অন্তরঙ্গ কিংবা অশ্লীল ছবি ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে করণীয় কী?

কামরুজ্জামান পলাশ
কামরুজ্জামান পলাশ  © টিডিসি ফটো

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ, কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন”। আসলেই প্রকৃতপক্ষে এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে কবি গুরুর উক্তিই যেন ঠিক হলো। কেননা, দেখা যায় যে, আজকাল তরুণ-তরুণী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরের প্রেমে পড়ে পরবর্তীতে অন্তরঙ্গ ছবি কিংবা ভিডিও আদান-প্রদান করেন। কিন্তু এই প্রেমিক যুগলের কোন প্রকার ধারণাই থাকে না যে, তাদের জন্য অদূর ভবিষ্যতে কি ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে। যখনি তাদের বিচ্ছেদ ঘটে, তখনি একটি পক্ষ তাদের কাছে থাকা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি কিংবা ভিডিওর মাধ্যমে অনবরত ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এবার কিছু ঘটনা দেখে নেয়া যাক...

ঘটনা-১
২৫ আগস্ট ২০২০। একুশে টেলিভিশনের অনলাইন সংস্করণে “আপত্তিকর ছবি দিয়ে বিবাহিত প্রেমিকাকে ব্ল্যাকমেইল, প্রেমিক গ্রেপ্তার” শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে জানা যায় যে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিবাহিত প্রেমিকাকে ব্ল্যাকমেইল করতে একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু আপত্তিকর ও অশালীন ছবি পোস্ট করে ঐ মেয়ের প্রেমিক। ভূক্তভোগীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এক পর্যায়ে কিছু ছবিও তুলে রাখে। ২০১১ সালে ভূক্তভোগিকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দাওয়া হলে ঐ প্রেমিক তার কাছে থাকা ভূক্তভোগির আপত্তিকর ছবির বিনিময়ে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ওই প্রেমিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।  

ঘটনা-২  
গত ১৮ জুলাই  ঢাকা পোস্টে “প্রেমিকার আপত্তিকর ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল, গ্রেপ্তার যুবক” শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে উল্লেখ করা হয় যে, প্রেমিক যুগল রেস্টুরেন্টে গেলে প্রেমিক সুকৌশলে প্রেমিকার সাথে কিছু আপত্তিকর ছবি তোলে ।তাদের পরবর্তী সাক্ষাতে ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার হূমকি প্রদানের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর সাথে শারীরিক সম্পর্কের চেষ্টা করে এবং পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হন।

এই রকম অপরাধের ভূক্তভোগী শুধু মাত্র নারীরাই যে হন তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে অনেক প্রতারক চক্র টার্গেট করেন অনেক বিত্তশালী পুরুষদের। এখন দেখে নেওয়া যাক সেই ঘটনা....

ঘটনা-১
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। নারায়ণগঞ্জ টাইম্‌স এ “ফেসবুকে পরিচয়, বাসায় ডেকে স্ত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল” শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে বলা হয়, ফেসবুকে পরিচয় অতঃপর ক্রমান্বয়ে মন দেওয়া-নেওয়া, বিপত্তি ঘটে যখন প্রেমিকার বাসায় যাওয়া হয়। নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে ফেসবুকে ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) তদন্তে গিয়ে দেখতে পান যে, এই চক্রটি এই পর্যন্ত ২৫ জনকে বাসায় ডেকে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা।

ঘটনা-২
১৯ আগস্ট ২০২২ সালে দৈনিক আমার সংবাদ এ “প্রেমের ফাঁদে ফেলে আপত্তিকর ছবি তুলে করত ব্ল্যাকমেইল” শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে বলা হয়,চক্রের নারী সদস্যরা বাসায় এনে জিম্মি করে আপত্তিকর ছবি তুলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। যা হোক পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেন।

এবার আশা যাক, এমন পরিস্থিতির শিকার হলে ভূক্তভোগীর প্রতিকার কী?

২০১৮ সালের ৪৬ নং আইন “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮” এর ধারা-২৫(১)(ক) এই সমস্যা সংক্রান্ত প্রতিকার প্রদান করে। যাতে বলা হয়েছে যে, “কেউ জ্ঞাতসারে কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরন করলে ,যাহা আক্রমনাত্মক বা ভীতি তৈরি করে অথবা প্রচারকারী জানেন যে উক্ত তথ্য-উপত্তটি  মিথ্যা। তা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে এমন কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রচার কিংবা প্রকাশ করলে উক্ত ব্যক্তি (প্রচারকারী) অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দন্ডিত হবেন।

যদি এই অপরাধ তিনি পুনরায় করেন তাহলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ডে  বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দন্ডিত হবেন।

তাছাড়া ২০১২ সালের ৯নং আইন “পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন-২০১২” এর ধারা-৮(২) এই সমস্যা সংক্রান্ত প্রতিকার প্রদান করে।যাতে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি পর্ণোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোন ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদা হানি করলে বা ভয়-ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোন সুবিধা আদায় বা কোন ব্যক্তির জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ধারণকৃত কোন পর্ণোগ্রাফির মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে মানসিক নির্যাতন করলে তিনি(অপরাধকারী) সর্বোচ্চ ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

গত ২৯ এপ্রিল চ্যানেল ২৪ এর অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে যে, বিটিআরসি এর হিসাব অনুযায়ী দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি। পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায় যে,আমরা প্রতি মুহুর্তেই উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে ও ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে সাধারন জনগণের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত। উক্ত কর্মকাণ্ডে সরকারের পাশাপাশি সকল বেসরকারি সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ উপহার দিতে পারব।  

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