ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য নাকি বিভাজন?

জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ
জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ  © টিডিসি ফটো

ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে ছাত্রঐক্যের প্রকাশ ঘটলো আজ, এটির সূত্রপাত যারা করেছিলো, সেই ইসলামী সংগঠনগুলোই ঘোষিত জোটে নেই। কেন আমি বাদ পড়া ইসলামী ছাত্রসংগঠনগুলোকে এর সূত্রপাতকারী বললাম, সেটা বুঝতে গত আগস্ট থেকে শুরু হওয়া প্রচেষ্টাগুলো একবার রিভিউ করে নেওয়া দরকার। ২৮ জুলাই গুলিস্তানে আওয়ামীলীগের শান্তিসমাবেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে নিহত হন হাফেজ রেজাউল করীম। এর প্রতিবাদে ইসলামী সংগঠনগুলো রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি দেয়। 

এরই অংশ হিসেবে হাফেজ রেজাউল করীম হত্যার বিচারকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটা ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয় খেলাফত ছাত্র মজলিস, ইসলামী ছাত্রসমাজ ও ছাত্র জমিয়তের সমন্বয়ে। পরবর্তীতে এখানে যুক্ত হয় ইশা, পরিষদ সহ সমমনা আরো কয়েকটি সংগঠন। ৮ আগস্ট একটি বৈঠকে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠন করা হয় এবং ১০ আগস্ট একটি জরুরী বৈঠক থেকে ১৬ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই উভয় বৈঠকেই ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুর রশিদ উপস্থিত ছিলেন। ১৬ আগস্টের সংবাদ সম্মেলন থেকে ২৪ আগস্ট শাহবাগে ছাত্র সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ছাত্র সমাবেশে আজকের ঘোষিত জোটের অংশীদার ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাগপা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিরা স্টেজে উঠে একসাথে ছাত্রঐক্যের প্রতিকী ছবিও তুলেছিলো।

এর মধ্যে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের উদ্যোগে ইশা ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ২০ আগস্ট বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সে মতবিনিময় সভায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নিজাম উদ্দিন রিপন এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাহিদ উদ্দিন তারেক সহ উপরস্থ বাম সংগঠনের নেতারাও ছিলেন। এরপর ফ্যাসিবাদ বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্রদলের আহ্বানে ২৮ আগস্ট তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অন্তর্ভুক্ত ইসলামী ও সমমনা সংগঠনগুলো সহ ১৯ টি ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভা থেকে ডান, বাম, ইসলামী সব ধরণের ছাত্রসংগঠন নিয়েই একটি বৃহত্তর ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে সম্ভাবনাময় একটি চেষ্টা শুরু হয়। 

উল্লেখ্য যে, ছাত্রদলের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় ইসলামী সংগঠনগুলোর উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। এটা বামপন্থী কিছু সংগঠন মেনে নিতে পারেনি। ফলে উদ্যোগটি সূচনাতেই হুমকির মুখে পড়ে। অবশ্য ছাত্রদলের উদ্যোগে আয়োজিত সে সভায় যুগপথ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সংগঠনগুলোর বাইরে অন্য বামপন্থী সংগঠনগুলো যায়নি। আজকেও যে জোট ঘোষিত হলো, সেখানে যুগপথ আন্দোলনের বাম ছাত্রসংগঠনগুলোকেই শুধু দেখলাম। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল এরা কিন্তু নেই। অথচ আমরা জানি বামপন্থীদের মধ্যে এরাই বেশি কট্টর এবং ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর সাথে কোনোরূপ সমঝোতায় যেতেও নারাজ। তো যখন এরাই ঘোষিত ছাত্রঐক্যে নেই, তাহলে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা দিলো কারা? 

গত সপ্তাহে আমি যে কোন একটা কাজে ইশা ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে এই জোটের সবচেয়ে সক্রিয় ও বেশি জনশক্তির বাম সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকও গিয়েছিলেন ইশার সভাপতির সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে। সভাপতির রুমে আমিও উপস্থিত ছিলাম সে বৈঠকে। সেখানে বাম ছাত্রসংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক যে বিষয়টি তুলে ধরলেন সেটি হলো, তারা চায় ইসলামী সংগঠন সহ সব মতের সংগঠন নিয়েই বৃহত্তর ছাত্রঐক্য গঠিত হোক। কিন্তু ক্যাম্পাসে তাদের এলাই অন্য বাম সংগঠনগুলো এটা মেনে নিচ্ছে না। আর ভবিষ্যতে যেহেতু ক্যাম্পাসে তাদের একত্রে মুভ করতে হবে, ফলে এই আপত্তিকে পাশ কাটিয়েও আসতে পারছে না তারা। আমি তখন প্রশ্ন করেছিলাম, আপত্তি তুলেছে কোন কোন সংগঠন। কিন্তু তিনি এটা স্পষ্ট করে বলতে চাইলেন না।

ফলে আমি ধারণা করে নিলাম ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রফ্রন্টই হবে তারা। কিন্তু আজকের ঘোষিত জোটে এদের নাম না দেখে অবাক হলাম। জোটে তো ওই বাম সংগঠনগুলোই ঘুরেফিরে, যারা ইতোপূর্বেও ইসলামী সংগঠনগুলোর সাথেই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় অফিসে উপস্থিত ছিলো। তাহলে কী দাঁড়াল অর্থটা? এখানে আরেকটি টুইস্ট হচ্ছে একেবারেই যে ইসলামী কোন সংগঠন যে নেই, এমনটাও না। বিএনপির সাথে জমিয়তে ইসলামের যে অংশটি এখনো এলাই হিসেবে আছে, তাদের ছাত্র সংগঠন কিন্তু এই জোটে আছে। তাহলে এখানে কয়েকটি 

প্রশ্ন দাঁড়ায়:
১. ধরলাম যুগপথ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত বাম সংগঠনগুলোই  ইসলামী সংগঠনগুলোকে নিতে বাধা দিয়েছে। যদি এটাই সমস্যা হয়, তাহলে ছাত্রজমিয়ত কিভাবে থাকলো?

২. যেহেতু ঘোষিত জোটের অধিকাংশ বাম সংগঠন ইতোপূর্বে ইসলামী সংগঠনগুলোর সাথেও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যে গিয়েছিলো অথবা তাদের সাথে দুটি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হয়েছিলো, তাহলে হঠাৎ কেন তারা বেঁকে বসলো?

৩. যেহেতু বিএনপির এলাই ছাত্র জমিয়তকে নেওয়া হয়েছে এবং ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রফ্রন্টের মতো ইসলামপন্থীদের ঘোর বিরোধীরাও জোটে আসে নাই, তাহলে অন্য ইসলামী ছাত্রসংগঠনগুলোকে নিতে সমস্যা কোথায় ছিলো ছাত্রদলের? এখানে আসলেই বামপন্থী সংগঠনগুলো বাধা, নাকি ছাত্রদল নিজেরাই বিভ্রান্ত হয়েছে?

৪. ছাত্র অধিকার পরিষদ সহ যে সংগঠনগুলো সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যে ছিলো ইসলামী সংগঠনগুলোর সাথে, তারা এখানে কী ভূমিকা রাখলো? তারা কি মনে করে গণসম্পৃক্ত ও বিরোধী এসব ইসলামী সংগঠনকে বাইরে রেখে ফ্যাসিবাদ বিরোধী অর্থপূর্ণ কোন ঐক্য হতে পারে?

৫. এই যে ডেকে নিয়েও পরবর্তীতে একপ্রকার অসৌজন্যতা দেখিয়েই ইসলামী সংগঠনগুলোকে বাদ দেওয়া হলো, এটা কি আরেক ধরণের "ফ্যাসিবাদ" নয়?

৬. ইশার কেন্দ্রীয় সভাপতি ঘোষিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যকে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করবে বলে যে বক্তব্য দিলো, এটি কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? বাস্তবেই কি একটি স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি করা হলো না বিরোধী সংগঠনগুলোর মধ্যে? এটা আদতে আওয়ামীলীগকেই তো ফায়দা দিবে তাই না?

৭. যদি উদ্দেশ্য থাকে যারা যুগপথ আন্দোলনে আছে তাদের নিয়ে এই ঐক্য, তাহলে যুগপথ আন্দোলনের শরীক ববি হাজ্জাজের ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও  লেবার পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র মিশনকে কেন রাখা হয়নি?

উপরোক্ত প্রশ্নগুলো খোলাসা না করলে গঠিত ছাত্রঐক্য হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া কোন কাজে আসবে বলে মনে করি না। আওয়ামীলীগের সাথে পুরোদস্তুর একটা ইসলামী মহাজোট এলাই হিসেবে আছে, অথচ বিএনপি বা ছাত্রদল কোন জুজুর ভয়ে গণসম্পৃক্ত সংগঠনগুলোকে বাদ দিয়ে গণবিচ্ছিন্নদের নিয়েই সমুদ্র পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে! ওয়ার অন টেররের যুগের সমাপ্তি ঘটার পর রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের সাথে দূরত্ব তৈরি করার মতো বোকামি বিএনপি কোন হিসেবে করছে, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না।

লেখক: জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ, সাবেক ঢাবি সভাপতি, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই)।


সর্বশেষ সংবাদ