কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা জীবিকার জন্য পার্ট টাইম কিছু করে?
পৃথিবীর কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানে কাজের বাইরে জীবিকার জন্য পার্ট টাইম কিছু করে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক বা একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম পড়ানোতে ব্যস্ত থাকে। কয়েকদিন আগে আমাকে একজন বলছিল যে, বৃহস্পতি কিংবা শনিবার কোন কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা হয়ে ওঠে। তার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ঢাকার সাতটি বড় বড় কলেজ।
ভাবুনতো যেদিন একজন শিক্ষককে পার্ট টাইম পড়াতে বসুন্ধরায় কিংবা সাত কলেজের কোন একটিতে যেতে হয়, তার পক্ষে কি আর নিজ প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কাজ করা সম্ভব? অথচ বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাসরুমের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় দিতে হয়। এখন শিক্ষকরা যদি প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে পড়ানো। মানে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাক্ষাতের সময় বেঁধে অফিসে থাকতে হয়। তার ওপর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ফ্রি টাইমের প্রয়োজন হয়।
উন্নত বিশ্বের সব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করা হয়? প্রশাসন সর্বদা ব্যস্ত থাকে শিক্ষকদের মেধাকে কীভাবে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক একাডেমিক কাজ আছে যেগুলো করার জন্য পিএইচডি বা পোস্ট-ডক কিংবা শিক্ষকতার লম্বা অভিজ্ঞতা লাগে না। যেমন রেজাল্ট সমন্বয় করা, আন্ডার গ্রাজুয়েট ল্যাব তদারকি করা ইত্যাদি। এসব কাজের জন্য টিচিং এসিস্টেন্ট নেওয়া হয়। তাছাড়া যে শিক্ষকরা ভালো গবেষণা করে তার এডমিনিস্ট্রেটিভ লোড, টিচিং লোড কিভাবে কমানো যায়, সেটা নিয়ে ভাবা হয়।
তার জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের কোর্স পড়ানোর জন্য পার্ট টাইম ও Adjunct faculty নিয়োগ দেওয়া হয়। আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি করেছে? যে বিশ্ববিদ্যালয় নিজের ভারই বহন করতে হিমশিম খাচ্ছিল, তার ঘাড়ে প্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান সাইজের আরো সাতটি কলেজের ভার চাপিয়ে দেওয়া হলো। এখন বিভাগের একাধিক শিক্ষক কোন না কোন কাজে কোন না কোন কলেজে যায়। তার ওপর আছে পার্ট টাইম।
এগুলোই শেষ না। আমাদের শিক্ষকদের একটি বাসার লোভ দেখিয়ে আবাসিক শিক্ষক বা প্রভোস্ট হিসাবে নিয়োগ দিয়ে হোটেল চালানোর মতো দায়িত্বও পালন করতে হয়। আবাসিক হল চালানো আর হোটেল চালানো একই কথা। পৃথিবীর কোন দেশের শিক্ষকরা হল চালানোর মতো একটা সম্পূর্ণ নন-একাডেমিক কাজ করানো হয়? শুধু তাই না। হল চালানোর জন্য আবার পয়েন্ট দেওয়া হয়, সে পয়েন্ট আবার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার পয়েন্টের মতো প্রমোশনে কাজে লাগে।
পৃথিবীতে এমন একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় দেখান, যাদের র্যাঙ্কিং ১ থেকে ৫০০ এর মধ্যে, তাদের শিক্ষকরা সপ্তাহে তিনদিন তিন ঘণ্টা করে ল্যাবে কাটান। এর চেয়ে খারাপভাবে মেধা ও শ্রমের অপচয় আর হয় না। অথচ আমাদের যদি পিএইচডি প্রোগ্রাম থাকতো, তাহলে মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থী দিয়েও ল্যাব চালানো যেত। এতে শিক্ষার্থীরা বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পেত। ল্যাব কাজ করার অভিজ্ঞতা তার পিএইচডি সময়ে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করার সময় কাজে লাগতো। শিক্ষকরা সেই সময়ে একটি তত্ত্বীয় কোর্স পড়াতে পারতো বা গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারতো।
পৃথিবীর কোন দেশের অধ্যাপকরা রেজাল্ট সমন্বয় করে? এটি সম্পূর্ণ একটি ক্লেরিক্যাল কাজ এবং এর জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নামে একটি অফিস আছে। কিন্তু আমরা যেহেতু কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না, তাই আমরা শিক্ষকদের দিয়ে করাই। আবার শিক্ষকরা এ কাজ করার সময় তার একজন সহকর্মী পাশ দিয়ে গেলে লুকিয়ে ফেলি যেন ছাত্রদের নম্বর কোন গোপনীয় বিষয়। আবার শিক্ষকদেরও আমরা বিশ্বাস করি না বলে উত্তরপত্র কোর্স শিক্ষকের বাইরে অন্য আরেকজন শিক্ষক দিয়ে মূল্যায়ন করাই। এ অবিশ্বাসের কারণে ফল প্রকাশে বিলম্ব হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশি অর্থ খরচ হয়, শিক্ষকদের সময়ের অপচয় হয়।
আরো পড়ুন: আমাদের চেয়ে কলকাতার অধ্যাপকের বেতন তিন গুণ বেশি
আমরা যদি শিক্ষকদের জন্য একটি উন্নত স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিই, আর সব ধরনের পার্ট টাইম পড়ানো নিষিদ্ধ করি এবং একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড় থেকে সাত কলেজ নামিয়ে দেওয়া হয়, আমার বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি পাবে। তার ওপর শিক্ষকদেরকে আবাসিক হলের দায়িত্ব থেকেও মুক্ত করা উচিত। আবাসিক হল চালাবে কর্মকর্তারা।
শিক্ষকদের প্রক্টরিয়াল দায়িত্বের মতো পুলিশিং কাজ থেকেও মুক্তি দেওয়া উচিত। প্রক্টরিয়াল কাজতো শিক্ষকদের হতে পারে না। এটির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া উচিত। এইসব করতে হলে লেজুড়বৃত্তি মার্কা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে কর্মকর্তারা এইসব কাজ করতে পারবে না। এ জন্যই এসব কাজ শিক্ষকদের দেওয়া হয়।
যত দিন পর্যন্ত টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ না হবে, যতদিন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড় থেকে সাত কলেজ না নামবে, যতদিন পর্যন্ত উত্তরোত্তর মূল্যায়ন একজন পরীক্ষক দ্বারা করা না হবে, যতদিন পর্যন্ত শিক্ষকদের উন্নত স্বতন্ত্র বেতন স্কেল না হবে, ততদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)