১০ নভেম্বর ২০২৩, ২২:২১

আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের চাকরিপ্রার্থী চাই!

লেখক: মুহম্মদ সজীব প্রধান  © সংগৃহীত

আমরা শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিনিয়ত পত্রিকায় লেখালেখি করছি, টকশোতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছি। কিন্তু আদৌ কি মূল সমস্যা বের করে ঝোপ বুঝে কোপ দিতে পেরেছি? বর্তমানে ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় তরুণ প্রজন্ম দলে দলে আত্মহত্যা করছে। এতোটুকু সকলেই জানেন। কিন্তু এর ভেতরের কথাগুলো কয়জন জানেন? আমরা ক্যারিয়ার গড়তে চাই আমাদের সুন্দর ও স্বপ্নীল জীবনের জন্য কিন্তু ক্যারিয়ার ই যখন আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন বিষয়টা সর্ষের ভিতরেই ভূত থাকার গল্প হয়ে যায়। বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে। বিষয়টা এমন যে, টাইটানিক ডুবার পর মহাসমুদ্র সাতরে যাত্রীদের বেঁচে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টার চেয়ে একজন শিক্ষার্থীর একটি চাকরি পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচার লড়াই কোনো অংশে কম নয় । আমাদের প্রায় সমবয়সী দেশ মালয়েশিয়া এবং আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত গবেষণা ও আবিষ্কারে বিশ্বকে চোখ রাঙানি দিতে সক্ষম। কারণ তাদের সৃজনশীল তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতার শক্তি রয়েছে। কিন্তু কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত কোথায়?

এক.

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি সহ রাষ্ট্র যন্ত্রের সকল ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে উন্নত দেশে তরুণ-তরুণীরা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ক্যারিয়ার এবং উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। এখানে তরুণ প্রজন্ম হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি চাকরির পিছনে ছুটার কারণে নিজেরা হতাশ হচ্ছে এবং দেশে জ্যামিতিক হারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম কি সাধে সরকারি চাকরির পিছনে ছুটছে? অসংখ্য বিসিএস ক্যাডার রয়েছেন যারা ক্যাডার হতে চান নি। তাদের স্বপ্ন ছিলো গবেষক হওয়া, চাঁদ কিংবা মঙ্গলগ্রহের রহস্য উন্মোচন করা। মরণব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা আবিষ্কার করা। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছেন তাদের সেই স্বপ্ন আসলে দুঃস্বপ্ন তখনই তারা বাধ্য হয়ে বাংলা, ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করে রাতের পর পর বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করেছেন। মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, বাংলাদেশে বিসিএস ছাকনির মাধ্যমে যেভাবে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থ, রসায়নে পড়ুয়া তুখোড় মেধাবীদের ক্যাডার বানানো হচ্ছে ঠিক সেরকম একটা ছাকনির মাধ্যমে যদি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানী বানানো হতো এবং সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হতো তাহলে আমরা হয়তো ভারতের আগেই চাঁদ জয় করে মঙ্গল অভিমুখে রওনা হতে পারতাম। আমরা হয়তো এখানে বিসিএসের মতো প্রতি বছর আড়াই হাজার ক্যাডার পেতাম না কিন্তু ৫০ জন বিজ্ঞানী তো অনায়সেই পেতাম, তাইনা? এমনও হতে পারে, এই ৫০ জনের মধ্যে স্টিফেন হকিং, আইনিস্টাইন, গ্যালিলিও কিংবা নিউটনের মতো দুই-এক জন বের হয়ে আসত যারা দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেত। আমাদের ক্যাডাররা অন্য দেশে যায় আইটি প্রশিক্ষণ নিতে। তখন অন্য দেশের বিজ্ঞানীরা আমাদের দেশে আসতো বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের জন্য। এটা কল্পনা নয়, বাস্তব। সেজন্য চাই রাষ্ট্রের আন্তরিকতা। এমতাবস্থায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী যারা গবেষণায় আগ্রহী তারা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে যাকে সহজ কথায় মেধা পাচার বা ব্রেন ড্রেইন বলে । মেধা পাচারকে আমি জাতির ভবিষ্যৎ পাচার বলি। কারণ, একটি দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্ভর করে ঐ দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও মেধার ওপর। আর আমাদের সেই প্রতিভা চলে যাচ্ছে বিদেশে! অথচ একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য রাষ্ট্র লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছে। দিনশেষে, যখন রাষ্ট্রকে সেবা দেওয়ার সময় এসেছে তখনই ওই শিক্ষার্থীরা পাড়ি জমান বিদেশে এবং অন্য দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। এজন্যই বলা হয়, ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাগডাসে। এক্ষেত্রে তাদেরকে স্বার্থপর মনে হলেও সমস্যা আমাদের সিস্টেমে। চীন থেকেও অনেক শিক্ষার্থী অন্য দেশে পড়াশোনা করতে যান। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হলে চীন সরকার তাদেরকে আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে দেশে ফিরিয়ে আনে। এতে চীনে ব্রেন ড্রেইনের বদলে ব্রেন গেইন হচ্ছে। অথচ আমরা সেটা করতে ব্যর্থ। রাষ্ট্রকে এই বিষয়ে গভীর চিন্তা করতে হবে।

