স্যার হওয়া যত সহজ, শিক্ষক হওয়া তত সহজ না
স্যার শব্দটি বর্তমানের বহুল প্রচলিত ও উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি। আমার লেখাটি কোনো স্যারকে নিয়ে না, মূলত শিক্ষক নিয়ে। তবে আমরা যেহেতু শিক্ষকদের স্যার বলে সম্বোধন করে থাকি, তাই এই সম্পূরক শব্দটি নিয়ে কয়েক লাইন বলতে হবে। কেননা শিক্ষক ছাড়াও সমাজে আশেপাশে অনেক স্যারদের উপস্থিতি রয়েছে। যারা তাদের পদকে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বোঝাতে স্যার শব্দটি আশা করে আর সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণির লোকজনও তাদের আশা পূরণ করে থাকে। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা তো রীতিমতো শব্দটি তার অর্জিত বলে অধিকার দাবি করে থাকে।
কিছু দিন আগের একটা ঘটনা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক শিক্ষক একজন জেলা প্রশাসককে (মহিলা) আপা বলে সম্বোধন করায় তিনি তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং বলেন এই চেয়ারে পুরুষ থাকলে কি বলতেন? শিক্ষক মহোদয় উত্তরে বললেন ভাই বলতাম। ডিসি মহোদয় আরো উত্তেজিত হয়ে বললেন এই চেয়ারে যিনিই থাকবেন তাকে স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। পরবর্তীতে ওই শিক্ষক তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করলে বিষয়টি কোনোভাবে মিউচুয়াল করে নেয়। কথা হচ্ছে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে এমন আচরণ করলে সাধারণ ব্যক্তির সাথে কিরকম হতে পারে সেটা আর বোধহয় বোঝার বাকি থাকার কথা না। প্রসঙ্গত উদাহরণটি দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষক এবং স্যার যে এক নয় সে বিষয়টা পরিষ্কার করা। আশা করি শব্দ দুটি কেন আলাদ অর্থে এখানে ব্যবহার করেছি বোধগম্য হয়েছে।
স্যার শব্দটি এতই পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে যে এটিকে বাংলায় বললেও মনে হয় শব্দটির যথাযথ ব্যবহার বিকৃত হয় সেই সকল তথাকথিত উচ্চ পদস্থ স্যারদের নিকট। স্যারের বাংলা প্রতিশব্দ জনাব। তবে জনাব বললেও মনে হয় শব্দটার ওয়েট হারায়।
যা হোক মুল কথায় আসা যাক। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সেই সকল স্যার হওয়া অনেক কঠিন ও যোগ্যতার ব্যাপার। অন্যদিকে শিক্ষক, যাকে বলে মাস্টার, এটা আর তেমন কি বিষয়। এরকম মনে করারও কথা।কারণ আমাদের রাষ্ট্র একজন উচ্চ পদস্থ আমলাকে যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা প্রদান করে, একজন শিক্ষককে তার দশমাংশও না। কিন্তু শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষার মেরুদণ্ড কে?
অবশ্যই শিক্ষক হলেন শিকার মেরুদণ্ড। যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে জ্ঞান, প্রসারিত হয় জ্ঞানের আলো,আলোকিত হয় মানুষ ও সমাজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজ আমাদের শিক্ষকেরা যথাযথ মর্যাদা পায় না। যেটা পায় সেটা হলো শিক্ষার্থীদের সম্মান। এটাই একজন শিক্ষকের বড় পাওয়া। একজন প্রকৃত শিক্ষক হওয়া মোটেও সহজ বিষয় নয়। যেখানে আমলারা সফলতা খোজে পদোন্নতির মাধ্যমে, আর শিক্ষক তার সফলতা খোজে তার শিক্ষার্থীকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে। বিনিময়ে সে সামান্য বেতন ছাড়া আর্থিকভাবে যে লাভবান হয় বিষয়টি তেমন নয়। তবে সে আত্মতৃপ্তি পায়। আর শিক্ষকের গুনের কথা লিখে শেষ করার মত শব্দ ও ভাষা এখনো আমি সম্পুর্ণরুপে আয়ত্ত করতে পারিনি। এটা আমি অকপটে স্বীকার করছি।
যারা জাতি গঠনে সর্বোচ্চ অবদান রাখছে তাদের মনে হয় এখনো আনার যথাযথ স্থান দিতে পারি নি।কারণ হয়তো সেই আসনে বসে আছেন সেইসব উচ্চ পদস্থ স্যারেরা। অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়ন না পাওয়ায় শিক্ষকতার মহান পেশায় অনেকে স্বেচ্ছায় আসতে চায় না। বিসিএস এ প্রথম চয়েস শিক্ষাক্যাডার কে দেয়? হয়তো ফরেন অ্যাফেয়ার্স না হয় প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডার। কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদার আকর্ষন প্রায় সবাইকে স্যার হবার দিকে টানে, শিক্ষক হওয়ার দিকে নয়। তবুও যারা এই আকর্ষণ উপেক্ষা করে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করে, সেটাকে অবশ্যই বলতে হবে স্যার(ক্ষমতাবান কর্মকর্তা) হওয়ার চেয়ে বেশি কঠিন।
লেখাটি দ্বারা আমি কোনো আমলা আা কর্মকর্তাকে ছোট করতে চাইনি। শুধু তুলনা করার জন্যই বিষয়টি আলোচনা করা। শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকের প্রতি রইলো অসীম কৃতজ্ঞতা, যারা স্যার নয় শিক্ষক হিসেবেই গর্বিত।
লেখক: শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়