১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:৫০

সব বিষণ্ণতাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যেতে হবে

  © টিডিসি ফোটো

প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস।আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই পালিত হয় দিনটি। ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর এইদিনে "বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা" দিবসটি পালন করে আসছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর গোটা বিশ্বে ৭ লক্ষ ৩ হাজার জন মানুষ আত্মঘাতী হন। এর বাইরেও কয়েক কোটি মানুষ রয়েছেন, যারা ভয়াবহ অবসাদের সঙ্গে লড়াই চালাতে চালাতে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার কথা ভাবেন। কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এই প্রবণতাকে কমিয়ে আনা সম্ভব। আত্মহত্যা রোধে করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরছেন শাহ্ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ-

‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য’
আত্মহত্যা একটি বৃহৎ সমস্যা, যা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং ব্যক্তিগত কারণে ঘটতে পারে। এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং একটি সাধারণ সমাজের পরিস্থিতি সম্পর্কিত সমস্যা হিসেবে দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭ দশমিক ৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৬ জন।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কিত হলে, ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে পরিচিত থাকতে হবে এবং সবার জন্য সামাজিক সমর্থন প্রদান করতে হবে। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই নগণ্য বা হেয় প্রতিপন্ন করে দেখা হয়। খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশের জনগণ মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর যত্ন সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোর সাথে পরিচিত নয়। এবং পরিচিত থাকলেও এই ব্যাপারে বড্ড উদাসীন।

সামাজিক দিক থেকে একজন মানুষের অন্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ কমানো, পারিবারিক সম্প্রীতি দৃঢ়করণ, একে অপরকে নেতিবাচকভাবে বিচার করার মানসিকতা পরিবর্তন করা, ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানো, সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার কমিয়ে বাস্তব জীবনে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, ইত্যাদি হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায় ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ে অন্যতম চাবিকাঠি। 

সরকারের দিয়ে প্রয়োজনীয় সেবা এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে, যাতে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা এবং পর্যাপ্ত সমর্থন সাধ্য হয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় সরকার দ্বারা সচেতনতা প্রচার, শিক্ষা, এবং সম্মান্য মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া সমর্থন করতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাজের সমর্থন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষই সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

[তানজিম মালিহা, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি]

‘মানসিক চাপ কমাতে হবে’
বাংলাদেশে বর্তমানে আত্মহত্যা এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশন এর পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪০ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ের, ১০৬ জন উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের এবং ৮৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের। ২০২৩ সালে এসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণে বড় ভূমিকা রয়েছে তাদের বয়সের। এই সময়ে তারা বয়ঃসন্ধিকালের মধ্যে দিয়ে যায়, তাই নানারকম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। তারা নতুন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, সেখানে পরিবারের চাপ থাকে আবার পরীক্ষার ফলাফলে অনেক অভিভাবক সন্তুষ্ট হন না;সন্তানকে অতিরিক্ত চাপ দেন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের থেকে ফলাফলজনিত চাপের শিকার হয়ে থাকেন এবং এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীই আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলেন। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও উপরিউক্ত কারণগুলোর শিকার হন এবং এছাড়াও আরেকটি কারণ লক্ষ্য করা যায়- এইচএসসির পর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার, অনেকেই চান্স না পেয়ে সামাজিক চাপ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে পড়েন এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছেন। পড়াশোনা করাকালীন বাড়ি থেকে উপার্জনের তাগাদা দেয়া হয়, রেজাল্ট ভালো করার একটা ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন শিক্ষার্থীরা, শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থান হবে কিনা তার দুশ্চিন্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কড়া শাসনের ফলেও অনেক শিক্ষার্থী মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যান, যার ফলশ্রুতিতে আসে আত্মহত্যা। 

আত্মহত্যা প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে আমার মনে হয়। তারা যদি সর্বদা সহযোগিতা করে এবং কোনো শিক্ষার্থী বিপথগামী হলে তাকে ধীরে এবং সুন্দরভাবে বুঝিয়ে সুপথে আনার চেষ্টা করা দরকার; চাপ প্রয়োগ কোনো সমাধান নয়। অপরদিকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি শিষ্যের প্রতি সন্তানসূলভ আচরণ করেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হন তবে তাদের শিক্ষার্থী তথা দেশের এই প্রজন্ম নিরাপদ থাকবে। সরকারও বেকারত্ব দূরীকরণের পদক্ষেপ নিলে এবং আত্মহত্যা নিরুৎসাহিত করণে পদক্ষেপ নিলে শিক্ষার্থীরা সচেতন হবেন এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীরা জীবনে হতাশ না হয়ে মনে রাখবে- ‘একবারে না পারিলে দেখো শতবার’। তাহলেই কমে আসবে মানসিক চাপ, কমে আসবে হতাশা, কমে আসবে আত্মহত্যা।

