বিজ্ঞান-মানবিক বিভাজন দূর: কত সহজে সর্বনাশটা করে ফেলল!
গত সোমবার (২৩ অক্টোবর) মাধ্যমিকের নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের মতো আলাদা বিভাগ না থাকা নিয়ে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। আদেশ জারির পর থেকে এটি নিয়ে নানান মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড একাউন্ট থেকে এক পোস্টের মাধ্যমে তিনি এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ২৩শে অক্টোবরকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত হবে একদিন। এখন থেকে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে কোন বিভাজন থাকবে না। বিভাজন না থাকার অর্থ কি সমতা এবং সাম্যতা? আর সমতা এবং সাম্যতা মানেই কি মঙ্গলজনক? সাম্য ও সমতা শব্দটি দুটি শুনতে একই মনে হলেও, বাস্তবে এদের মধ্যে বিশাল ফারাক। ‘সাম্য মানে equity আর সমতা মানে equality এই বিভাজন উঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সমতা আনলাম বটে সাম্যতার কি হবে?
তিনি আরও বলেন, মানুষের ইচ্ছেগুলো এক না। মানুষের কৌতুহল; মনোযোগ, বুদ্ধি, সুবিধা, আগ্রহ, আকর্ষণ ইত্যাদি এক না। কারো ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি বিশেষ প্রতিভা দেখা যায়, কারোবা সংগীতে, কারো গণিতে। সপ্তম শ্রেণী থেকেই কার কোন দিকে ঝোক এইটা পিতা মাতা ও শিক্ষকদের খেয়াল করা উচিত। নবম শ্রেণী এসে মোটামোটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। এইসব কিছু বিবেচনায় রেখেই ইংল্যান্ডের শিক্ষাক্রমকে তৈরি করা হয়েছে যা আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা পড়ে। ইংল্যান্ডে একজন শিক্ষার্থীকে কয়েকটা বিশেষ বিষয় আছে যেমন ভাষা ও একটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইত্যাদি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। এর বাহিরে অসংখ্য সাবজেক্ট আছে যাদের মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে নিতে পারে।
সকলকে ঘাড়ে ধরে একই বিষয় পড়াতে বাধ্য করে মন্ত্রীরা অভিযোগ করে তিনি বলেন, মানুষের স্বভাবজাত যেই বিভাজন আছে তাকে অস্বীকার করা হলো। যেই বয়সে ছেলেমেয়েদের প্রিয় বিষয় আবিষ্কারের সময় সেই সময়েই প্রিয় হওয়ার সুযোগটাই নাই করে দিল। উচ্চতর গণিতকে নাই করে দিল। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মত ৩টি ভিন্ন বিষয়কে এক করে একটি বিষয় বানানো হলো। এর ফলে কোন সাবজেক্টকেই একটু গভীরে গিয়ে বোঝার বা জানার সুযোগ প্রতিটি বিষয় থেকে ৩ ভাগের ২ ভাগ কমে গেল। এই ৪০০ নম্বরের ৪টি আলাদা বিষয়ের পরিবর্তে ১০০ নম্বরের বিজ্ঞান পড়বে এরা ভবিষ্যতে বিজ্ঞানকে কিভাবে দেখবে? নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞান নিয়ে ভয় ঢুকে যাবে। উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে সেখানে কোপ করতে হাবুডুবু খাবে। কয়েক বছরের ছেলেমেয়েদের হাবুডুবু খাওয়া দেখে এরপর থেকে বিজ্ঞান নেওয়াই অনেকে ছেড়ে দিবে।
কামরুল হাসান লিখেন, যারা নিবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তারা ভালো করবে না। একটা সময় ছিল যখন প্রতিটা বিষয়ে জ্ঞানের ভলিউম কম ছিল। কম জেনেই নানা বিষয়ে গবেষণা করে ফেলতে পারতো। এখন জ্ঞানের ভলিউম অনেক বেড়ে গেছে। এখন পদার্থবিজ্ঞানের অসংখ্য ব্রাঞ্চের একটি ব্রাঞ্চের অনেকগুলো শাখার একটি শাখার অনেক প্রশাখার একটি সাব-ফিল্ডে হয়ত কাজ করতে হবে। সুতরাং পদার্থবিজ্ঞানের সব কিছু কারো পক্ষেই জানা সম্ভব না। কিন্তু ফাউন্ডেশন-তো ভালো হতে হবে। আমরা বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য করি? আমরা মাটির নিচে বহুদূর পর্যন্ত ভিত্তি নির্মাণ করি। ভিত্তি নির্মাণের জন্য কত নিচে পর্যন্ত যাব নির্ভর করে ভবনটি কত তলার হবে। যত বেশি তলা উপরে তৈরি হবে ততটাই মাটির নিচে গিয়ে ভিত্তি তৈরী করতে হবে। এই ভিত্তির উপরেই ভবনটি নির্মিত হয়। ঠিক তেমনি আমরা যদি দেশে বড় বিজ্ঞানী চাই, বড় ডাক্তার, বড় ইঞ্জিনিয়ার চাই তাহলে স্কুল লেভেলেই এদের বিজ্ঞানের বিষয়ের গভীরে গিয়ে ভিত্তি তৈরী করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে যেই ভিত্তি হবে সেই ভিত্তি দিয়ে টেকনিশান, আমলা, কামলা হবে। বিজ্ঞানী হবে না।
শেষে বলেন, অনেক ছাত্র এসএসসি এইচএসসিতে বিজ্ঞান পড়ে পরবর্তীতে মানবিক কিংবা ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে পড়ে। কোন অসুবিধাতো হয়ই না উল্টো সুবিধা হয়। বিশেষ করে যারা অর্থনীতিতে পড়ে তাদের জন্য দারুণ সহজ হয়। অর্থনীতিতে এখন ভালো করতে হলে এখন আসলে ভালো গণিত জানা লাগে। আগে বিজ্ঞানে পরে মানবিকে যেতো কিন্তু মানবিকে পড়ে বিজ্ঞানে যেত না। বর্তমান শিক্ষাক্রমতো আসলে মানবিকে পড়াই হলো। তাহলে এরা কিভাবে পরবর্তীতে বিজ্ঞান পড়বে? এই ভুলকে undone করতে একদিন হয়তো আন্দোলন করতে হবে। হয়তো অনেককে জীবন দিতে হবে। অথচ কত সহজে সর্বনাশটা করে ফেলল।