শিক্ষার্থীকে তার সক্ষমতা, সমস্যা ও সম্ভাবনাকে অনুধাবন করতে হবে
শিক্ষা মানুষের আচরণগত এবং অন্তর্গত পরিবর্তন সাধন করে। আর এই পরিবর্তন যদি ইতিবাচক হয় তবেই সেটি হয় প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষার মূলত দুটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য সচরাচর পরিলক্ষিত হয়। এক, শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তি মানসকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। দুই, শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে কর্ম ও সমাজ জীবনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
বর্তমান সময়ে আমরা এমন একটা ক্রান্তিকাল পার করছি, যেখানে দেখা যায় যতটা না প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তিক গুণের বিকাশ ঘটাতে চায় তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তার আর্থিক নিরাপত্তাময় কর্ম জীবন। লোকসমাজে ব্যক্তির পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ে অর্থ বা ধন সম্পদ অন্যতম মানদন্ড হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক এবং সাংসারিক প্রয়োজনের তাগিদে একজন শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষাজীবন শেষ করেই কর্মে প্রবেশ করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঝপথে শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে দুটো পাশাপাশি চালিয়ে যেতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট প্রাপ্তিটাই মূল উদ্দিষ্ট হয়ে যায়। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এর কোনোটির অপরিহার্যতা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী আকাশসম স্বপ্ন বুকে নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে। তারপর নেমে পড়ে জীবনের রণক্ষেত্রে। চাকরীর পিছনে ছুটে। সোনার হরিনটা কেউ কেউ পেয়েই যায়। কেউ কেউ হতাশায় ডুবতে ডুবতে অন্য পথ বেছে নেই। আসল কথা হচ্ছে, যে পরিমাণ চাকরি প্রার্থী প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে সেই পরিমাণ কর্মের ক্ষেত্র বাড়ছে না। যার ফলে বেকারত্ব থেকেই যাচ্ছে। তবে বেকারত্ব ঘুচিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা আমাদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। আমি মনে করি সকলে সেটাই চায়।
সরকারি -বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যারা শিক্ষা সমাপণ করে বের হচ্ছে সকলের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরি নাও জুটতে পারে। সেক্ষেত্রে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আত্মপ্রত্যয়ের সাথে আত্মনির্ভরশীল হওয়াটাও জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার। বর্তমান সময়ে যুবকদের মধ্যে স্বনির্ভরশীল হওয়ার একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। এটা অবশ্যই একটা ভালো দিক। গ্লোবালাইজেশনের এই পর্যায়ে স্বনির্ভরশীল কর্মের দ্বার অনেকটা বিস্তৃত। বিদেশেও পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ আছে। শুধু প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস এবং ইচ্ছের মেলবন্ধন।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীকে শুরুতেই তার লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সে কোথায় যেতে চায়। কতদূর যেতে চায়। লক্ষ্যের প্রতি একটা দায়িত্ববোধও থাকতে হবে। যদিও সবার লক্ষ্যই যে সফল হবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তবুও চেষ্টার ত্রুটি রাখা ঠিক নয়। সফলতার ক্ষেত্র নিজেকেই চিনে নিতে হবে। নিজের পছন্দ, নিজের ইচ্ছাকে আগে অনুধাবন করতে হবে। নিজের লক্ষ্যের প্রতি দ্বিধাহীন থাকতে হবে। শিক্ষার্থীকে ক্লাসমুখী হতে হবে। প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে। শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য নয় এর বাইরেও অসংখ্য দিক রয়েছে।
সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মজ্ঞান, সাহিত্য এবং সাধারণ নানা বিষয়ে একটা নূন্যতম ধারণা থাকাটা বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে একান্ত জরুরী। বলছি না যে একজনকে সব বিষয়ে পারদর্শি হতে হবে। সেটা সম্ভবও নয়। তবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই চোখ কান খোলা রাখতে হবে। আর এই চোখ কান খোলা রাখার অর্থ হচ্ছে প্রয়োজনীয় বিষয়ে জানার চেষ্টা করা এবং তার জন্য কি প্রতিবন্ধকতা, আর সেই প্রতিবন্ধকতা সে কিভাবে উৎরাতে পারবে সে বিষয়ে তাকে ভাবতে হবে।
অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে তার সক্ষমতা, সমস্যা এবং সম্ভাবনাকে অনুধাবন করতে হবে। এটা শুধু একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে যে প্রযোজ্য তা নয় এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। এছাড়া একজন শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত সময় পার করতে হবে লাইব্রেরীতে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে হবে। বই মানুষের জ্ঞানকে অবারিত করে। বই পড়াকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলতে হবে। একজন ছাত্রকে অ্যাকাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বইও পড়তে হবে।
বর্তমান এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে ছেলেমেয়েরা বই নয় মোবাইলে বেশি আসক্ত। সোশাল মিডিয়ায় এত বেশি সময় তারা ব্যয় করে যার ফলে শিক্ষার যে মর্যাদা, যে প্রয়োজনীয়তা, পড়াশুনার প্রতি যে টান এবং ভালোবাসা থাকাটা জরুরী সেগুলোর কোনোটিই তারা অনুভব করে না। ফলস্বরুপ দেখা যায় গোজামিল দেওয়া শিক্ষা জীবন শেষ করে পারিপার্শিক নানা চাপে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়। বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সংসার এবং সমাজের বোঝা হয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়।
এসবের কারণ হিসেবে বলা যায়, পড়াশোনা থেকে দূরে থাকার ফলে ঠিক পথটা চেনা হয়নি। ক্লাস, পরীক্ষার প্রতি অনীহার কারণে শিক্ষকের সাথেও কোনো মেলবন্ধন গড়ে ওঠেনি ফলে সেখান থেকে সে ভালো কোনো দিক নির্দেশনা পায় নি। একজন শিক্ষক হিসেবে যদি বলি তবে এটুকুই বলবো, একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই তার শিক্ষাঙ্গন অর্থাৎ তার পড়াশুনার পরিবেশের সাথে যথাযথভাবে পরিচিত হতে হবে। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তার বিভাগ, তার শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
যে সাবজেক্টে পড়ার কারণে একজন শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট পেতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে অবশ্যই তার একটা সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া সফলতার জন্য অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। যেহেতু আমাদের দেশে চাকরির জন্য অ্যকাডেমিক সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয় সেহেতু একটা ভালো ফলাফল সার্টিফিকেটটাকে সমৃদ্ধ করে। সফলতার বিষয়টা অবশ্য আপেক্ষিক। ব্যক্তিভেদে এর সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়। কে কিসে নিজেকে সফল মনে করবে সেটা তাকেই ভেবে বের করতে হবে এবং সেভাবেই নিজেকে তৈরি করতে হবে।
লক্ষ্য স্থির করে ক্রমাগত তার কাছাকাছি যেতে হবে। হতে পারে উদ্যোক্তা, সরকারি বেসরকারি চাকরি, এ ছাড়াও অন্যান্য নানান পেশা। সরকারি চাকরি পেতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং নানাবিধ বিষয়ে জানার পরিধি বিস্তৃত করতে হবে। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসতে গেলে একজন মানবিকের ছাত্রকেও বিজ্ঞান জানতে হয়। বিজ্ঞানের ছাত্রকে ইতিহাস জানতে হয়। এমনই যখন পরিস্থিতি তখন একজন প্রতিযোগিকে বাংলা, অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, ধর্ম, দেশ বিদেশের নানা বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান আয়ত্ব করতে হয়।
তাই লক্ষ্য যদি হয় সরকারি চাকরি তবে নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে হবে। ইংরেজি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা নয়, বিদেশী ভাষা তাই ইংরেজির প্রতি আলাদাভাবে যত্নশীল হতে হবে। ইংরেজিতে দূর্বলতার কারণে অনেক ভালো ছাত্রও প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়েন। নিয়মিত বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
সর্বোপরি আমি পারবো, এই বিশ্বাসটা নিজের মধ্যে থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসহীন স্বপ্ন কোনো স্বপ্ন নয়। সেটা নিছক কল্পনা। জীবন নিয়ে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। থিওডোর রুজভেল্ট যে কথাটি বলেছেন-“আপনি যখন বিশ্বাস করবেন আপনি পারবেন, তখনি আপনি পারবেন, আর এটিই আত্মবিশ্বাস” তা কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। নিজের সক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ হতাশায় ডুবে যায়। সংকোচ এবং সংশয়ে ভোগে। মনের দ্বিধাকরণ মানুষকে লক্ষ্যচ্যূত করে। তাই নিজের ইচ্ছেকে প্রবল করতে হবে। থাকতে হবে পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং নৈতিকতা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল