বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ-প্রমোশন পদ্ধতিটা ছেলেখেলা হয়ে গেছে
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স করা এবং দুটোতেই প্রথম হওয়া একজন শিক্ষার্থীর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস বন্ধু তালিকায় থাকা একজন প্রিয় মানুষ রাউফুল আলম শেয়ার করায় নজরে এলো। লেখাটির একটা শিরোনাম ছিল এবং সেটি হলো "এদেশের উচ্চশিক্ষাকে কারা ধ্বংস করেছে?" শেখ ফরিদ লিখেছে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম হওয়ার পর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ভাইভা দেই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ততদিনে আমার ৩টা পাব্লিকেশিনও ছিল। নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন তৎকালীন ভিসি ওয়াহিদুজ্জামান চান আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবুল হোসেনসহ মোট ৫ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার মেধা তালিকায় ১-৫ এর মধ্যে ছিলাম, এরকম আমরা ২০ জনের উপরে ভাইভা দিয়েছিল সেদিন। এদের মধ্যে আমরা দুইজন এখন ইউএসএ পিএইচডি করছি, একজন ইউএসএতে পোস্ট-ডক করছেন, একজন কানাডায় পিএইচডি করছেন। মেধা তালিকায় পজিশনে ছিল এমন কেউই সেই বোর্ডে নিয়োগ পায়নি। নিয়োগ বোর্ডে থাকা এই ৫ জন 'প্রগতিশীল' চেতনার হকারের একজনও বলেনি যে মেরিটোক্রেসির ভিত্তিতে অন্তত একজনকে নিয়োগ দেন। সেদিনের সেই ভাইভার পর আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই দেশ কারা চালায়, এদেশের উচ্চশিক্ষা কাদের হাতে জিম্মি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কোথাও ভাইভা দিবোনা।"
শুধু শেখ ফরিদ না। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর এইরকম আরেকটি স্ট্যাটাস পড়েছিলাম। তার লেখার শিরোনাম ছিল "১২ অক্টোবরের বিভীষিকা--"! বর্তমানে সে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। তার লেখার প্রথম প্যারাগ্রাফটি হলো "যখন এই লেখাটা শুরু করলাম ইংল্যান্ডে ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২.০৪ মিনিট, বাংলাদেশে সময় ভোর ৫.০৪। বছর ঘুরে ১২ অক্টোবর চলে আসল আবার। গত বছর এই তারিখ টা আমার জীবনে অনেক আনন্দের একটা দিন হওয়ার কথা থাকলেও, দিন শেষে অনেক বিভীষিকাময় একটা দিনে পরিণত হয়। গত বছর এই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা বোর্ড ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়; পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ, আমার বিভাগ, যেই বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্রী ছিলাম আমি, সবসময় সবজায়গায় নিজের কাজ আর পরিশ্রম দ্বারা যেই বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেছি অথবা করার চেষ্টা করেছি আমি—সেই জায়গাতেই দিনশেষে অযোগ্য বিবেচিত হয়েছিলাম আমি। গত ৩৬৫ দিনে এমন দিন খুব কমই আছে যেদিন আমার এটা মনে হয়নি অথবা এটা মনে করে আমি কষ্ট পাইনি।"
শুধু এই দুইজন না। আমি নিজে এইরকম অসংখ্য মেসেজ পেয়েছি যারা বিদেশে পিএইচডি করে কিংবা পিএইচডি ও পোস্টডক করে দেশে ফিরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করে অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ কার্ড পর্যন্ত পায়নি। কখনো কখনো কার্ড পেলেও সদ্য মাস্টার্স করা কাউকে নিয়েছে। নানা অজুহাতে পিএইচডি করা বা পোস্টডক করাদের বাদ দেওয়া হয়।
আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন পদ্ধতিটা খুবই ছেলেখেলা হয়ে গেছে। অথচ সারা বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগ অনেকগুলো স্তরে বিভক্ত করে প্রত্যেকটি স্তরে বিশদভাবে ফিল্টার করে প্রার্থীদের শর্টলিস্ট করতে করতে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে যোগ্য কয়েকজনকে ইন্টারভিউ এর জন্য অন ক্যাম্পাসে ডাকা হয়। এই অন ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয় দিনব্যাপী। বিভাগে একটি সেমিনার দিতে বলা হয় যেখানে শিক্ষক ছাত্রছাত্রী সবাই উপস্থিত থাকবে। সেমিনার শেষে বিভাগের শিক্ষকরা সবাই মিলে ওই প্রার্থীর সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় একসাথে খেতে যাবে। খেতে খেতে অনেকেই অনেক বিষয়ে তার সাথে কথা বলবে এবং দিন শেষে প্রার্থী চলে গেলে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আর আমাদের দেশে কি ঘটে? প্রত্যেকটা নিয়োগ বোর্ডের প্রধান থাকেন উপাচার্য অথবা উপ-উপাচার্য। এছাড়া নিয়োগ বোর্ডে থাকে রেস্পেক্টিভ বিভাগের চেয়ারম্যান, রেস্পেক্টিভ অনুষদের ডিন, উপাচার্য দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত হন একজন এক্সটার্নাল ও বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড আছে সবগুলোর নেতৃত্ব দেন উপাচার্য স্বয়ং অথবা উপ-উপাচার্য এবং বাকিদের প্রায় সবাই তার নিয়োগ দেওয়া সদস্য।
