উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষকের মর্যাদা অপরিহার্য
শিক্ষক হচ্ছে জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের থাকে নানা রকম ভূমিকা। যে জাতি যতো শিক্ষিত, সে জাতি ততো উন্নত। একজন আদর্শবান শিক্ষকই শিক্ষিত জাতি গঠনের মুখ্য ভূমিকা রাখে। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage’. অর্থাৎ ‘আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষক: শিক্ষকের স্বল্পতা কাটানো বৈশ্বিক দাবি’।
১৯৬৬ সাল থেকে প্যারিসে শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত আন্তঃসরকার সম্মেলনে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং মর্যাদা সম্পর্কে একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। উক্ত সুপারিশমালায় শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক অবস্থানে নেওয়াসহ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, দায়িত্ব ও অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছিল।
আমরাজানি প্রতিটি পেশার আলাদা আলাদা সম্মান আছে। তবে শিক্ষকতা পেশা একটু ভিন্ন। নৈতিকতা, শিক্ষার মান উন্নয়নে ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে একজন শিক্ষক। পিতা-মাতার পরের অবস্থান শিক্ষকদের। একজন শিশু তার পরিবার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করে শিক্ষকের কাছ থেকে। একজন শিক্ষক শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দেন না বরং শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করেন। শিক্ষকরা জাতির বিবেক। জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নে একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রদেরকে সেইভাবে গঠন করেন।
অন্যদিকে, শিক্ষকের মতো মহান পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে কিছু সংখ্যক শিক্ষক। যাঁদের নীতি-নৈতিকতার স্খলন ঘটিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে। মাঝে মাঝে পত্রিকা খুললে এমন শিক্ষকদের দেখা মিলে, যা আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। তাঁদের উচিত শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে কলঙ্কিত না করা। প্রশ্নবিদ্ধ না করে একটি উন্নত জাতি গঠনে সহায়ক হিসেবে কাজ করা। তাতে দেশ উন্নতি হবে, তৈরি হবে উন্নত সমাজ।
শিক্ষকদের প্রতি করণীয়:
সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান: শিক্ষকদের নিকট সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকগণ সমাজের প্রত্যাশা শতকরা যত ভাগ পূরণ করতে পারবেন সমাজও ন্যূনতম তত ভাগ সম্মান শিক্ষকদের দেবেন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা নেই বলেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে এই পেশায় আসতে চান না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু বই পড়ে শিক্ষা লাভ করে সুনাগরিক হওয়া যায় না। একজন প্রকৃত সুনাগরিক গড়ে তুলতে হলে সুশিক্ষার প্রয়োজন। সুশিক্ষার জন্য চাই নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানী শিক্ষক। মেধাবী শিক্ষক ছাড়া সুশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়। মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। একজন শিক্ষক যাতে তার পরিবার-পরিজনের লেখাপড়া, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ন্যুনতম চাহিদা মেটাতে পারে তার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষকদের প্রয়োজন মেটাতে হবে। তাহলে একজন শিক্ষকের কোচিং-প্রাইভেট-টিউশনির দিকে উৎসাহ কমে যাবে। কারণ অনেক শিক্ষক ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিতান্তই বাঁচার তাগিদেও প্রাইভেট পড়ায়।
পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান: মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, শিক্ষক পেশাগত ও সামাজিক নানা সমস্যায় জর্জরিত হবেন না। সে কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের পেশাগত মান উন্নয়নে শুরুতেই যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ ও তা অব্যাহত রাখা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং সঠিকভাবে তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আরও পড়ুন: ড. শামসুজ্জোহা থেকে আব্রাহাম লিঙ্কনের চিঠি ও জাতির আকাঙ্ক্ষা
শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা: নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সময়োপযোগী লক্ষ্য অর্জনে সকল স্তরের নাগরিককে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে শুধু লেখাপড়া নয়, মানুষের জ্ঞান, সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায় যা সুস্থ সমাজ ও উন্নত দেশ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। যেখানে শিক্ষকদের আরও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
শিক্ষকদের ভূমিকার কথা তুলে ধরা: মানব সন্তানকে শিক্ষিত করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে বলেই শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। মা-বাবা যেমন শিশুকে জন্মদান করে, লালন করে, তেমনি শিক্ষক তার সকল মেধা, শ্রম ও সাধনা দিয়ে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই বাংলাদেশের সকল শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এদেশের সকল শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে হবে; যাতে সামাজিকভাবে তাঁরা মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
অন্যদিকে, সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথ প্রদর্শক। অবশ্যই সৎ ও ধার্মিক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যোজ্জ্বল, সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
কেননা, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। শিক্ষকই হতে পারেন সমৃদ্ধ জাতি গড়ার আলোর দিশারী। সেই জ্ঞানের আলো শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেন একজন শিক্ষক। তাঁর হাত দ্বারা গড়ে ওঠেন জাতির বিবেক। শিক্ষকরাই মানবগড়ার কারিগর। শিক্ষক অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন হন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, প্রকাশভঙ্গি ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন। শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা সম্পন্ন হলেই ছাত্ররা অনুপ্রেরণা পায়। আমি নিজেও স্কুল জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে কিছু শিক্ষক পেয়েছি যাঁদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা পাচ্ছি ও এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাই। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমি সেই সকল শিক্ষকদের কাছে চিরঋণী। সকল শিক্ষক ভালো থাকুক, সু্স্থ থাকুক এই কামনা করি।
লেখক: শিক্ষক, যশোর।