শিক্ষক নিয়োগ: দেশে ও বিদেশে
পাঠদান ও গবেষণার মান নিয়োগকৃত শিক্ষকের মানের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার যে নীতি তা বড়ই গণ্ডগোলের। বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে প্রার্থীকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। এটা বলে দেবার মধ্য দিয়ে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিশ্ব’ অংশটুকুকে অবমাননা করা হয়। বাইরের মানুষের জন্য দ্বার বন্ধ করে দিয়ে কূপমণ্ডুকতার শুরু। এরপর ভালো রেজাল্ট করা মাস্টার্স পাশ করা কোনো প্রার্থীকেই এই পদে যোগ্য মনে করা হয়।
ভারতে একসময় ছিল, মাস্টার্স ছাড়া বাড়তি একটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারতেন। তবে তারা এখন পিএইচডিকে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা শুরু করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে দেখছি পিএইচডি ছাড়া আবেদন করা যায় না। অবশ্য এবিডি বা অল বাট ডিসার্টেশন বলে একটা ক্যাটাগরি আছে, যার অর্থ হলো পিএইচডি করছেন এমন ক্যান্ডিডেট, যার কেবল থিসিসটি জমা দেয়া বাকি।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কিছুকাল পড়িয়েই আবার পিএইচডির পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে চলে যান (দেশের পিএইচডির মান যাচ্ছেতাই, দেশে পিএইচডি করা কারো প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে না)। তাকে সবেতন শিক্ষাছুটি দিতে হয়, অনেকে আবার বিদেশে গিয়ে আর ফেরেন না।
যদি শিক্ষকের পিএইচডি আগে থেকেই করা থাকতো তবে তাকে সবেতনে বিদেশে পাঠাতে হতো না। ওদিকে আবার প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক পদে যদি পিএইচডি করা কোনো আবেদনকারী থাকেও, তার ডিগ্রিকে তেমন মূল্য দেয়া হয় না। নিজ বিভাগের হলে ভিন্ন কথা, অন্য কোথাও থেকে অচেনা কেউ উদয় হলে তার কোনোই মূল্যই নেই। নিয়োগ দেওয়া হয়, নিজেদের পরিচিত-অনুগত কাউকে।
যাহোক নেয়া তো হবে নিজেদের ছাত্র বা ছাত্রীকে, কিন্তু কী নীতিতে? একটা মৌখিক পরীক্ষা থাকে। নিয়োগ বোর্ডের কাছে তার পরীক্ষার ফলাফল ও গবেষণাপত্রের হদিস সামারি আকারে থাকে। যেহেতু কেবলই মৌখিক পরীক্ষা, যাতে শিক্ষক কেমন হবেন, তার যাচাই কমই হয়, সেরা রেজাল্টের কাউকে নিলেই ভালো।
তবে অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগ বোর্ড আগেই খানিক বসে ঠিক করে রাখেন কাকে নেয়া হবে। সেই ‘ঠিক করাটা’য় কয়েকটা বিষয় বিবেচনায় থাকে দলীয় পরিচয় ঠিকঠাক আছে কিনা, আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিনা বা লবিতে কে এগিয়ে? দলীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে যাদের গ্রিন সিগন্যাল জোটে, তাদের মধ্যে আবার বোর্ড সদস্যের নিজস্ব পছন্দের প্রার্থী থাকে, তিনি তাকে পুশ করেন।
এই ঠেলাঠেলিতে কেউ কেউ চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন, কেউ কেউ বাদ পড়েন। তবে সবকিছুর ওপরে উপাচার্যের বিবেচনা চূড়ান্ত থাকে। তিনি যদি নিজে ইনভলভড না হন, তবে ভিন্ন কথা।
আমি তিন দফা এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৯৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধা তালিকায় ২য় ছিলাম, আমরা দুইজন যোগ দিলাম চবিতে। মেধা তালিকায় প্রথম থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম, বাবা-মার আগ্রহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাচের ১ম ও ২য় যারা ছিলেন, তারা আমার আগে যোগ দিয়েছেন।
আমার পরের দুই-তিন ব্যাচের কেউ কেউ আমার আগে ঢাকায় যোগ দিয়েছেন, তারা যার যার ব্যাচে প্রথম দ্বিতীয় ইত্যাদি ছিলেন। আমি আমার ব্যাচে অনার্স-মাস্টার্স উভয় ক্ষেত্রেই ৪র্থ ছিলাম। পরে যখন আমার সুযোগ আসলো, মেধা তালিকায় পঞ্চম হয়ে, আমরা পাঁচ জন যোগ দিলাম ঢাকায়।
আমার নিয়োগটি অস্থায়ী ছিল, এজন্য পরে ভুগতেও হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয় অনার্স-মাস্টার্সের রেজাল্টের ভিত্তিতেই নিয়োগগুলো হয়েছে। এই চর্চা কিন্তু পরে আর টিকে থাকেনি। ওই যে, নব্বই দশকে আমি যখন ছাত্র, যেমন মেধার ভিত্তিতে হলে আসন বণ্টন হতো ছাত্রাবাসগুলোয়, যা পরে উধাও হয়ে গেছে, ব্যাপারটা ওরকম।
আমার চবি ও রাবি নিয়োগে এক্সটার্নাল ছিলেন আমার বিভাগের একজন প্রভাবশালী শিক্ষক। তিনিই ছিলেন মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তিনিই কিন্তু পরে উপাচার্য হয়েছেন। তো যে নীতিতে আগে তিনি নিয়োগ দিতেন, নিজে উপাচার্য হয়ে যেসব নিয়োগে যুক্ত হলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি তো আগের নীতিতে থাকেননি, নিয়োগ নিয়ে যথেচ্ছাচার করেছেন তিনি।
শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে, শিক্ষক নিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেরা প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি এমনিক অনার্স-মাস্টার্সের ফলাফল নয়, দলীয় পরিচয় ও আনুগত্য মুখ্য হয়ে ওঠে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছি। সমাজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা ও মর্যাদা ছিল এমনকি ১৫-২০ বছর আগে, তা অনেকাংশেই লুপ্ত হয়েছে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন কেবল বিসিএস দিয়ে আমলা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। অন্য কোনো স্বপ্ন দেখাতে আর পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর ধরে মন্দ নিয়োগ, দলীয় বিবেচনায় প্রমোশন আর স্বাধীন চিন্তার শিক্ষকদের বঞ্চনা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত পতনের অন্যতম কারণ এগুলোই।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে এই অংশ শেষ করবো। এটাই হয়তো সেরা পদ্ধতি নয়, কিন্তু বাংলাদেশের পদ্ধতি কতটা ত্রুটিপূর্ণ তা বোঝার জন্য এই আলাপটি যথেষ্ট হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা থাকে প্রার্থীকে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে।
ক্ষেত্রবিশেষে তারা এবিডি (যাদের কেবল পিএইচডির থিসিসটা জমা দেয়া বাকি) প্রার্থীকেও আবেদন করার অনুমতি দেয়। সঙ্গে অন্য যেসব বিষয় জমা দিতে হয়। তা হলো: ১। কাভার লেটার, যেখানে আবেদনকারী কেন ওই পদের জন্য যোগ্য তার ব্যাখ্যা দিবেন, তার গবেষণা ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার বর্ণনাসহ (এবিডি বা পিএইচডি গবেষকের কিছু শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও থাকে, কারণ তিনি টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যে বৃত্তি পান তার অংশ হিসেবে সুপারভাইজার বা সিনিয়র প্রফেসরকে সার্বিকভাবে সাহায্য করতে হয়, যার মধ্যে ক্লাস নেয়াও থাকে, একটা দুটো গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশনাও থাকে)
২। জীবনবৃত্তান্ত। ৩। একটি প্রকাশিত গবেষণাপত্রের অনুলিপি ৪। শিক্ষাদর্শন বিষয়ে স্টেটমেন্ট (শিক্ষকতাকে তিনি কী দৃষ্টিতে দেখেন, পাঠদানের পদ্ধতি কী ইত্যাদি) ৫। ডিগ্রির ট্রান্সক্রিপ্ট (এখানে এসএসসি বা এইচএসসি ধরনের ডিগ্রির সনদ বা ট্রান্সক্রিপ্ট কেন, অনেকক্ষেত্রে অনার্স-মাস্টার্স এসব ডিগ্রিও চাওয়া হয় না, পিএইচডির ট্রান্সক্রিপ্ট যথেষ্ট হয়) এর বাইরেও আরো কিছু ডকুমেন্ট (যেমন ডাইভার্সিটি/ইকুয়ালিটি স্টেটমেন্ট, অর্থাৎ তিনি কীভাবে সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবেন) দিতে হতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, যে হায়ারিং কমিটি এসবকিছু দেখভাল করেন, সেই জনাপাঁচেক সদস্য সবাই বিভাগ থেকেই থাকেন। কমিটির প্রধান বিভাগের প্রধান হতেও পারেন, নাও পারেন। এক্ষেত্রে ডিন, ভিসি-প্রোভিসি (যুক্তরাষ্ট্রে বলে প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট) কেউই কমিটিতে থাকেন না।
বলতে হবে, নিয়োগের শুরুর পদই থাকে সহকারী অধ্যাপক, সব সুযোগসুবিধাসহ এই পদটিকে বলা হয়ে থাকে টেনিউর ট্র্যাক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। নন-টেনিউর ট্র্যাক পূর্ণকালীন সহকারী অধ্যাপকও নিয়োগ দেয়া হয়, সেখানে সুযোগ-সুবিধা কিছু কম থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনার ‘বাজার’টি বেশ প্রতিযোগিতামূলক। তাই একটি টেনিউর ট্র্যাক পদে, ১০০ থেকে ২০০ আবেদন পড়ে। হায়ারিং কমিটি এসব থেকে বাছাই করে ৮/১০জনের শর্টলিস্ট করেন। ওপরে যেসব ডকুমেন্টের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কোন ইউনিভার্সিটির পিএইচডি, সেটা হয়তো কিছুটা বিবেচনায় থাকতে পারে, কোথা থেকে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ২/৩ পৃষ্ঠার কাভার লেটারটিই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বা খুঁটিয়ে পড়া হয়।
শর্টলিস্টের ৮/১০জনকে জুমে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। সেখান থেকে জনা তিনেক প্রার্থীকে নির্বাচন করে, ক্যাম্পাস ভিজিটে ডাকা হয়। এদের রেফারির কাছ থেকে রেফারেন্স লেটার সংগ্রহ করা হয়। প্রার্থী যে শহরেই বসবাস করেন না কেন, তাকে প্লেন ভ্রমণের খরচ দিয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ডাকে। প্রার্থীকে সেখানে গিয়ে ক্লাসের ডেমোনেস্ট্রেশন দিতে হয়, কমিটির সদস্যদের সাথে লাঞ্চ করতে হয়, কথাবার্তা বলতে হয়।
এই ক্যাম্পাস ভিজিটের সময় পরীক্ষকরা তাকে পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন যে কলিগ হিসেবে তিনি কেমন হবেন। এই পর্যায়ে ডিন বা প্রেসিডেন্টের সাথে মুখোমুখি মিটিং থাকে। তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে চাকরির অফার করা হয়, তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাড়া না দিলে লিস্টের পরেরজনকে অফারটি দেয়া হয়।
এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন প্রার্থীর জ্ঞানগত, পাঠদানগত ও আচরণগত সব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়ে যায়, বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী। এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনীতি বা দলীয় বিবেচনা নেই, কোনো এসএসসি বা এইচএসসির মার্কশিট নেই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তার অংশগ্রহণ নেই। যে বিভাগে প্রার্থী সেবা দেবেন, সেই বিভাগের লোকজনই পুরো বিষয়টি দেখভাল করেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসমেত।
বেতনকড়ি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ডিন যুক্ত হতে পারেন। প্রার্থীর যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বেতনও কমবেশি হতে পারে। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কীভাবে হয়? ভিসি-প্রোভিসি-ডিন সবাই যুক্ত থাকেন। রেজাল্টের পাশাপাশি প্রার্থীর দলীয় পরিচয় ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করা হয়। পিএইচডির দরকার হয় না।
বেশি বুদ্ধিমান বা বিদেশি/উচ্চতর ডিগ্রি যেন অযোগ্যতা, এ ধরনের প্রার্থীকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করা যাবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। নেতা-শিক্ষকের পেছন পেছন ঘোরা কর্মী বা ভোটার প্রার্থীই অগ্রাধিকার পেয়ে যায়। একটু পেছনের দিকের রেজাল্ট হলেই ভালো, তাকে যেমন খুশি ‘ব্যবহার’ করা যাবে, দলীয় রঙিন কাগজ বিলিতে কাজে লাগানো সম্ভব, ক্যাম্পাস চত্বরে বা সামাজিক মাধ্যমে প্রয়োজনে তাকে লাঠিয়াল বা ক্যাডারের মতো ব্যবহার করা যাবে।
লেখক: ভিজিটিং অধ্যাপক, বার্ড কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র।