২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:০৮

অন্ধকারের আলোকবর্তিকা তরুণরা কেন এই পথে?

আমজাদ হোসেন হৃদয়  © টিডিসি ফটো

আমাদের সমাজে আত্মহত্যা যেন নিত্যনৈমেত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় সব শ্রেণি-পেশা আর বয়সের মানুষই ঝুঁকছে এই আত্মহত্যার দিকে! যে মেধাবীদের এই অন্ধকারের আলোকবর্তিকা হওয়ার কথা, যারা নেতৃত্ব দেবে আগামীর বাংলাদেশকে, তারাও পা বাড়াচ্ছে এই পথে।৷ স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে জীবন থেকেই ঝরে পড়েছেন তারা। একইসাথে স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবারের স্বজনদের। আত্মহত্যা কেন করছে এসব মেধাবী তরুণরা? সে নিজে দায়ী? নাকি সমাজ ও রাষ্ট্র দায়ী? আত্মহত্যার পথ পরিহার করা যায় কীভাবে?

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশংকাজনকহারে বাড়ছে। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের করা এক জরিপে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সারাদেশে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এতে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, ২১৪ জন। আর ছাত্র ছিল ১৪৭ জন। তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই রয়েছেন ৬৬ জন। বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী। ৬৭.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিলেন এ বয়সী। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১.৬ শতাংশ।

আরও পড়ুন:  প্রেমিকা নয়, স্ত্রীর অবহেলায় ঢাবি ছাত্রের আত্মহত্যা — দাবি সহপাঠীর

দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেখানেও এর প্রবণতা কম নয়। গত এক মাসের ব্যবধানে আত্মহত্যা করেছেন তিন শিক্ষার্থী। গত তিন বছরে প্রায় ১৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা যায়। অথচ এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারকদের টনক নড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দিবস কেন্দ্রীয় দুই একটি কর্মসূচি ছাড়া বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দুই একদিন আলোচনা হওয়ার পর সবাই ভুলে যায় এ ঘটনা। কিছুদিন পর আবারো আরেকটি মৃত্যুর সংবাদ। এভাবেই চলছে। কারো যেন কোনো দায় নেই!

স্বপ্নবাজ তরুণরা যখন স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের কাছাকাছি পোঁছায়, পরিবারের মুখে হাসি ফুটাবে ঠিক তখনই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে তারা। কেউ অভিমানে, কেউ প্রেমঘটিত কারণে কিংবা কেউ হতাশায়! আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা একটি নিতান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক আচরণ বলে প্রতীয়মান হলেও ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল ডুরখেইম এটিকে সামাজিক ঘটনা বলে প্রমাণ করেন। তার মতে, আত্মহত্যা হলো স্বেচ্ছাকৃত আত্মধ্বংস কিন্তু এই স্বেচ্ছাকৃত কর্মটির কারণ সমাজের তথা সামাজিক সংহতি বা সমাজের নৈতিক বিন্যাসের মধ্যে নিহিত।

আরও পড়ুন : ঢাবি-বুয়েটসহ ৩ বিশ্ববিদ্যালয়কে ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ এডিবির

আত্মহত্যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় কিন্তু এর দায় আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। একজন স্নাতক পড়ুয়া কিংবা স্নাতক গ্রাজুয়েট কেন হতাশায় ভুগবে? তার হতাশার কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি? সমাধানের চেষ্টা করেছি কিংবা কতটুকু তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। এ ঘটনাগুলো তো প্রবাহমান। শিক্ষার্থীরা যে এই পথে পা বাড়াচ্ছে, সে দায় কী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এড়াতে পারে? তারা একজন শিক্ষার্থীকে কতটা কাউন্সিলিং এবং সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে পেরেছে? এক্ষেত্রে পরিবারের দায়ও কম বর্তায় না। পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা ও সুন্দর সম্পর্ক একজন মানুষকে সুস্থ থাকতে সবচেয়ে বেশি শক্তি যোগায়। যখন সব পরিস্থিতি তার বিপক্ষে তখন পরিবার এবং প্রিয় মানুষের সমর্থন পেলে অন্তত মানসিকভাবে দৃঢ থাকা যায়।

আত্মহত্যা একটি মহাপাপ। ইসলাম কিংবা কোনো ধর্মেই আত্মহত্যার মতো কোনো অপরাধকেই সমর্থন করে না। এহেন কর্ম থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব প্রদান করে বাণী প্রচার করেছে সব ধর্ম। এই প্রবণতা মহামারী আকারে ধারণ করার আগেই আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মৃত্যুর পর হাহুতাশ করতে পছন্দ করি আমরা কিন্তু মৃত্যুর আগে একজন মানুষের যত্ন নিতে ভুলে যায়। সে অযত্নের কারণে আমরা স্বপ্নের অপমৃত্যুর সাক্ষী হচ্ছি বারংবার। 

আরও পড়ুন : বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সবাইকে দক্ষতা অর্জন করতে হবে: ঢাবি ভিসি

দেখুন যে প্রিয় মানুষের জন্য নিজেকে শেষ করছি, সে কি নিদারুণ বেঁচে থাকে। আমার এই মৃত্যু কী তাহলে অর্থহীন নয়? যে হতাশায় নিজেকে শেষ করছি সেটি তো পূরণ হচ্ছেই না বরং নিজেকে ধ্বংস করছি। হতাশাকে পরিশ্রম দিয়ে জয় করতে হবে। একবার না পারলে শতবার চেষ্টা করতে হবে। আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে এই রাষ্ট্রকে, এই সমাজকেও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জোর দিতে হবে। যত বেশি সচেতনতা তৈরি করা যাবে, তত বেশি এই প্রবণতা হ্রাস পাবে।

পৃথিবীতে প্রত্যেক সমস্যারই সমাধান আছে, তেমনি আত্মহত্যা না করে এইসব সমস্যা থেকে বাঁচারও সমাধান আছে। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। নিজের জন্য বাঁচতে হবে, পরিবারের জন্য বাঁচতে হবে, স্বপ্ন পূরণের জন্য বাঁচতে হবে। পৃথিবীতে কেউ ভালো না বাসলেও নিজেকে নিজে ভালোবাসতে হবে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, এটি একটি সমস্যা- এটি আমাদের বুঝতে হবে এবং বুঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম