নতুন শিক্ষাক্রমের যে দিকগুলো নিয়ে আমার অভিযোগ
নতুন শিক্ষাক্রমের কোন কোন জায়গা নিয়ে আমার অভিযোগ? কিংবা বলা যায়, আমার দৃষ্টিতে নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যাগুলো কোথায়? কেন নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আমি এত উদ্বিগ্ন? প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া জরুরি মনে করে এখন লিখছি। বিচ্ছিন্নভাবে এর উত্তর অনেকবার আগে দিয়েছি। তবে এখন এক সাথে একটা লজিক্যাল ফ্লো রেখে বলার চেষ্টা করব।
প্রথমত, একটি দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম একটি ব্যাপক বিষয়, যার দ্বারা একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তথা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। এটার এত সুদূরপ্রসারী ইমপ্যাক্ট যে, এটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। যেহেতু এটার ব্যাপক ইমপ্যাক্ট থাকে, সেহেতু এর পরিবর্তন আনতে হয় একসঙ্গে অনেক মানুষের অনেক ভাবনার পর। তাছাড়া যেহেতু পরিবর্তনের ফলাফল দেখা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সেহেতু এর পরিবর্তন আনতে হয় একটু একটু করে। কখনোই ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি নয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে আমার ধারণা এটিই প্রথম, যেখানে একবারে শতভাগ পরিবর্তন শুধু একটি ক্লাসে না বরং পুরো ১২টি ক্লাসের। আর পরিবর্তনের ব্যাপ্তিও বিশাল। বই থেকে শুরু করে বইয়ের কনটেন্ট, শেখা ও শিখনের দর্শন এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি। কোন দেশে বিপ্লবের পরও সম্ভবত এরকমভাবে শতভাগ পরিবর্তন আনে না। এটা নিঃসন্দেহে গিনেস বুকে বিশ্ব রেকর্ড হবে। সুতরাং এখানে আমার আপত্তির একটা বড় জায়গা।
দ্বিতীয়ত, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে প্রতি শ্রেণিতেই এ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বা ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নামক বিষয়ের সংযুক্তি। একজন শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান শেখানোর আগে কীভাবে আমরা প্রযুক্তি বিদ্যা দিই। তার ওপর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টাই অন্তর্জাল নির্ভর। ফলে শিক্ষার্থীরা অল্প বয়সেই ডিভাইসমুখী হবে। অনেকেই হয়ত জানেন আমর স্ত্রী ইউরোপিয়ান। আমার সন্তান জন্মের পর অনেক ছোট বয়স থেকে যখন তারা কথা বলতে পারে না, তখন থেকেই কোলে নিয়ে আমরা বই পড়েছি।
বুঝুক না বুঝোক, কিংবা শুনুক আর না শুনুক। বই পড়া শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়েছি। ঘুম পাড়ানির কবিতা পড়তে পড়তে ঘুম পাড়িয়েছি। জন্ম থেকে দেখে এসেছে, সারা বাড়িজুড়ে বই। বিছানার পাশে, ড্রয়িং রুমে, বুক সেলফে, স্টাডি রুমে, ডাইনিং টেবিলে সর্বত্র। বড় কন্যা মোবাইল পেয়েছে ‘ও’ লেভেল পাশ করার পর। ছোট মেয়ে তার একটু আগে। কারণ করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস হয়েছে।
আরেকটি কারণ (এবং এটি আরো গুরুতর) হলো বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তি শেখানো যায় না। অথচ এ বিষয়টিকে একদম দশম শ্রেণি এমনকি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নকে এক করে ছোট করে একটি বিষয় বানিয়ে তথ্য-প্রযুক্তিকে একটি বিষয় রাখা। পৃথিবীর কোথায় এটিকে কারিকুলামে যুক্ত করে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়? জীবন ও জীবিকা। এইটাতো একটা কারিগরি মাধ্যমের শিক্ষা। এইটা কি করে মূল ধারার কারিকুলামে যুক্ত হয়?
একটি দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম একটি ব্যাপক বিষয়, যার দ্বারা একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তথা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। এটার এত সুদূরপ্রসারী ইমপ্যাক্ট যে, এটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। যেহেতু এটার ব্যাপক ইমপ্যাক্ট থাকে, সেহেতু এর পরিবর্তন আনতে হয় একসঙ্গে অনেক মানুষের অনেক ভাবনার পর। তাছাড়া যেহেতু পরিবর্তনের ফলাফল দেখা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সেহেতু এর পরিবর্তন আনতে হয় একটু একটু করে। কখনোই ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি নয়।
ইংরেজি মাধ্যমে আছে? নেই। পৃথিবীর অন্য কোথাও এরকম কারিকুলামে ঢুকিয়ে দেয়নি। এই দুটো না থাকলে বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়কে আমরা আলাদা করে তাদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে পড়াতে পারতাম। এ তথ্য-প্রযুক্তি এবং জীবন ও জীবিকা কার পরামর্শে শিক্ষার মূল ধারায় পদার্থবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান ও রসায়নকে দুর্বল করার বিনিময়ে ঢুকানো হলো?
তৃতীয়ত, বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে আগে অল্পবিস্তর যেটুকুবা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল, সেটাও কেড়ে নেওয়া হলো। অথচ এ দেশেই ইংরেজি মাধ্যম আছে। সেখানে নবম শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ভাষা ব্যতীত বাকি বিষয়গুলো তাদের ইচ্ছেমতো নির্বাচন করতে পারে। হ্যা, সেখানে বিভাগে বিভাজন নেই। কিন্তু বিভাগ বিভাজন যতটা স্বাধীনতা দেয়, তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা আছে। কে ক’টি বিষয় নিয়ে ও-লেভেল পরীক্ষা দেবে, সেখানেও স্বাধীনতা আছে।
বিভাগ উঠিয়ে দেওয়ার কারণে একটি গুরুতর বিষয় ঘটে গেছে। যেহেতু সবাইকে ঘাড় ধরে ১০টি বিষয়ই পড়তে বাধ্য করা হবে, সেহেতু আগে বিজ্ঞানের যেসব চ্যালেঞ্জিং ও একটু টেকনিক্যাল বিষয় যেমন উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের একটু জটিল জিনিস রাখা যাবে না। কারণ তাহলে সবাই পারবে না। অনেকের এগুলো একটু চ্যালেঞ্জিং ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলো কঠিন মনে হতো বলেই তারা মানবিক বা ব্যবসা বিভাগ নিত।
আরো পড়ুন: নতুন কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা, গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবি
তাহলে কি ঘটল? সবার জন্য করতে গিয়ে বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জিং ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর কোনো কোনোটি হয় বাদ দিতে হয়েছে (যেমন উচ্চতর গণিত), নাহয় তাদের ধার ভোঁতা করতে হয়েছে। যেমন- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। আগের মানবিক বিভাগে যারা পড়তো, তারা কি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারত? উত্তর হলো না। আগে বিজ্ঞান বিভাগে যারা পড়তো, তারা কি মানবিকের বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতো? উত্তর হলো হ্যা।
তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম যে বিজ্ঞানের ধার কমিয়ে মানবিকের দিকে শিফট করা হলো, তাতে তাদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বিজ্ঞানের বিষয় পড়তে অসুবিধা হবে। এছাড়া এ নতুন শিক্ষাক্রম পড়ে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করবে, তাদের সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমে পাস করা শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা অনেক কম জানবে এবং কম শিখবে। আপাতত এটুকুই।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়