৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৪

শীতকালে পথশিশুদের নিয়ে ভাবনা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের

  © টিডিসি ফটো

শীত আমাদের দেশের প্রধান ঋতুগুলোর মধ্যে একটি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস হলো শীতের ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে দুর্ভোগের অন্ত থাকে না, অনেকেই ঠান্ডাজনিত রোগসহ নানা রোগে ভোগেন। তবে এ দুর্ভোগ ধনী মানুষদের জন্য না, তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। বিশেষ করে পথশিশুদের জন্য। শীতকালে পথশিশুদের নিয়ে কী ভাবছেন তরুণেরা? কথা ছয় জন মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীর সাথে। মতামত নিয়েছেন- শাহ বিলিয়া জুলফিকার 

১. ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়াক
আমাদের কাছে শীত মানেই- গরম ধোঁয়া উঠানো ভাপা পিঠা, খেজুর রসের হাঁড়ি, ঘাসের মধ্যে লেগে থাকা শিশিরকণা, কিংবা শপিংমলে লাল-নীল হুডি-জ্যাকেট কেনার হিরিক, সুখনিদ্রায় কম্বলমুড়ানো সকাল। কিন্তু রাস্তায় পড়ে থাকা জীর্ণশীর্ণ পথশিশুটার কাছে শীত মানে- খড়কুটোকে সঙ্গী করে আরেকটা দিন বাঁচার সংগ্রাম, ভোর সকালে নর্দমায় খুঁজে বেড়ানো একটা প্লাস্টিকের বোতল, পিচ ঢালা রাস্তায় গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকা নির্ঘুম রাত। জ্বর, ডায়রিয়া, সর্দি কাশি উপেক্ষা করে অনাহারে অনিরাপদে থাকা দুর্বিষহ একটা দিন। শীতের শুষ্কতা রিক্ততা যেন এক জীবন নামক নরক্ষেত্র তাদের জন্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তথ্য মতে বাংলাদেশে পথশিশু আছে প্রায় ৪ লাখ, ইউনিসেফের তথ্য মতো তা ১০ লাখের কাছাকাছি। সংখ্যাটা শুনলেই কেমন গা শিউরে উঠে না! যে এতো পরিমাণ শিশুর থাকার জায়গা নেই, খাদ্য পুষ্টি, শিক্ষা চিকিৎসা তো দুরেই রয়ে গেল। আমরা পুঁথি বিদ্যায় পড়ি যে ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ কিন্তু শিশুরা আজ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অনিরাপদে অনাহারে, ব্যবহৃত হচ্ছে- মাদক চালানের ট্রানজিট হিসেবে। তারা কিভাবে ভবিষ্যৎ এর কান্ডারী হবে! এই শত শত ফুলের মতো শিশুরা তো উদ্ভাসিত হওয়ার আগেই ঝড়ে যায় সমাজের নির্মম কষাঘাতে, প্রতিকূলতায়। আমি আপনিই পারি সমাজের এই বঞ্চিত পথশিশুদের পাশে এগিয়ে আসতে। আমাদের ভালোবাসার উষ্ণতায় পথশিশুরা দেখতে পারে রঙ্গিন দিনের স্বপ্ন।

আব্দুল্লাহ ইবনে সাইদ
শিক্ষার্থী, ক্রপ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

২. মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিব 
আমাদের সমাজে পথশিশু এমন একটা শ্রেণি যাদের সম্পর্কে আমাদের কমবেশি সবার ধারণা থাকলেও তাদেরকে নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ১৯৮৯ সালে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ শিরোনামে একটা বই ছাপানো হয়। সেখানে তিনি পথশিশুদের বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কথা বলেন।কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো এই যে, আজ এতো বছর পরেও সেই একই ভাবনা আমাদের ভাবতে হয়। বাংলাদেশে একজন শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর তার ছয়টি মৌলিক অধিকার আবির্ভূত হয়; খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা।যা একজন পথশিশু তার কোনটিই ঠিক মতো পায় না। তাই আমি মনে করি আমাদের পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার পূর্বে আমাদের উচিত তাদের মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দেওয়া।তবে কাজগুলো যে শুধুমাত্র একটা দেশের সরকার করবে এমনটা নয়। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব থাকে তাদের স্বার্থে কাজ করা। আমার জানা মতে এমন অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যারা প্রতিনিয়ত পথশিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পথশিশুদের জন্য ছোট বড় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেছে।

মেহেদী হাসান রনি
শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় 

৩. শীত হোক আনন্দনয় 
বৈচিত্র্যময় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এই বৈচিত্র্যের ধারাবাহিকতায় নিয়ে আসে কুয়াশাচ্ছান্ন, শিশির ভেজা ঘাসের স্নিগ্ধ শীতকাল। কিন্তু অনেকেই এই স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে পারে না। তাদের মধ্যে একদল হচ্ছে পথশিশু। আমাদের একটু চেষ্টাই পথশিশুদের জন্য শীতকাল হতে পারে আনন্দময়ী ঋতু। শীতের কনকনে ঠান্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমারা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে পারি। এছাড়াও শীতের হরেকরকমের পিঠা হয়ে থাকে। যা পথশিশুদের খাওয়াতে পারি। শীতের সময়  ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। তা থেকে পরিত্রাণের জন্য পথশিশুদের প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করতে পারি। আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ শুরু করে দেই। তা হতে পারে পথশিশুদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ এর মাধ্যমে, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পিং এর মাধ্যমে, কিংবা খাদ্য সরবরাহ এর মাধ্যমে কিংবা সমাজের বিত্তবানদের কাছে পথশিশুদের দুঃখ কষ্টের কথাগুলো পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। আমাদের কথা কাজেই আসবে সমাজের পরিবর্তন, শিশুদের নির্মল হাসিতে হাসবে পুরো দেশ। আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে পথশিশুদেরও শীতকাল হয়ে উঠতে পারে আনন্দময়ী ঋতু।

তানজিলা তন্বী 
শিক্ষার্থী, ন্যাশনাল কলেজ অব হোম, অর্থনীতি বিভাগ 

৪. এগিয়ে আসি পথশিশুদের পাশে 
আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটির বেশি, তার মধ্যে প্রায় ১ কোটি মানুষ অতিদরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তাদের শীত নিবারণের সামর্থ্য থাকে না, তাই শীত তাদের জন্য অভিশাপ রুপে আবির্ভূত হয়। তবে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পোহাতে হয় পথ শিশুদের। কারণ তাদের থাকার ঘর-বাড়ি নেই, পথে-ঘাটে রাত যাপন করতে হয়।শীতের রাতগুলোতে থাকে অসহনীয় ঠান্ডা। এ কারণে অনেক পথ শিশু মারা যায়। বর্তমানে আমাদের এ দেশে পথ শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখের বেশি। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের সবায় কি শীত নিবারণের জন্য পোশাক পরিধান করতে পারছে? সম্ববত উত্তরটি হবে, ‘না’। চরম কষ্টে জীবনযাপন করে এসকল শীতার্ত পথ শিশু। আমরা ইচ্ছে করলেই এসকল দরিদ্র পথ শিশুদের সাহায্য করতে পারি। হোক না তা একটি কম্বল কিংবা পুরনো কাপড় দিয়ে। একজন দরিদ্র পথ শিশুকে সাহায্য করতে কোটিপতি হতে হয় না, দরকার মানবিক  হওয়া। কেননা, তাদের কে সাহায্য করতে, প্রথমত একজন মানুষ হিসেবে আমাদের রয়েছে মানবিক দায়িত্ব। তাছাড়া সামাজিক দায়িত্ব তো রয়েছেই। তাহলে আসুন একটু তাদের নিয়ে ভাবি, সুবিধা বঞ্চিত পথ শিশুদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসি।

ইসরাত জাহান পরশমণি 
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

৫. সহানুভূতিশীল হতে হবে
বছর ঘুরে আবার এলো শীতকাল।উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষের প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠা ও জীবন সংগ্রাম কবি ও সাহিত্যিকদের কাছে শিল্প হতে পারে কিন্তু বাস্তবতা কতোটা ভয়াবহ তা একমাত্র ভুক্তভোগী উপলব্ধি করতে পারে। শহরের বাবুরা সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠলেও এদের উঠতে হয় প্রত্যুষে। নয়তো আধপেটা কিংবা অনাহারে থাকতে হয় তার পরিবার নিয়ে। পথ শিশুদের কথা বলতেই হচ্ছে, আমরা রেললাইন ও শহরের অলিগলিতে হাজার হাজার পথশিশু দেখতে পাই। নিরাশ্রয়ে টুটু করে ঘুরে বেড়ায় এ সকল শিশুরা। এক টুকরো কাপড় দিয়ে শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে চায় এরা। এরচেয়ে  ভয়ঙ্কর জীবন আর হত পারে না। ফুটপাতে পরে থাকা শিশুদের আহাজারি নিস্তব্ধ করে দেয় সহানুভূতিশীল মানুষদের। তারা চেষ্টা করে কিছুটা সমব্যথী হতে, একটু সহমর্মিতা দেখাতে। এমন অনুভূতি আমাদের সবার হওয়া উচিত। একটু সহানুভূতিতে স্বস্তি পেতে পারে তাদের করুণ জীবনের গ্লানি। শীতে গ্রামে ও শহরে পিঠাপুলির ধুম পরে যায়। কতো আয়োজনে পালনীয় হয় পিঠা উৎসব। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষদের হয় না সে উৎসব উৎযাপনের সৌভাগ্য। মরে মরে বেঁচে থাকাটা যাদের অভ্যাস হয়ে গেছে তারা আনন্দ করবে কীভাবে? আমাদের একটু সহযোগিতা, একটু সহমর্মিতা পারে তাদের নিষ্ঠুর জীবনের ইতি টানতে।

ইলিয়াস আহমেদ 
শিক্ষার্থী, বাংলা সাহিত্য বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

৬. সাধ্যমত চেষ্টা করবো
বাংলাদেশে ছয়টি ঋতুর মধ্যে হেমন্তের পরে আসে শীত ঋতু।এই শীত কাল প্রকৃতিতে দেয় রুক্ষতা। শীতকালকে ঘিরে কত উৎসব, কত আনন্দ,কত আমেজ, পিঠা খাওয়ার উৎসব। কিন্তু এই উৎসব, আমেজ কি সবার জন্য? না সবার জন্য না। যেখানে আমরা শীতের উৎসব, পিঠার উৎসব নিয়ে ব্যস্ত সেখানে আমাদের সমাজেরই এক শ্রেণীর মানুষ শীতের কবল থেকে রক্ষা পেতে তাদের নূন্যতম কাপড় টুকু যাদের কপালে জুটে না তারা সত্যিই হতভাগা। পিঠার উৎসব, আমেজ, আনন্দ তাদের কাছে কল্পনায় মনে হয়। এই শীতার্তদের মধ্যে পথশিশুরা অন্যতম। তারা অসহনীয় যন্ত্রণায় ভোগে শীতকালে। তাদের এই দুঃখ কষ্ট দেখার মত কেউ নেই। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন কারণে পিতা মাতা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভবঘুরে জীবন যাপন করে। শীতের সন্ধ্যায় যখন সবারই ঘরে ফেরার তাড়া ঠিক তখন এই ঠিকানা বিহীন পথশিশুরা একটু আরামদায়ক জায়গা, কাপড় খুঁজে যাতে করে তারা এই কনকনে শীতের রাতে একটু শান্তি মত ঘুমাতে পারে। এইসব পথশিশুদের বিশেষ করে বেশি দেখা যায় রেলওয়ে স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে। আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ নং অনুচ্ছেদে মৌলিক প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি তারা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে? তাদের এই দুঃখ কষ্ট লাগবে সরকার, বিত্তবান ব্যাক্তিদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিছু কিছু কার্যক্রম চলমান আছে যেগুলো গৃহহীন পথশিশুদের, শীতার্তদের সাহায্যের প্রচেষ্টা করছে যেমন মানবিক দেয়াল যেখানে মানুষ তার অব্যবহৃত কাপড় রেখে যায় এবং যার প্রয়োজন সে নিয়ে যায়। সত্যিই এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য মহৎ ও প্রশংসার যোগ্য। পথশিশুরাও মানুষ, ওদেরও মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার রয়েছে। আসুন আমরা সবাই মিলে সবার সাধ্যমত সাহায্যের চেষ্টা করি।

শাকিল আনোয়ার 
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়