মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের ভাবনায় পবিত্র মাহে রমজান
রমজান হলো মুসলিমদের আত্মশুদ্ধির মাস। বছর শেষে পুনরায় সমাগত আত্মশুদ্ধি, সাম্য, সহমর্মিতা ও মানবীয় গুণাবলি, পাপ ত্যাগে পুণ্য সঞ্চয়ের মাস পবিত্র রমজান। মুসলিম জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজান অতি গুরুত্বপূর্ণ। সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করেন এই পবিত্র মাহে রমজান।
ক্যাম্পাসে অবস্থান করে রোজা পালন থেকে শুরু করে সকল ধরনের ধর্মীয় কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নিয়ে নানা রকম অভিমত থাকে তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকের।
এই রমজানে পরিবারের বাহিরে ক্যাম্পাসে কেমন কাটছে এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মুসলমানদের এই মহিমান্বিত মাসে প্রতিবছরই ইচ্ছে থাকে পরিবারের সাথে কাটানোর, ধর্মীয় আমলে যুক্ত থেকে এলাকার বন্ধুদের সাথে রমজান পালন করার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা ও দেরিতে ছুটি হওয়ায় সেই আমেজ ও ইচ্ছে পূরণ হয়ে ওঠেনা। তাই শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায় যে, রমজান মাসে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কথা বা ইচ্ছেগুলো যেন বিবেচনায় রাখে।
ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হেনামুল ইসলাম হিমু বলেন, রোজা রেখে ক্লাস করা খুবই কষ্টকর। ঈদের পর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় ক্লাস, সিটি, প্রেজেন্টেশন এখন প্রতিদিনই দিতে হচ্ছে। বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে বাসের শিডিউলে। অনেক সময় দুপুরের সময় বাসে জায়গা না থাকায় অটোতে করে শহরে যেতে হয়েছে। তারাবির নামাজের সময় রাস্তা একদম ফাঁকা এই সময়ে ছিনতাইকারীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। রাত ৯টায় শহর থেকে বাসের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। বিভিন্ন সংগঠন থেকে ইফতার করার মত কোন অডিটোরিয়াম নাই। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট যাওয়া হয়েছিল রুমের জন্য ওনারা সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে আমাদেরকে মাঠে বসে ইফতারের আয়োজন করতে হচ্ছে।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা ফেরদৌস স্বর্ণা পবিত্র মাহে রমজান নিয়ে বলেন,
"মাহে রমজান এলো বছর ঘুরে মুমিন মুসলমানের দ্বারে দ্বারে।" সেই শৈশব কৈশোরে যখন রমজান আসতো তখন এই গজলটা চারপাশের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে যেন স্মরণ করিয়ে দিত রমজান মাস চলে এসেছে। রমজানে একটা মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যেখানে পরিবারের সেখানে আমরা শিক্ষার্থীরা বাস্তবতার নির্মমতায় থাকি পরিবার থেকে শত শত মাইল দূরে। কেউ হয়তো হলে, কেউ বা মেসে একটা একটা করে দিন অতিবাহিত করছে কবে বাড়ি ফিরবে সেই আশায়। মা ফোন দিয়ে বলে, উঠেছো? এখনই উঠো, সেহেরির টাইম হয়ে গেছে। পরে কিন্তু সময় পাবে না। ফজরের নামাজ পড়ে তারপর ঘুমিয়ো। আগে ঘুমিয়ো না কিন্তু। আবার জিজ্ঞাসাও করে সেহেরিতে কি খাবে? খেতে পারো তো!
তিনি আরও বলেন, বাবা মায়ের চিন্তার যেন শেষ নেই আমার সন্তানটা ঠিকঠাক সেহরি করছে তো? ইফতারে কি খাচ্ছে? আর এদিকে প্রতিটা শিক্ষার্থী প্রতিদিন অপেক্ষার দিন গুণে কবে বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের রান্না খাবে, পরিবারের সাথে ইফতার, সেহরি করবে আর তারাবি পড়বে। মা যখন তার সন্তানের পছন্দের পেঁয়াজু, বেগুনি কিংবা তার সন্তানের পছন্দের কিছু তৈরি করে বা কিনে আনে তখন চোখে পানি নিয়ে ভাবে আমার মেয়েটা বা ছেলেটা কবে বাড়ি আসবে! বারবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, ছুটি কয় তারিখ? কবে আসবে তার বুকের মানিক! বারবার বলবে তোমার পছন্দের এই জিনিসটা ফ্রিজে তুলে রাখছি, কবে আসবে? কিন্তু একজন শিক্ষার্থী চাইলেও বাড়ি ছুটে যেতে পারে না। অথচ রমজান শুরুর ১ সপ্তাহ আগেই বাবা আমাকে বলতো রমজানের বাজার করতে হবে লিস্ট করো তো। পরিশেষে এইটুকুই বলবো আমি, "রমজানে হোক প্রতিটি মানুষের সকল অশান্তির অবসান ইবাদত ও পরিবার নিয়ে কাটুক প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতিটি রমজান।"
বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান সিয়াম বলেন,রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের মাস রমজান। সিয়াম পালনের অনেক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি রয়েছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম পালনের মাধ্যমে আমরা আত্মসংযমের অনুশীলন পাই। একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালাকে রাজি খুশি পরার জন্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা খাওয়া দাওয়া ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকি। খানাপিনা আমাদের জন্য হালাল এরপরও একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালাকে রাজি খুশি করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমরা এ থেকে দূরত্ব বজায় রাখি।
তিনি আরও বলেন, যার মাধ্যমে আমরা পরহেজগার হওয়ার অনুশীলন পাই। এ মাসে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, ধৈর্য, উদারতা ও সততা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। সিয়ামের মাধ্যমে ধনী লোকেরা অতি সহজেই সমাজের অসহায় গরিব-দুঃখী, এতিম-মিসকিন ও নিরন্ন মানুষদের কষ্ট বুঝতে পারে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারে। নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘এ মাস (রমজান) সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস।’
এই শিক্ষার্থীরা লক্ষণীয় যে, রোজার এত এত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি থাকার পরও আমরা দীর্ঘ একমাস অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বাকি এগারো মাসের জন্য নৈতিক ও পরহেজগার বান্দা হতে পারি না। এর অন্যতম কারণ আমরা অনেকেই মনে করি শুধু সকাল-সন্ধা পর্যন্ত খানাপিনা না করার নামই রোজা। আমাদের চিন্তার এ ভ্রান্তির কারণেই একদিকে আমরা রোজাও রাখছি আবার অপরদিকে পরনিন্দা, গীবত, মিথ্যা কথা ও কাজ, সিন্ডিকেটসবই সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছি। যার ফলে দীর্ঘ একমাসের অনুশীলনের প্রতিফলন বাকি এগারো মাসে আমরা দেখতে পাই না। রমাদানের এ মাসে চাওয়া হলো, সবাই যেন সিয়ামের তাৎপর্য বুঝে রমাদানের এ মাসটি প্রোডাক্টিভভাবে পার করি।
ইংলিশ বিভাগের শিক্ষার্থী সান্ত্বনা আক্তার বলেন, রমজান মাস আমাদের জান্নাতে যাওয়ার জন্য সুন্দরতম পথের সৃষ্টি। হেলায় ফেলায় সুন্দর মাসটা যেন নষ্ট না করি আমরা। কিন্তু এই মাসটাও যেন আমাদের রেগুলার ক্লাস, সিটি প্রতিনিয়ত থাকে। আর যারা রোজা রেখে আমার মত দূর থেকে এসে ক্লাস করে তাদের একটু বেশি কষ্ট করতে হয়। মাঝে মাঝে পাওয়া যায় না অটো, ক্লাসের গ্যাপটা আমাদের মূল্যবান সময়টা নষ্ট করে ফেলে।
তিনি আরও বলেন, এই রমজান আমাদের পরিবারের সাথে কাটানোর উত্তম সময়। কেননা যখন আমরা চাকরি জীবনে জড়াবো তখন না পারবো পরিবারের সঙ্গে থাকতে, না পারবো তাদের সময় দিতে। পরিবার রেখে এত দূরে এসেও যদি এত ভোগান্তিতে ভুগতে হয় তাহলে তো আমাদের জন্য এক টুকরো বেহেশত থেকে দূরে থাকার মতই।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আফজালুর রহমান আবির বলেন, নিঃসন্দেহে আরবি মাসের অন্য মাসগুলোর চেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস হলো রমজান। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বাণী নিয়ে আসে পবিত্র রমজান। আমরা যারা শিক্ষার্থী তাদের জীবনযাত্রাতেও অনেক রদবদল হয় এই রহমতের মাসে। রমজান মাস জুড়ে সিয়াম পালনকরীরা ভোর রাত হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকে। এ থেকে আমরা আমাদের শিক্ষা জীবনে নিয়মানুবর্তীতার দীক্ষা পাই। কিন্তু শুধু না খেয়ে থাকার নাম সিয়াম নয়। এ মাসের পবিত্রতা রক্ষায় নানাবিধ পাপাচার থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মিথ্যা, গিবত, পরনিন্দা, পরচর্চা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নফসের আত্মশুদ্ধির ধার উন্মোচন করতে হবে। রমজানের পবিত্রতা উপলব্ধি করে সর্ব স্তরে সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে। এই সময়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকায় পারছি না। পবিত্র রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। রমজানের মত করেই কাটাই। এই মাসে নিজের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে এবং শোধরানোর চেষ্টা করবে।