[ফাহিম মুনতাসির রাফিন, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]

‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা জাতীয় জীবনে ট্রাজেডি’
'আত্মহত্যা' এই শব্দটির পেছনে লুকিয়ে আছে অপ্রাপ্তি, হতাশা, একাকিত্ব আর জীবনের কাছে পরাজয়ের অসংখ্য বলা না বলা গল্প। প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ।

আত্মহত্যা নিয়ে জরিপ করা আঁচল সংগঠন দেখিয়েছে, গত ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৭৯ জন, ২০২১ সালে ১০১ জন,২০২২ সালে ১০৬ জন আত্মহত্যা করেছে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার এই ক্রমবর্ধমান হার জাতির জন্য চরম বেদনা ও হুমকিস্বরূপ । চার সাবজেক্টে ফেল আসায় রুয়েট শিক্ষার্থী রুমি, কিংবা মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায় কুষ্টিয়ার হাফসা বা কেবল দেখতে অসুন্দর হওয়ায় হেয় প্রতিপন্ন হয়ে বুয়েট শিক্ষার্থী রাফির মত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার এই মিছিল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করে তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের উদাসীনতাকেও আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়।

অনেক স্বপ্ন, আশা নিয়ে বেড়ে ওঠা একটি প্রাণ যখন জীবনের প্রকৃত অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার পূর্বেই ঝড়ে পরে,তখন সেই ব্যর্থতা কেবল আর ব্যক্তিপরিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর্থ-সামাজিক কারণ, ভোগবাদী চিন্তাধারা, একাকিত্ব, মানসিক চাপ,যান্ত্রিকতা নির্ভর জীবনব্যবস্থা, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে থাকে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার এই প্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য কাউন্সেলিং নেওয়ার সুযোগকে সহজ করতে হবে। দক্ষ মনোবিদের সহায়তায় একজন শিক্ষার্থীকে চাপ-ব্যবস্থাপনার কৌশল শেখানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনে চূড়ান্ত সফলতা হলো বেঁচে থাকা এবং অন্যকে সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করা।

[সায়মা মালিহা, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]

‘ধর্মীয় অনুশাসন মানা জরুরি’
আজকাল টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্র খুললেই আত্মহত্যা নিয়ে দুয়েকটা নিউজ চোখে পড়ে। আত্মহত্যা নামক ব্যাধিটি সমাজে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। আত্মহত্যা করে জীবননাশের সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই।

গবেষণায় প্রমাণিত যে মানসিক অসুস্থতা, বিশেষ করে বিষণ্ণতা, ব্যক্তিত্ব ও আবেগের সমস্যা, মাদকাসক্তি আর সিজোফ্রেনিয়ায় যারা ভুগছেন; তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। পৃথিবীতে বছরে আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। বাংলাদেশেও এই সংখ্যাটা কম নয়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭ দশমিক ৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৬ জন। ইদানীং বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

আঁচল ফাউন্ডেশন এর পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪০ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ের, ১০৬ জন উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের এবং ৮৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের।

এই ব্যাধি দূর করতে এখনই সবার পদক্ষেপ নিতে হবে। কি আচরণ করলে সন্তানদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার প্রসার ঘটবে—এ নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের। সব ধর্মেই আত্মহত্যা করা মারাত্মক অপরাধ। তাই প্রত্যেকেই যে যার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে। আত্মহত্যা করা পাপ—এই ধর্মীয় শিক্ষাটি পরিবার থেকেই দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও শিক্ষার্থীদের মনে মোটিভেটেড করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে, মাথায় বিষয়টি এমনভাবে দিতে হবে যে আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। সমস্যা, সংকট, বিষাদ, দুঃখ এসব থাকবেই। কিন্তু আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সব বিষণ্ণতাকে দূরে ঠেলে তাকাতে হবে সামনে। একটা দুঃখ আসবে তাতে কি! সেই দুঃখকে কাটিয়ে নতুন করে চলতে হবে। কারণ একটাই জীবন।

[খাদেমুল ইসলাম সাকিব, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]