শিক্ষকরা রাজনীতি করে, উপাচার্য হন রাজনীতি করে তাই পুরো প্রসেসটাই একটা রাজনৈতিক সিন্ডিকেটে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ আজ থেকে ১০০ বছর আগে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নিয়োগ বোর্ডে এক্সটার্নাল হিসাবে ছিলেন জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদ আর্নল্ড সমারফিল্ড যার চারজন পিএইচডি ছাত্র (Heisenberg, Pauli, Debye, এবং Hans Bethe) এবং তিনজন পোস্ট-ডক নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল। তাছাড়া তার ছাত্র ছিল Peierls, Lenz, Meissner, Landé, এবং Brillouin সহ অসংখ্য।
সেই বোর্ডে অধ্যাপক পদের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন সত্যেন বোস এবং ডি এম বোস। সত্যেন বোসের জন্য রেকমেন্ডেশন লেটার পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। তাদের কাগজপত্র দেখে আর্নল্ড সমারফিল্ড সুপারিশ করেছিলেন ডি এম বোসকে। ডি এম বোস শেষ পর্যন্ত যোগ না দেওয়ায় সত্যেন বোসই অধ্যাপক হয়েছিলেন। আজি হতে শত বর্ষ আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডে কারা এবং কেমন মানের মানুষ থাকতেন আর এখন কেমন থাকেন একটু চিন্তা করলেই দেশের উচ্চ শিক্ষার মান কেন অধঃপতিত হচ্ছে বোঝা যাবে।
আরও পড়ুন: বিজ্ঞান না জেনে তথ্য-প্রযুক্তি পড়ে প্রযুক্তিবিদ নয়, হবে টেকনিশিয়ান
১০০ বছর আগে প্রভাষক নিয়োগ হতো এবং যোগ্যতা ছিল মাস্টার্স পাশ। এটি সারা বিশ্বেই ছিল। অনেক বছর যাবৎ পৃথিবীর সকল ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি এবং বিজ্ঞান অনুষদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিএইচডির সাথে এক থেকে দুটি পোস্ট-ডকও লাগে। আমরা এই ক্ষেত্রে ১০০ বছরে একটুও পরিবর্তন করিনি। ১০০ বছর আগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আর আজকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তাবলী একই। অর্থাৎ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নিজেদের পরিবর্তন করিনি। দিন দিন নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা কঠিন হয়। আর আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের নীতিমালা কেবল সহজই হয়েছে। এই সহজীকরণের একটি বড় ধাপ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জার্নাল। জার্নালতো না যেন প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা প্রবন্ধ ছাপানোর কারখানা।
নিজের দেশের, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের, নিজেদের দ্বারা পরিচালিত জার্নাল পৃথিবীর কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে বলে আমার জানা নাই। এছাড়া নিয়োগ বোর্ডে এখন আর বিদেশী কেউ থাকে না। ফলে একদম ফ্রি হ্যান্ডে নিজেদের দলের দলান্ধতার কষ্টিপাথরে ঘষে প্রমান সাপেক্ষে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগ বোর্ডের বিশেষজ্ঞ সদস্যদের biodata দেখুন টের পাবেন ইচ্ছে করে অযোগ্য দলান্ধদের এইসব বোর্ডে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই দেশে উচ্চ শিক্ষার মান ভালো হওয়ার আশা কিভাবে করি।
প্রায় প্রতিটা বিভাগে এমন একজন দলান্ধ নিয়োগ পান যে তিনিই হয়ে উঠেন শিক্ষক হওয়ার সিঁড়ি। শিক্ষার্থীরা বুঝে যায় কার সাথে থিসিস করলে, কার সাথে সখ্যতা থাকলে শিক্ষক হওয়া যাবে। এইভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জেনেরেশনের মেরুদন্ডও নষ্ট করে দিচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিকতাকে নষ্ট করে দিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের দোষ নাই। দোষ আমাদের যারা এই পদ্ধতির মাধ্যমে দলান্ধদের নিয়োগ বোর্ডে সদস্য বানাই। সময় এসেছে প্রতিটি দরখাস্ত একাধিক বিদেশী এক্সপার্টদের কাছে পাঠিয়ে তাদের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। (ফেসবুক থেকে নেওয়া)
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়