একটি হতাশা জয় করার গল্প
এই গল্প জীবন আর মৃত্যুর দোলাচলে সব সময় বেঁচে থাকার চেষ্টা করা, টিকে থাকার গল্প। আমার জীবনের গল্প, আমার মায়ের গল্প, আমার পরিবারের গল্প। ২০১৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস। বন্ধুরা যখন দেশ-বিদেশ, জিআরই, জব, সিভি নিয়ে প্ল্যানিং করছে আমার মাথায় তখন এক গাদা ল্যাগের বোঝা। কোন জন্মে পাস করতেই পারব কিনা ঠিক নাই। এর মাঝে বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, একমাত্র বিসিএসেই পাস না করে এপিয়ার্ড দিয়ে আবেদন করা যায়। অন্যকোন গতি না দেখে এপিয়ার্ড দিয়ে ৪১তম বিসিএসে আবেদন করি।
এর মধ্যে আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। বাবা, আমি আর আমার ছোট ভাইয়ের ঠিকানা হয়ে গেল হাসপাতাল। ছোট একটা হাসপাতালের রুমে বাবা-মা বেডে থাকত, আমি আর ছোট ভাই ফ্লোরে।
কখনও কেমোথেরাপি, কখনও রক্ত পরীক্ষা, কখনও অপারেশন। মায়ের দেখ-ভাল করার কঠিন চ্যালেঞ্জ, খাওয়া-দাওয়া, বাথরুম, স্নান আর এর মাঝে পড়াশোনা, নিজেকে প্রস্তুত করা। অপারেশনের সময় এমন হয়েছে টানা প্রায় ৩ সপ্তাহ ছোট একটা মেঝেতে আমি আর ছোট ভাই। রাতে লাইট জ্বালাতাম না, কারণ তাতে মা-বাবা ঘুমাতে পারতেন না। মোবাইলে অ্যাপে পরীক্ষা দিতাম, যে পড়াগুলো পড়ার বইয়ের ছবি তুলে আগে থেকেই পিডিএফ করে রাখতাম।
আমার মায়ের যে দিন প্রথম কেমো দেয়া হয়, সেদিন আমি থাকতে পারিনি। কারণ সেদিন আমার একটা সাপ্লি পরীক্ষা ছিল। আগের সারা দিন মাকে নিয়ে দৌঁড়ান, নানান টেস্টের পর আমি পরীক্ষার কথা ভুলেই যাই। রাতে মূমুর্ষু অবস্থায় যখন মাকে অ্যাম্বুলেসে নেয়া হয়, আমার তার ঠিক আগে সাপ্লির কথাটা মাথায় আসে। আমি আস্তে করে আমার ছোট ভাইকে বলি- ভাই, আমার সাপ্লি। ও আর একটা কথাও না বলে সব দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ওইদিন ও যে কত বড় একটা ম্যাচুরিটির পরিচয় দিয়েছে। বড় ভাই হিসেবে ওর এই কাজটার জন্য আমি আজীবন ঋণী থাকব।
মা-বাবার সঙ্গে প্রীতম কুমার মণ্ডল
সাপ্লি শেষে কোন মতে পাস করে ডিপিইর একটা প্রোজেক্টে ঢুকে পড়ি। এর মধ্যে ২০২০ সালে করোনার আঘাতে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল। প্রোজেক্টের ভয়াবহ শারীরিক, মানসিক খাটুনি হলেও আর্থিক দিক থেকে কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিলাম। প্রজেক্ট বন্ধ হওয়ার সেই জায়গাটাও চলে গেল।
এর মধ্যে করোনার জন্য বিসিএসের পরীক্ষা বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। হতাশ হয়ে একটা পর্যায়ে বাইরে যাওয়ার চিন্তা করি। কিন্তু, আমার যে রেজাল্ট আর এতগুলা সাবজেক্টে ফেল মনে হল, আমার এই রেজাল্ট দিয়ে কোন মতেই বিদেশ যেতে পারব না। দেশে মোটামুটি একটা ভালো মাস্টার্স যদি করি, হয়ত বা সম্ভব হতেও পারে। এই চিন্তা থেকে ঢাবিতে রিনিউয়েবল এনার্জি ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষা দেই। আমার পরিশ্রম, প্রচেষ্টার প্রথম ফল পাই। মাস্টার্সের ভর্তি পরীক্ষায় আমি প্রথম হই। এই পরীক্ষা আমার কনফিডেন্সের লেভেলটা অনেক অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি আমাকে দিয়ে কিছু হবে। এরপর সাহস করে একে একে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন এবং জেনোসাইড স্টাডিজেও দুইটা পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা করে ফেলি।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২১ সালের ১৯শে মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলি পরীক্ষা হয়। আমার প্রিলিটা দিয়েই আমি চলে যাই রেল স্টেশনে। কারণ, ২১ তারিখেই আবার মাকে কেমো দিতে হবে। মা আসছে খুলনা থেকে। ২০২১ সালের ১লা আগস্ট বিসিএস প্রিলির রেজাল্ট দেয়। ঠিক এর আগের দিনই আমার ঠাকুরদা মারা যান।
এর মধ্যে বেবিচকের সিনিয়র অফিসার প্রিলি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। রিটেনের ডেট ছিল শুক্রবার। এর মধ্যে মা চিকিৎসার জন্য শনিবার ভারত যাবেন। বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করার পর আমার শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল। খুলনা যাব কি যাব না দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলাম। কিন্তু , মা ভারতে যাবেন, এর আগে দেখা হবে না এটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। প্রচন্ড অসুস্থতা নিয়ে খুলনা গেলাম। তখনও পদ্মা সেতু হয় নি। যেতে অনেক সময় লাগত। মাকে দেখে রাতের বাসেই ঢাকা রওয়ানা দিলাম পরদিন পরীক্ষা ধরব বলে। রাতে ফেরি ঘাটে বিশাল জ্যাম হল। ৯.৩০ টারও পরে ঢাকা পৌছালাম। পরীক্ষা ১০টায়। ১৫ মিনিট লেট। সিটে বসে মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। ১৮-২০ ঘণ্টার টানা জার্নি, কোন ঘুম নাই। সকালে খাই না। লিখতে হাত কাঁপছিল। এত কিছুর পরও পরীক্ষাটাতে কোয়ালিফাই করে গেলাম মনে হয় শুধু মাত্র ভবগানের কৃপা আর মায়ের আশীর্বাদে।
মায়ের সঙ্গে প্রীতম কুমার মণ্ডল
বিসিএস ভাইভার আগেও ভগবান আমাদের সবার বড়-সড় পরীক্ষা নিলেন। ২০শে মার্চ আমার ভাইভা ছিল। ১৩/১৪ ই মার্চ থেকেই মায়ের শারীরিক অবস্থা একটু খারাপ ছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ করেই ভয়াবহ খারাপ অবস্থা হল। সারা পেটে পানি চলে আসল, গ্যাস, আর কিছুক্ষণ পর পর বমি। কোন কিছুই খেতে পারেন না। জল খেলেও বমি হয়ে যায়। ১৮ই মার্চ রাত ২.৩০-৩ টা পর্যন্ত থেকে পেট থেকে ৪.৫ লিটারের উপরে পানি বের করা হল। আমি আর ছোট ভাই হাসপাতালে। পেটে দানা পানি কিছুই পড়ে নি। দেশে ডাক্তাররা এক রকম হাল ছেড়ে দিলেন। ২০ তারিখ আমার ভাইভা। ওই দিন সকালেও আমি জানি না , কি শার্ট পড়ব , কি স্যুট পড়ব কি করব। ভাইভাটা দিলাম। ২২ তারিখ সকালে মাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেয়া হল। টানা এক মাসের উপরে চিকিৎসা চলল ভারতে।
শেষ কথা
সাম্প্রতি মায়ের ৩৪তম কেমোথেরা[পি দেয়া হল। আপনারা সবাই উনার সুস্থতার জন্য দোয়া, প্রার্থনা করবেন। জীবনে ভালো যে কোন কিছু অর্জনের জন্য মায়ের আশীর্বাদ, পরিবারের আশীর্বাদ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যে অবস্থায় বেবিচকের পরীক্ষা, বিসিএসের ভাইভা দিয়েছি, এই ফলাফল, এই অর্জনকে আমার শুধু মায়ের আশীর্বাদ ব্যাতীত কিছু মনে হয় না।
এডমিশনের সময়ে প্রায় দেড়টা মাস আমার ছোট ভাই মার চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিল। একদমই পড়তে পারি নি। এরপরও প্রায় প্রতি সপ্তাতে ছুটে বেড়িয়েছে কেমোথেরাপির জন্য। এত ঝড়-ঝঞ্চার পরেও সে ঢাকা ডেন্টালে প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছে, কুয়েট, রুয়েট, গুচ্ছ সবখানে চান্স পেয়েছে। I feel proud of him.
শুধু, নিজের চেষ্টা থাকলে এটা হয় না, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, এখানে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ লাগে। আমাদের সামনে যেতে হবে আরও বহু পথ। Life is a journey, not a destination. জীবনে সংকট, হতাশা আসবেই।
Just try to face.
Live, and Fight until you die.
The show must go on.
Miles to go Before I sleep.
লেখক: ৪১তম বিসিএস (খাদ্য) ক্যাডারে সুপারিশকৃত, মেধাক্রম-১ম ও সাবেক শিক্ষার্থী, বুয়েট