধিকার পেতে এখনও লড়াই করতে হলে এই স্বাধীনতা অর্থবহ হবে না। এই বঞ্চনা হতে পারে স্থানীয় পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। সকল ধরনের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে বাঙালির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে বঙ্গবন্ধু লড়াই করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং জীবন দিয়েছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখতে প্রতিটি পর্যায়ে বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখব এবং একটি “সোনার বাংলা” প্রতিষ্ঠা করব এই হোক স্বাধীনতা দিবসের মন্ত্র।  

লেখক: প্রভাষক, ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (বিডিইউ)
ই-মেইল: sanaullah0001@bdu.ac.bd


সর্বশেষ সংবাদ