শিশুশ্রম প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন
“একটি শিশু গড়তে হলে করতে হবে যত্ন,
সেই শিশুটি বড় হলে হবে দেশের রত্ন ”
আজকের শিশুটি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। একটি শিশুকে গড়ে তোলার জন্য প্রথমে শিশুর পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ১৯২৪ সালে জেনেভায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শিশু অধিকার ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। যা চারটি ভাগে বিভক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশের আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে দিন দিন শিশুশ্রমিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের যে প্রান্তে তাকাই সেখানেই দেখতে পাই হাজার হাজার শিশু, শ্রম দিচ্ছে গার্মেন্টস, কলকারখানা, হোটেল ও গ্যারেজে। আবার অনেকেই বাস, টেম্পু এসবের হেল্পারি করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের শিশুশ্রমের অবস্থান শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের যে কারণ গুলো দেখানো হয়েছে তার মধ্যে চরম দারিদ্রতা, শিক্ষার অভাব, পরিবারের উপার্জন কারীর মৃত্যু, পিতৃ বিয়োগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যে বয়সে শিশুর হাতে থাকার কথা বইখাতা কলম সেই বয়সে জীবন সংগ্রামের জন্য হাতে তুলে নিচ্ছে শ্রমের হাতিয়ার। নিজে কিংবা তার পরিবারের জন্য দু মুঠো খাবার জোগাতে তারা এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু পারিপার্শ্বিক সমস্যার কারণে বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। অনেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অর্থের অভাবে তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে না, তাই মাঝ পথে বাধ্য হয়েই বন্ধ করে দিতে হয় লেখাপড়া। এরপর তারা জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন কাজে কেউ হোটেলে কাজ করে, কেউ গ্যারেজে, কেউ আবার মাছের আড়তে, কেউ করে মাটিকাটার কাজ আবার কেউ কেউ চালায় রিক্সা।
এসব কাজের মধ্যে অনেক কোমলমতি শিশুরা আবার হাতে মাদকও তুলে নিচ্ছে যা তাদের ব্যক্তিগত ও পরিবার জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য খুবই ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশে ২০ লাখ গৃহ শ্রমিকের মধ্যে ৯৩ শতাংশ শিশু গৃহকর্মি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এসব গৃহ শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই শিকার হচ্ছে মানসিক অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন ও আর্থিক শোষণের।
বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ ধরনের কাজ শিশুরা করে থাকে। এসব কাজের মধ্যে ৪৫টি কাজ হচ্ছে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। শিশু শ্রমিকের বৃহৎ একটি সংখ্যা হচ্ছে পথ শিশুরা এবং তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। এছাড়া শহর অঞ্চলের চেয়ে গ্রাম অঞ্চলে শিশু শ্রমিক বেশি। এক তথ্য মতে শহরে প্রায় ১৮ লাখ শিশু কাজ করে থাকে এবং গ্রামে কাজ করে প্রায় ৬৭ লাখ শিশু। এসব শিশুদের মধ্যে প্রায় ৪৭ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।
আরও পড়ুন: শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত কক্সবাজারের ৪৩ শতাংশ শিশু
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আই এল ও’ এর জরিপ মতে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে ৪৫ ধরনের, তার মধ্যে শিশুরা ৪১ টি কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। যারা গৃহ পরিচালিকার কাজ করে তাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। ইউনিসেফের তথ্য মতে গৃহ পরিচালিকার ৮৬ শতাংশই মেয়ে যার ৩০ শতাংশের বয়স ছয় থেকে ১১ বছর, আর বাকিদের বয়স ১২ থেকে ১৬ পর্যন্ত। এরা প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করে থাকলেও নির্ধারিত শ্রমের পারিশ্রমিক পায়না। কাজের চাপ ও নানা কারণে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসব শিশুদের সামান্যতম ভুল হলেই হতে হয় নির্যাতনের শিকার।
নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও হাত তোলে এসব অসহায় কোমলমতি শিশুদের শরীরে। এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল, ১৬ জানুয়ারি ২০২২ রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের এক বাসায়। ফারজানা আক্তার নামে এক মেয়ে যার বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর। সে গৃহ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সময় গৃহকর্তার দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতো। ফারজানার ভাষ্যমতে, তাকে টয়লেটে ঢুকিয়ে হাত পা বেঁধে মারধর করতো। এরপর মারের পর জখমে লাগিয়ে দেওয়া হতো মরিচ। ফারজানার মতো হাজার হাজার শিশুরা এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। অনেক শিশু নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যা পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয় হর হামেশাই।
জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এর ৮ ধারার ৯ এ বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুরা কাজে নিয়োজিত আছে সেখানে শিশুরা যেন কোনরূপ মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তার কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু আদৌ কি এই আইনের বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই? না আমরা দেখতে পাই এর ভিন্ন চিত্র। এ থেকে উত্তরণের সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন সচেতনতা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ।
সারাদেশের রেলওয়ে লঞ্চঘাট বাস স্ট্যান্ড এসব এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শিশুকুলিরা। এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ফলে এদের মন-মানসিকতার বিকাশ হয় না, বরং অসৎ সঙ্গে থাকার কারণে তারা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বা বিভিন্ন ধরনের অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ইয়াবা সিগারেট গাজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবনে এসব শিশু শ্রমিকরা অল্প বয়সেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। অনেক শিশুরা আবার কাজ করতে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়লে এদের মালিক পক্ষ নেয় না কোন খোঁজ খবর।
আমরা জানি সরকার শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শিশু অধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সরকারের উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকার পরেও শিশুদের সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, যেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সরকারের পাশাপাশি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পারে শিশু শ্রম বন্ধ করতে।
সমাজের সকল বিত্তবান মানুষের প্রতি আহ্বান, আসুন আমরা সকলে এসব শিশুদের দিকে বাড়িয়ে দেই আমাদের সাহায্যের হাত। সরকারের পাশাপাশি আমরা এদের শিক্ষার অধিকার, সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এগিয়ে আসি। তাহলেই তাদের মুখে ফুটবে হাসি। এরাই একসময় দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই-
“পথের ধুলোয় লুটায় যারা
পাইনা কিছু খেতে,
নতুন আশায় স্বপ্ন একে
উঠুক তারা মেতে।”
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল