সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে
সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রশস্ত বনভূমি। এই বন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি।সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার।সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘প্রাণ’। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ২০০১ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। যদিও ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের আড়ালে হারিয়ে যায় এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমে অবধারিতভাবে যে প্রাণীটির কথা বলতে হবে সেটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আক্ষরিক অর্থে রাজসিক এই প্রাণীটি তার হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা রঙের জন্য বিশ্বখ্যাত। এই প্রজাতির পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ প্রাণীটির নাক থেকে লেজের ঠগা পর্যন্ত গড় দৈর্ঘ্য ১০ ফুট। তবে এর মধ্যে প্রাণীটির লেজের দৈর্ঘ্য তিন ফুটের মতো। এদের গড় ওজন ২০০ থেকে ২৫০ কেজির মতো হয়ে থাকে। তবে এখন পর্যন্ত প্রকৃতিতে পাওয়া সবচেয়ে বড় বাঘের ওজন সোয়া ৩০০ কেজি। প্রকৃতিতে এসব প্রাণীগুলো নিবৃত্তচারী হয়ে থাকে। এরা বন্য শুকর, হরিণ, মহিষের মতো প্রাণী স্বীকারের মাধ্যমে জীবনধারণ করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রাণীটি সংখ্যা প্রায় ২৫০০ হাজারো মতো। এর শতকরা ১০ ভাগের বসবাস সুন্দরবনে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পাশাপাশি সুন্দরবনের বাসিন্দা রেসাস বানর, চিতল হরিণ, ধূসর মাথা মেছো ঈগল, নীল মাছরাঙা, নোনাপানির কুমির করাত মাছ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইরাবতি ডলফিন নামক এক প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদ নদীগুলো বসবাস করে। তবে নদী দূষণের কারণে এসব জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখোমুখি পড়েছে।
উল্লেখ্য যে, এই বনে বসবাসকারী অনিন্দ্য সুন্দর চিতল হরিণের বসবাস হুমকিতে। একসময় সুন্দরবনের চিতল হরিণের সংখ্যা ছিল এক লক্ষের বেশি কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে বিপন্ন ৩১ প্রজাতির প্রাণী এখনও সুন্দরবনে টিকে আছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির প্রাণী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ বনে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাংলাদেশের উপকূলের মানুষের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন। বিপন্ন প্রাণীর আবাস। বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক, গ্রেট নট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙ্গেয়), দুই প্রজাতির উদবিড়াল ও লোনা পানির কুমির ইত্যাদি।
১৯৭৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেস্কো। পৃথিবীজুড়ে যে নোনাপানির ৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় সুন্দরবনে।তবে বর্তমানে নানা রকম সমস্যার মোকাবেলা করছে সুন্দরবন।সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটায় প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের আয়তন কমেছে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯০৪-২৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯০৪-২৪ সালে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৭ হাজার ১৪২ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন কমে ৬ হাজার ৮৭১ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১০০ বছরে সুন্দরবনের ২৫২ বর্গকিলোমিটার হারিয়ে গেছে। এর অর্থ, প্রতিবছর আড়াই বর্গকিলোমিটারের মতো বন হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিমাণ জমির আয়তন আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফার ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান।
তাছাড়া সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরীগাছ কমে গেছে প্রায় ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সারা বিশ্বে বিপন্ন ৩১ প্রজাতির প্রাণী এখনও সুন্দরবনে টিকে আছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির প্রাণী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ বনে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাংলাদেশের উপকূলের মানুষের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন। বিপন্ন প্রাণীর আবাস। বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক, গ্রেট নট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙ্গেয়), দুই প্রজাতির উদবিড়াল ও লোনা পানির কুমির ইত্যাদি।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এসব ঝুঁকির অন্যতম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া। ফলে বাংলাদেশে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। এ সমাস্যার সমাধান অথবা এর সাথে খাপ খাওয়ানোর উপায় খুঁজে বের করে তা কাজে লাগানো জাতীয় স্বার্থেই খুব জরুরি।
বঙ্গোপসাগরে চর পড়ায় জোয়ারের পানিতে উচ্চতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আগেকার দিনে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু রাস্তা দিয়ে জোয়ারের পানি থেকে লোকালয় রক্ষা করা যেত। তবে উপকূলীয় অধিবাসীদের আগলে রেখেছে সুন্দরবন। মংলা বন্দরের চলাচলকারী নৌযানের পোড়া তেল-মবিলের কালো কালো দাগ সুন্দরবনের গাছপালার দিকে তাকালে নজরে পড়ে। সুন্দরবনের ভেতরের জাহাজসহ নানা রকম নৌযানের মেশিনের শব্দ রাতের বেলা সেগুলোর আলো এবং এর সার্চলাইট বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। সিমেন্ট কারখানাসহ বড় ধরনের কারখানা গড়ে উঠেছে মংলায়। সেগুলো পরিবেশদূষণ ঘটাচ্ছে।
সর্বোপরি, সুন্দরবনের পুরো পরিবেশ এখন হুমকিতে। আর বনের ভেতর চলাচলকারী রাসায়নিকবাহী জাহাজ বা বন্দরের আশপাশ এলাকার কারখানার দুর্ঘটনা ঘটলে তা বনের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে।তবে আশার ব্যাপার হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং তার কারণে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সুন্দরবন সংরক্ষণে আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারত দুটি দেশই এই প্রাণীটি তাদের জাতীয় প্রাণী মর্যাদা দিয়েছে। তাই আশা করা যায় জাতীয় প্রাণী ও তার বাসস্থান বাঁচাতে দুটি দেশ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রক্ষা পাবে বিশ্বের একমাত্র শ্বাসমূলের বন এমনটা আশাবাদী বিশ্ববাসীর।
লেখক: মো. আবু জাহিদ মল্লিক ও শাহ বিলিয়া জুলফিকার