বাচ্চার হাতের লেখা খারাপের কারণ হতে পারে ডিসগ্রাফিয়া রোগ
আমাদের আশেপাশের প্রাথমিক কিংবা হাইস্কুলগুলোতে প্রায়শই এমন কিছু বাচ্চা পেয়ে থাকি যাদের নিয়ে অভিভাবক কিংবা শিক্ষকগণ চিন্তিত। বাবা-মার অভিযোগ আমার বাচ্চাটি ভীষণ দুষ্টু; একদম পড়ালেখা করতে চায় না। এতো চেষ্টা করছি কিন্তু তার হাতের লেখা ভালো হয়না; রেজাল্ট খুব খারাপ করে। শিক্ষকেরা বলেন এই ছেলেটি বা মেয়েটি এতো বড় হয়ে গেলো কিন্তু এখনো ছোট মানুষের মতো হাতের লেখা; পড়াশুনায় একদম পিছিয়ে। আপনার শিশুটি কি তাহলে আসলেই চেষ্টা করছে না? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোন অজানা কারণ?
আপনি হয়তো ডিসগ্রাফিয়া রোগটি সম্পর্কে পরিচিত না। ডিসগ্রাফিয়া মূলত এক ধরনের লার্নিং ডিজেবিলিটি। যা শিশুর নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। এই ধরনের শিশুদের সাধারণত বয়স অনুযায়ী হাতের লেখার উন্নতি ঘটে না। এখন সকল দুর্বল হাতের লেখাকেই কি আমরা ডিসগ্রাফিয়া বলবো? উত্তরটি হবে, না।
যেমন ধরুন আপনার বাচ্চাটি ক্লাস ফাইভে পড়ে কিন্তু তার হাতের লেখা একটি ওয়ানে পড়া বাচ্চার মত অথবা তার হাতের লেখা সুস্পষ্ট নয়। অধিক বানান ভুল, সঠিক ব্যাকরণ ব্যবহার করতে না পারা, লাইন সোজা করে লিখতে না পারা, খাতায় বেশি কাটাকাটি করা, বিভিন্ন অক্ষরকে উল্টিয়ে লেখা অথবা বাদ দেওয়া, যুক্তবর্ণ লিখতে না পারা ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। শিশু চেষ্টা করছে কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার বাচ্চাটির ডিসগ্রাফিয়া হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
অনেক বাচ্চাদের পেন্সিল কিংবা কলম ধরতেও অসুবিধা হয় বা সঠিকভাবে ধরতে পারে না। এছাড়াও তাদের ভিজুয়্যাল মোটর কো-অর্ডিনেশন বা দেখে দেখে কোন কাজ করা বা লিখতে অসুবিধা হয়। অনেকে প্যান্টের চেইন আটকানো বা জুতার ফিতা বাঁধার মত কাজগুলোও করতে পারে না কিংবা কাঁচি ধরে কিছু কাটতে পারেনা, পাজেল খেলার মত খেলা গুলি খেলতে পারে না৷ কারণ তাদের হাতের মুভমেন্ট গুলো সঠিক হয় না।
সাম্প্রতিক গবেষণার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনুমান করা হয়, প্রায় ৫% থেকে ২০% স্কুলের শিশুদের মধ্যে ডিসগ্রাফিয়া বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশে, ডিসগ্রাফিয়া মোকাবেলায় সচেতনতা এবং এই বিষয়ক সংস্থাগুলির ক্রমবর্ধমানতা প্রয়োজন। এর সঙ্গে ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ এবং তাদের সহায়তা করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ডিসগ্রাফিয়ার বৈশিষ্ট্য ও সমাধান নিয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা প্রয়োজন।
যেহেতু এটি একটি লার্নিং ডিজেবিলিটি সেহেতু এটির সঙ্গে অন্যান্য লার্নিং ডিজেবিলিটির সম্পর্ক আছে। যেমন ডিসলেক্সিয়া বা পড়ার সমস্যা এবং ডিসক্যালকুলিয়া বা গাণিতিক বিষয়ে দুর্বলতা। আপনাদেরকে মনে পড়ে কি আমির খানের "তারে জামিন পার" মুভিটির কথা। সেখানে আমরা একটি বাচ্চাকে দেখি যার একই সঙ্গে সবগুলো লার্নিং ডিজেবিলিটি ছিল। সে বইয়ের পাতার লিখাগুলো সঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করতে পারত না। সে বিভিন্ন অক্ষরকে উল্টা দেখতো (যেমন b এর জায়গায় d) যার ফলে লেখার সময় সে তেমনি লিখতো। এছাড়াও সে লেখায় প্রচুর কাটাকাটি করতো এবং তার লিখা সুস্পষ্ট ছিলনা। সে খুব সাধারণ অংকও ভুল করতো।
ডিসগ্রাফিয়া বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সেটি হলো হাইপার এক্টিভিটি বা এডিএইচডি। এই ধরনের বাচ্চারা সঠিক ভাবে যেকোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারেনা এবং খুব অস্থির থাকে। তারা অনেক কাজ গুছিয়ে করতে পারে না যার কারনে তারা বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি থেকেও পিছিয়ে থাকে। অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করে।
আরও পড়ুন: স্নাতকের চার বছরে কোন বর্ষে কী করবে?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমার বাচ্চার কেন এটি হলো বা সমাধান কি? ওই যে আগেই বলেছি এটি একটি নিউরোলজিক্যাল প্রবলেম অর্থাৎ বাচ্চা এটি জন্ম থেকেই নিয়ে আসে। তাহলে এটির কি উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়? সম্ভব। কিন্তু এটির স্থায়ী সমাধান নেই। আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো তার অবস্থার উন্নতি ঘটানো অথবা তার জন্য বিকল্প কিছু পথ ব্যবহার করা। সেই ক্ষেত্রে শিশুর অভিভাবক ও শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের হাতের লেখা খারাপ হলেও উৎসাহ দিতে হবে। কারণ ওইটুকু লিখতেই হয়তো ওর অনেক অসুবিধা হচ্ছে। পেন্সিল বা কলম সঠিকভাবে ধরানোর জন্য পেন্সিলের গ্রিপ ব্যবহার করা যায়, যা মার্কেটে কিনতে পাওয়া যাবে।
ফাইন মোটর স্কিল ডেভেলপ করার জন্য ওদের পুঁথি দিয়ে মালা গাঁথতে দেওয়া, বিভিন্ন কিছু আঁকতে বা রং করতে দেওয়া যেতে পারে। বড় উত্তরের বদলে ওদের ছোট উত্তর লিখতে দিতে হবে। যাদের বেশি সমস্যা রয়েছে তাদের লেখার বদলে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। কম্পিউটার জাতীয় ডিভাইস বিকল্প হিসেবে দেওয়া যেতে পারে, যাতে করে টাইপ করে উত্তর দিতে পারে। সঙ্গে থাকতে হবে অডিয়ো ইনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাও। প্রফেশনাল থেরাপিস্ট দ্বারা নিয়মিত অকুপেশনাল থেরাপি এই ধরনের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।
এরই সঙ্গে বাচ্চার মানসিক চাপ কমানোর জন্য তাদের এবং তাদের অভিভাবকদের কাউন্সিলিং প্রয়োজন হতে পারে। বাচ্চাকে তার বাবা মা তখনই সহযোগিতা করতে পারবে, যখন তারা বুঝবে এটি বাচ্চার এমন একটি সমস্যা যা বাচ্চা ইচ্ছা করে করে না। অর্থাৎ তাকে পর্যাপ্ত সময় ও সাপোর্ট দিতে হবে তার উন্নতি ঘটানোর জন্য। তাকে কখনো হীনোমন্যতায় ভুগতে দেওয়া যাবে না। তাকে অনুভব করাতে হবে যে সে আরো অনেক বিষয়ে কতটা এক্সপার্ট। শিক্ষকরাও স্কুলে তাদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যবস্থা রাখতে পারে এবং তাদের উৎসাহিত করতে পারে। যেমন, পরিষ্কার-পরিছন্নতা কর্মসূচির আয়োজন করতে পারে, যেখানে এই বাচ্চাগুলো এক্টিভলি পার্টিসিপেট করবে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশে ডিসগ্রাফিয়ার ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়েছে। যদিও তথ্য কিছুটা সীমিত বা এখনো পর্যন্ত ব্যাপকাকারে এটি নিয়ে কাজ হয় নি, তবুও অনুমান করা হয় যে প্রায় ৫% থেকে ২০% স্কুলের শিশুদের মধ্যে ডিসগ্রাফিয়া বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিস্তৃত পরিসর আমাদের আরও বেশি গবেষণা এবং সচেতনতার প্রয়োজন নির্দেশ করে। বাংলাদেশে, ডিসগ্রাফিয়া মোকাবেলায় সচেতনতা এবং এই বিষয়ক সংস্থাগুলির ক্রমবর্ধমানতা প্রয়োজন। এর সঙ্গে ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ এবং তাদের সহায়তা করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ডিসগ্রাফিয়ার বৈশিষ্ট্য ও সমাধান নিয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা প্রয়োজন।
সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিসগ্রাফিয়ার প্রাদুর্ভাব কমাতে এবং সহায়তা পরিসেবাগুলোর উপর গবেষণার জন্য সংস্থান বরাদ্দ করতে পারে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী হাতের ডিসগ্রাফিয়া অবস্থা উন্নতির জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এটি শুধুমাত্র প্রতিটি শিশুর হাতের লেখার সৌন্দর্য নিশ্চিত করার জন্য নয়, বরং এটি ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুদের শনাক্তকরণ এবং সমর্থন করার বিষয়ে। এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার মাধ্যমে তাদের জন্য উন্নত শিক্ষাগত ফলাফল, বর্ধিত আত্ম-সম্মান এবং আরও ভাল ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়