বিসিএস প্রস্তুতি সৃজনশীল চিন্তাভাবনার অন্তরায়
সর্বোচ্চ ক্ষমতা পেলে আমি প্রথমেই বাংলাদেশ থেকে বিসিএস পরীক্ষা তুলে দেব কিংবা পরিবর্তন আনব। বিসিএস পরীক্ষা সৃজনশীলতার পথ সংকুচিত করে শিক্ষার্থীদেরকে ঘরকুনো ব্যাঙ বানিয়ে দিয়েছে।প্রত্যেক উপজেলায় বিসিএস ক্যাডার আছে, চাকরি করে টাকা নেয়,তাদের আর কোনো উল্লেখযোগ্য সৃজনশীল কাজ নেই।লক্ষ লক্ষ বিসিএস ক্যাডার কিন্তু তাদের কোনো আবিষ্কার নেই, গবেষণা নেই।দিন শেষে ক্যাডার, এখানেই সন্তুষ্টি।
কে, কখন, কোথায়, কী আবিষ্কার করে—এই দেশের শিক্ষার্থীরা তা মুখস্থ করায় মগ্ন, ফলে আবিষ্কারের নেশা তাদের মাঝে নেই।সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা তাদের থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য বই মুখস্থ করা নিয়ে দিন-রাত একাকার করে নিজেদেরকে উজাড় করে দেয়। কেউ একজন বিসিএস ক্যাডার হবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এসএসসি উত্তীর্ণ সবাই এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না, এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবাই স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। এভাবে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবাই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়।
একজন মানুষ বিসিএস ক্যাডার হয়, নিশ্চয় তিনি পরিশ্রমী এবং তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর। কিন্তু মূলধারার মিডিয়ায় আবেগপ্রবণ সাংবাদিক কর্তৃক তাদেরকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়, যেন তারা এলিয়েন, এভারেস্টজয়ী, পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি কিংবা কোনো সদ্য আবিষ্কৃত আজব দেশের মহামানব। অতিরিক্ত প্রচারণা বিসিএসকে জিপিএ-৫ এর মতো মানহীন বানিয়ে দিচ্ছে কি না, সেটা খেয়াল করা সময়ের দাবি। আর বিসিএস ছাড়া জীবন অসার ও অর্থহীন, এরকম একটা প্রচারণা প্রতিষ্ঠিত হলে অন্য সকল মানুষ হতাশা সাগরে নিমজ্জিত হবে এবং আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে।
তাছাড়া বিসিএস বিষয়ভিত্তিক চাকরির অন্তরায়, সামগ্রিকভাবে স্থানভেদে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায় না। ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি পড়ে পুলিশ, প্রশাসন কিংবা পররাষ্ট্র ক্যাডারের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, ফলে রাষ্ট্র হারায় মেধাবী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা গবেষক। সিস্টেমের দুষ্টচক্রে একটা আসন পূর্ণ হয় ভিন্ন বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে যে,বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং শুধু বিসিএস ক্যাডার হওয়াতে উক্ত পদে চাকরি পেয়েছেন; যা খুবই দুঃখজনক এবং এটি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম লজ্জা।
যাইহোক, বিসিএস বাদ না দিলেও সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। যে ফিজিক্সে পড়াশোনা করেছে, সে নতুন কিছু আবিষ্কার করলে বিসিএস ক্যাডার হবে। যে বাংলা সাহিত্যে পড়েছে, সে আন্তর্জাতিক মানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতা কিংবা উপন্যাস লিখতে পারলে কবি ও ঔপন্যাসিক হওয়ার পাশাপাশি বিসিএস ক্যাডার হবে। যে মেডিকেলে পড়েছে, সে নতুন ওষুধ আবিষ্কার করলে কিংবা রোগ নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা উপস্থাপন করলে কিংবা বিনা সিজারে অধিক সংখ্যক শিশু প্রসব করাতে সক্ষম হলে বিসিএস ক্যাডার হবে। যে প্রযুক্তির উপর পড়াশোনা করেছে,সে নতুন প্রযুক্তির সন্ধান দিলে প্রযুক্তিবিদ কিংবা বিসিএস ক্যাডার হবে। এতে করে মানুষ কাজের মধ্যে থাকবে, গবেষণার প্রতি আগ্রহী হবে। বসে বসে বিবি তালাকের ফতোয়া কিংবা চেতনার ফেরিওয়ালা খুঁজবে না।
কবি নজরুলের যথার্থই বলেছেন—
দুনিয়া যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখন বসে,
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজি
কোরআন-হাদীস চষে।।
যা হোক, বিসিএস নিয়ে/সেক্টর ভিত্তিক চাকরি নিয়ে ভাবা সময়ের দাবি। বিষয়ভিত্তিক কিংবা যোগ্যতা ভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা না হলে অর্জিত ডিগ্রির অপচয় হবে।পরিবর্তন আনতে হবে, যেন রাষ্ট্র যথাস্থানে যোগ্য প্রার্থী পায়। এতে আমরা অন্য দেশের আবিষ্কার মুখস্থ করা নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকব না, আবিষ্কার নিয়ে ব্যস্ত থাকব।নির্দ্বিধায় বলা যায়, অনুকরণ করে কথা বলা পাখি ময়না, টিয়া এবং শালিক অপেক্ষা শৈল্পিক ইঞ্জিনিয়ার বাবুই পাখি বেটার।
লেখক: উদীয়মান গীতিকার