দুই.

দেশে চাকরির অভাব নাকি দক্ষতার অভাব? এই বিষয়ে চাকরি দাতা এবং চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক সবসময়ই দেখা যায়। আমি ধরে নিলাম চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতার অভাব। এখন আমার কৌতূহল মন জানতে চাচ্ছে এই দক্ষতার অভাবের দায় কি শুধু শিক্ষার্থীদের? যে দেশে ব্যবহারিক পরীক্ষায় সরাসরি ব্যাঙ কেটে এক্সপেরিমেন্ট করার বদলে খাতায় ব্যাঙের ছবি আঁকলেই পূর্ণ মার্ক পাওয়া যায় সেদেশে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার অভাব হবে, এটা কি স্বাভাবিক নয়? আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা স্মার্ট হচ্ছে? স্মার্ট ফোনে ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করাই কি স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থা? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এখনো আন্তর্জাতিক মানের না হলেও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং কর্পোরেট সেক্টরে জব করতে আমাদেরকে ঠিকই আন্তর্জাতিক মানের হতে হয়। চাকরির বাজারে রিসার্চ পেপার, কম্পিউটার স্কিল, কমিউনিকেশন হ্যাকস, টিম ওয়ার্ক, লিডারশীপ, ইউনিক আইডিয়া জেনারেট, প্রবলেম সলভিং এন্ড ইন্সট্যান্ট ডিসিশন মেকিং এবং ফিল্ড ওয়ার্ক এর স্কিল চাকরিদাতারা আমাদের মাঝে খুঁজে পাননা। ফলে শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, চীন এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে কর্মী  এসে মোটা অঙ্কের বেতন নিয়ে যান। অথচ আমাদের দেশের টাকা আমাদের পকেটে ঢুকার কথা। এর একটি বড় কারণ আমাদের পড়াশোনায় মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমরা বাস্তবধর্মী প্রায়োগিক শিক্ষার দিকে নজর না দিয়ে বরং শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে চাপিয়ে দিচ্ছি অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় মুখস্তবিদ্যা। এর ফলাফল এই যে, কিউএস, টাইমস হায়ার এডুকেশন  কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক জরিপে নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং এ থাকে অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাঁই মিলেনা। অন্যদিকে, আমাদের দেশে বিষয়ভিত্তিক চাকরির সুযোগ না থাকা আরো একটি বড় জটিলতা। এখানে ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্স করে কেউ ব্যাংকে চাকরি করছেন আবার কেউ ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং এ মাস্টার্স করে হাইস্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক হচ্ছেন। কি অদ্ভুত! অথচ হওয়ার কথা ছিলো উল্টাটা। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি এই বিষয়গুলো আসলেই ভাবেন? বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ক্যারিয়ারের দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়। তাই আমাদের পড়াশোনার কারিকুলাম ও সিলেবাস ক্যারিয়ার বেসড হওয়া বাঞ্ছনীয়। একইসাথে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেট বাড়ানো এবং বাজেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।

তিন.

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, চীনের একজন ২৫ বছরের তরুণ এবং বাংলাদেশের একজন ২৫ বছরের তরুণের মধ্যে পার্থক্য কত বছর? আপাতত দৃষ্টিতে বয়সের কোনো পার্থক্য নাই। তবে চীনের একজন তরুণ ২৫ বছর বয়সে যা অর্জন করে বাংলাদেশের একজন তরুণের সেগুলো অর্জন করতে মোটামুটি আরো ২৫ বছরের মতো লাগে। অর্থাৎ সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও চীনের একজন তরুণের সাথে বাংলাদেশের একজন তরুণের বয়সের পার্থক্য এক্ষেত্রে প্রায় ২৫ বছর! এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে চীনের তরুণ প্রজন্ম চাকরি করার চেয়ে অন্যদের চাকরি দেওয়ার মতো কর্মক্ষেত্র তৈরিতে বেশি মনোযোগী। তাই তারা উদ্যোক্তা হচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যে একেবারেই উদ্যোক্তা হতে চায় না সে কথা সত্য না। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হিসেবে শক্ত-পোক্ত অবস্থানে যেতে খুব বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। ধরুন, স্নাতক শেষ করা একটি ছেলের বিজনেস আইডিয়া চমৎকার এবং সে ছোট্ট একটি বিজনেস শুরু করেছে। কিন্তু এই বিজনেসটি বড় পরিসরে করার জন্য যে মূলধন দরকার সেটা তার নাই। এমতাবস্থায় সে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে আশানুরূপ সহায়তাও পাচ্ছে না। বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও যেসব শর্ত দেন সেগুলো একজন বেকার তরুণের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। ফলে সে কূল কিনারা না পেয়ে দুই বেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার পয়সা পেতে চাকরিতে ঢুকে। অথচ আমরা যদি তাকে উৎসাহ দিতাম তাহলে সে একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রুপ অব কোম্পানির একটির মালিক হতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আর এজন্যই হয়তো আমাদের দেশে বিল গেটস, জ্যাক মা কিংবা ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তির জন্ম হয়না। তাছাড়া আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা নেই। ফলে ভিটেমাটি বিক্রি করে অনেকে উদ্যোক্তা হলেও হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। মনে করুন, একজন তরুণ মাছ বা গরুর খামার করলো কিন্তু প্রশিক্ষণ না থাকায় যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলো না। এতে  পুকুরের সব মাছ মরে ভেসে ওঠলো বা গরু সব অসুস্থ হয়ে গেলো। তখন তো এই ছেলেটার পথে বসা ছাড়া আর পথ থাকলো না! আমরা সভা সেমিনারে চিৎকার করে বলি উদ্যোক্তা হও কিন্তু বাস্তবে উদ্যোক্তা হওয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথ মসৃণ করতে সত্যি কি চেষ্টা করছি? আমি জানি আমাদের উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। তবে এই চ্যালেঞ্জ যদি সফল করা যায় তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ চমক দেখাবে।

বর্তমানে সরকার শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের দুর্দশা দূর করে দেশের অগ্রগতিতে তাদের অবদান নিশ্চিত করতে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যা প্রশংসনীয়। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে আরো বিচক্ষণতার সাথে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, যে তরুণ প্রজন্ম ১৯৭১ সালে পরাধীন দেশে শত্রুর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে সে তরুণ প্রজন্ম স্বাধীন দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে ঈর্ষণীয় সাফল্যের মাইলফলক তৈরি করবে।

লেখক: কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম (বিটিসিএলএফ)
ই-মেইল: sajibprodhanbd@gmail.com