ড. শামসুজ্জোহা থেকে আব্রাহাম লিঙ্কনের চিঠি ও জাতির আকাঙ্ক্ষা
আজ ৫ অক্টোবর। বিশ্ব শিক্ষক দিবস। আমাদের শৈশব কেটেছে ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতা পাঠ করে। পরীক্ষায় ‘প্রিয় শিক্ষক’ রচনা লিখে। বয়সের অনুপাতে একজন শিক্ষার্থীর চেতনায় শিক্ষকের মর্যাদা কতটুকু আঁচ করা সম্ভবপর ছিল তা বিতর্কের বিষয় হলেও তৎকালীন পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত সে কবিতার চরণগুলো কিংবা পরীক্ষায় ভালো নম্বরের জন্যে মুখস্থ করা রচনা যে শিক্ষার্থীর কোমল মনে এক সুন্দর আদর্শের বীজ বপন করতো তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সূর্যের আলোকরশ্মি যেমন পৃথিবীতে অল্প অল্প করে এসে একসময় আলোর ঝলকানিতে ভুবনকে আলোকিত করে, তেমনি নীতি-মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষার আদর্শও ক্রমশ মানুষকে ন্যায়, ভালো-মন্দের শিষ্ঠাচার শিখিয়ে মানবিক করে তোলে। আর এর ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের সে প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার পরও সেখানে থাকা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত এবং ভালোবাসায় হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে।
এই সম্পর্কে রয়ে যায় চিরস্থায়ী ঋণ। যার বিনিময় অস্তিত্বহীন। তবে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা এবং তাদের সুস্থ আদর্শের চর্চার দ্বারা সে সম্পর্কের মহিমা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা সম্ভব।
দিন বদলেছে। মানবিক সম্পর্কের পুরুত্ব ভোগবাদী, যন্ত্রনির্ভরযুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকাংশেই মিহি হয়ে গেছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের দরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে চলে আসা স্বার্থহীন সম্পর্কের দ্যুতিও ফিকে হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চতর শিক্ষা, প্রায় প্রতিটি ধাপে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সে পরিবর্তন যে খুব একটা সুখকর নয় তা পত্রিকা খুললে, সামসময়িক ঘটনার বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সরকারি অনেক বিদ্যালয়গুলোতে এমনও ঘটনা ঘটছে যে, শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট না পড়ার দরুণ পরীক্ষার খাতায় প্রাপ্য নম্বর থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীকে। বিভিন্ন কলেজে শিক্ষক-নারী শিক্ষার্থীর অনৈতিক সম্পর্ক কালিমা লেপন করছে শিক্ষাঙ্গণে। আর বিশ্ববিদ্যালয় স্টেজে রাজনৈতিক হিংসা, প্রতিহিংসার দরুণ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধুরতা, গ্রহণযোগ্যতা যেন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে!
তবুও আশার আলো আসে হাজারো প্রতিবন্ধকতার মাঝ দিয়ে মানুষকে পথ দেখাতে, সমাজকে বাঁচাতে। না আসলে ইতিহাসের জানালায় উঁকি দিতে হয় অতীত থেকে আগত স্মৃতির রশ্মিতে। সে রশ্মি চিরভাস্বর হয়ে ধরা দেয় স্মৃতিপটে।
দল, মত, আদর্শ নির্বিশেষে এবং সামাজিক অবস্থানকে বিচারের উর্ধ্বে রেখে একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীকে পথ দেখাবেন সমাজে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। 'পড়ালেখা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে'-এর মতন সুপ্ত ভোগবাদী চেতনার পরিবর্তে শিক্ষার্থীর মানস-পটে বপন করবেন 'পড়ালেখা করে যে, রাষ্ট্রের হাল ধরে সে'-এর মতন ত্যাগী মানসিকতার বীজ।
পরাজিত মানসিকতাকে দূর করে শিক্ষার্থীদের আদর্শের বাতিঘর হয়ে উঠবে তাঁর ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থার কাঠামোতে অসঙ্গতি দেখা দিলে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া আলোকিত করবে গোটা সমাজব্যবস্থাকে। যা করে দেখিয়েছিলেন ড. শামসুজ্জোহা স্যার। তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যেভাবে নিজ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজির হিসেবে স্থাপিত হয়ে আছে।
এছাড়া একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের সুপ্তধারা বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা হবে অপরিহার্য। শিক্ষার্থীর নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নেবার সামর্থ্য, আত্মমর্যাদার স্ফূরণ, দুঃখের দিনে নীরব হাসির রহস্য উন্মোচন, আচরণে হিংসাকে পরিত্যাগসহ পরিশ্রমী মানসিকতার অধিকারী করে তুলতে শিক্ষকের ভূমিকা হবে শিল্পীর মতন। যার তুলির স্পর্শে এক সাদা কাগজের মূল্য হয়ে ওঠে গগণচুম্বী। কখনও কখনও সে রূপান্তরিত কাগজ ঠাঁই পায় জাদুঘরে, যাকে দেখতে ভিড় জমায় দর্শনার্থীরা।
ঠিক একইভাবে শিক্ষার্থীর সম্ভাবনার দুয়ারকে তিনি রাষ্ট্রের যাবতীয় কল্যাণের দিকে খুলতে সক্ষম হবেন। যা ফুটে উঠেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের লেখা চিঠিতে। যেটি তিনি পুত্রের প্রতি শিক্ষকের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন।
দেশের নীতি-নির্ধারকেরা যদি শিক্ষকতার মতন মহান পেশায় নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ নীতি প্রণয়ন করেন, যেখানে থাকবে নিয়োগ প্রার্থীর মনোঃনৈতিক বিশ্লেষণমূলক পরীক্ষা। যার দ্বারা তার আচরণমূলক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি দায়বদ্ধতার প্রমাণক হিসেবে বিশেষ কিছু উপায় অবলম্বন করা হয় তবে হয়তো ভবিষ্যতের প্রজন্ম আবার সুস্থ, সুন্দর এবং আদর্শের মাঝে বেড়ে উঠতে পারবে।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে শিক্ষকদের বেতন স্কেল থেকে সামাজিক মূল্যায়ন বহুলাংশে আমাদের থেকে অনেক বেশি যুগোপযুগী ও সমৃদ্ধ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তাদের বিশেষ নজর দেওয়া সময়ের দাবি। পাঠ্যসূচির বাইরে জাতির নীতি, আদর্শ, মানসিকতার উন্নতি সাধনে একজন শিল্পীতুল্য শিক্ষকের বিকল্প নেই। যিনি শিক্ষাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে অজানাকে জানবার তৃষ্ণাকে নিবারণ করবেন সৌন্দর্যবোধের আলোকে এবং হবেন জাতি গঠনের মূল রূপকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়