বিজয় ভাবনা: মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সাংবাদিকদের ভূমিকা ও আমাদের শ্রদ্ধা
২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনা ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ পেয়েছে তার স্বাধীনতা ও চূড়ান্ত বিজয়। এই মহান স্বাধীনতার পেছনে সরবে-নিরবে ভূমিকা রেখেছেন দেশপ্রেমিক জনতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শিক্ষক-ছাত্র আবাল বৃদ্ধি-বনিতা অনেকেই। এর বাইরেও জীবন বাজি রেখে ভূমিকা রেখেছিলেন কিছু বিদেশী ব্যক্তিবর্গ; যাদের কথা না বললেই নয়- তারা হচ্ছেন বিদেশী সাংবাদিকবৃন্দ। তাদের অবদানের ফলেই বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে কতটা লাঞ্ছিত, বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বাংলার মানুষেরা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বহির্বিশ্বের নাগরিকদের অবদান ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুকে চলা মা-বোনদের ওপর নির্যাতন নির্মমতা, নিরীহ বাঙালিদের ওপর চলা হত্যাযজ্ঞ- অন্যায় অবিচারের কথা দেশের বাইরে তারা পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে আবার কেউবা গান ও কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন পাকিস্তান বাহিনীর নির্মমতা কথা। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে উঠেছে বিশ্ব জনমত। ত্বরান্বিত হয়েছে বাংলাদেশের বিজয়ের পথ।
মূলত কিছু সাহসী সাংবাদিক জীবনবাজি রেখে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্মমতা এবং শরণার্থীদের দুর্বিষহ দুর্ভোগ বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিল। বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র। এক্ষেত্রে ডেইলি টেলিগ্রাফ, দ্য সানডে টাইমস, দ্য লন্ডন উইক-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে তা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশে ভূমিকা রেখেছেন। যারা এই অসীম সাহসী কাজটি করেছেন তাদের মধ্যে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, পল কনেট দম্পতি, সিডনি শ্যানবার্গ, মার্ক টালি, অঁদ্রে মারলো, সাইমন ড্রিং, ডাব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড, অ্যালেন গিন্সবার্গ উল্লেখযোগ্য। যারা বিশ্ব দরবারে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা সোচ্চারভাবে প্রচার করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন অকৃত্রিম এসব বন্ধুদের মধ্যে সাইমন ড্রিং বাংলাদেশে এসেছিলেন টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে। তিনি ১৯৭১ সালে দেশের অবস্থা খারাপ হলে দেশত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিন্যানটালে। ২৭ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পরেন ঢাকা শহরে। ঢাকার বুকে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের লুটপাটের চিত্র প্রত্যক্ষ করে পালিয়ে যান ব্যাংককে। সেখান থেকে প্রকাশ করলেন TANKS CRUSH REVOLT IN PAKISTAN। যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারলেন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা- যার ফলে বিশ্ব বিবেক নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।
তেমনি সিডিনি শ্যানবার্গ ছিলেন দি নিউইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিক। তিনিও সালের গণহত্যা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। শরণার্থীদের দুর্দশা চিত্র প্রত্যক্ষ করে তিনি প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খণ্ড। তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের দুর্ভোগ। তাঁর প্রতিবেদনসমূহের নির্বাচিত সংকলন Dateline Bangladesh, 1971 বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ডকুমেন্ট হয়ে এখনো আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এইসব অকৃত্রিম বন্ধুদের অবিস্মরণীয় অবদান থাকলেও আমাদের বই-পুস্তকে-সাহিত্যে তাঁদের কথা খুব কমই উল্লেখ আছে। এছাড়া মহান বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের আলোচনায় তাদের কথা তেমন আলোচিত হয় না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। বিজয়ের এই দিনে আমি শ্রদ্ধাচিত্তে তাঁদের অবদান স্মরণ করছি। আমার আশা, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিকদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের ভূমিকা পাঠ্যবইয়ে স্থান পাবে কিংবা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তাদের অবদান বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হবে। সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি