এনটিআরসিএর নিবন্ধিত বৈধ সনদধারীরা রাস্তায় কেন?
মূল কথায় যাওয়ার আগে এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখা ‘কমন-সেন্সের বাইরে’ হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিতে চাই। লেখার শুরুতেই তিনি বলেছেন- ‘‘আমি আমার দীর্ঘ জীবনে যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি তার মাঝে একটা হচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো জটিল বিষয় আসলে কমন-সেন্স দিয়ে মোটামুটি বুঝে ফেলা যায়। একেবারে পুরোটা বোঝার জন্য হয়তো বড় বড় বিশেষজ্ঞ দরকার হয়। কিন্তু কাজ চালানোর মতো বোঝার জন্য কমন-সেন্সেই যথেষ্টে।’’
তিনি আরও লিখেছেন- ‘‘শিক্ষক নেওয়ার প্রক্রিয়াটা যথেষ্ট মানসম্মত। স্নাতক-মাস্টার্স করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছে এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কাজটা এখন স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেও রেখেছেন- মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না। নিয়োগ দেওয়ার মতো প্রার্থীর কোনো অভাব নেই। আমি আমার কমন-সেন্স দিয়ে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, স্কুলে-কলেজে শিক্ষক প্রয়োজন; শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তালিকাভুক্ত প্রার্থী এরই মাঝে পরীক্ষা নিয়ে খুঁজে বের করা রাখা হয়েছে; শিক্ষকের অসংখ্য শূন্য পদ আছে, কিন্তু নিয়োগ নেওয়ার বিশাল দক্ষ-যজ্ঞ করার পরও পদগুলো খালি রয়ে যাচ্ছে। কেন এনটিআরসি’এ বলছে- উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি। ’’
তিনি অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেন- ‘‘শিক্ষক প্রার্থীরা এ ধরনের কিছু নির্মম রসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শাহবাগে কাঠফাটা রোদে বসে গণঅনশন করছেন; কিন্তু কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে না। এই দেশে সবচেয়ে নির্যাতিত প্রজাতি হচ্ছেন শিক্ষকরা। তাদের থেকে হতভাগা যদি কেউ থাকেন, তাঁরা হচ্ছে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য সনদ পাওয়া এই প্রার্থীরা। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে মামলা- মোকদ্দমা হচ্ছে। একেকরার একেকটি পরীক্ষায় প্রার্থীরা একেক নম্বর পান। পদ্ধতির পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। তাই যদি সবাইকে নিয়ে মেধা তালিকা করা হয় তাহলে কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হবে এবং কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেগুলো সমন্বয় করার বৈজ্ঞানিক পদ্বতিও আছে। সেগুলোর প্রয়োগ না করে চাকরি প্রার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলে সেটি হবে চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা। তবে যে শিক্ষকরা জাল সনদ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, তাঁরা ক্লাসে চুরি-ডাকাতি- প্রতারণা করানোর বাইরে আর কী পড়ান- আমার জানার খুব কৌতূহল। ’’
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সাথে আপনিও একমত হবে যে, কমন-সেন্স দিয়ে যদি কেউ উচিত-অনুচিত বুঝতে না পারে তাকে বোঝানো চেষ্টা করা বৃথা। যারা অধিকার আর আবদারের পার্থক্য বুঝে না, যারা সমান অধিকার আর ন্যায্য অধিকার এর পার্থক্য বুঝে না, তাদের বুঝানো চেষ্টা শুধু বৃথাই না কখনো কখনো পাপও বটে। এতক্ষণেও যাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি, তারা দয়া করে থামুন, আর পড়বেন না। এলেখা আপনার জন্য না।
লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক আনিসুল হক কোনো একটা লাইভে বলেছিলেন- লেখলে কাজ হয়না তা নয়, লেখলেই কাজ হয়। আমরা এখনও বিশ্বাস করি- বিবেক থাকলে সূর্যোদয় হবেই। সময়ের প্রয়োজনেই হয়তো প্যানেল হবে, তবে সেই গর্বিত কাজটি কিভাবে, কার হাত দিয়ে হবে সেটাই দেখবার বিষয়।
যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে গঠিত হয়েছিল বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কতৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। বেশিরভাগ কমিটিতে শিক্ষক নিয়োগের মূল যোগ্যতা (স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ বাণিজ্য) ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। মেধাবীরা এনটিআরসিএ’র সনদ থাকা সত্ত্বেও কমিটির শর্তপূরণ করতে না পেরে হয়ে যেত নিয়োগ বঞ্চিত। ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষক সুপারিশের ক্ষমতা দেন এনটিআরসিএ’র হাতে। কোর্টের রায়ে-নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকাভুক্ত করা হলে (গেজেটে নম্বরভিত্তিক এগিয়ে থাকার কোনো পূর্ভাবাস না থাকায়) পুরাতনদের নব্বই ভাগের অবস্থানই তালিকার শেষাংশে ।
শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসিএ তিনটি গণবিজ্ঞপ্তি দিতে সক্ষম হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে প্রচুর অনিয়ম। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হতো- বিশাল শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হতে যাচ্ছে। দিন শেষে লাখ লাখ টাকার আবেদন করে শুধুমাত্র এনটিআরসিএ’র ২৫ ভাগ এরও কম সুপারিশ দক্ষতায় নিরাশও নিয়োগ বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভে ফেটে পরে নিবন্ধিতরা। ক্ষোভ থাকবেনা কেন- আবেদন নেওয়া হয় হাজার হাজার কিন্তু সুপারিশ বঞ্চিত করা হয় সুকৌশলে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলির সিষ্টেম চালু না থাকায়, গণবিজ্ঞপ্তিতে সকল প্রার্থীর কাছ হতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদন নেওয়া হলেও বারবার এমপিও প্রাপ্ত (ইনডেক্সধারী) শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান বদলের সুযোগ পেত, ফলে শুন্য পদ শুন্যই থাকত। প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের ব্যানারে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে শাহবাগে চরম রসিকতার বিরুদ্ধে গণঅনশন করেন ৬৪ জেলা থেকে আসা নিয়োগ বঞ্চিত চাকরি প্রত্যাশীরা। সকল নিবন্ধিত শিক্ষকদের একত্র হয়ে তিন দফা (এক আবেদনে প্যানেল নিয়োগ , স্ব স্ব নীতিমালায় নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত নিবন্ধন পরীক্ষা বন্ধ রাখা, ইনডেক্সধারীদের প্যানেলের অন্তর্ভূক্ত না করা) দাবিতে মাঠে নামেন।
৫ই জুন, ২০২২ শুরু হয় গণঅনশন। এমপি-মন্ত্রী দাবির পক্ষে কথা বলেন, শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ কথা বলেন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দপ্তরে পাঠানো হয় স্মারকলিপি। জাতীয় সংসদে বিষয়টি দুইবার উপস্থাপিত হওয়ার পরও কোনো সুরাহা হলো না। গণঅনশনে শিক্ষকেরা রাস্তার ধুলাবালি, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, সিত্রাং-এর মাঝে গড়াগড়ি করেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। অধিকার বঞ্চিত চাকরি প্রত্যাশীদের কান্না কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছালো না তা দুঃখ জনক। ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ নিরুপায় হয়ে ২০০ তম দিনে শিক্ষকেরা মন্ত্রণালয়ের অভিমুখে যাত্রা করলে পুলিশের বাঁধার মুখে পড়ে তারা। দীর্ঘ সাড়ে চারঘন্টা শাহবাগ মোড়ে অবরুদ্ধ অবস্থার পর ফোন করলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে আলোচনায় বসার তারিখ দিলেন। ঐ দিনই কিছুক্ষণ পর প্রকাশিত হল গণবিজ্ঞপ্তি। শিক্ষামন্ত্রীর কথার ব্যতয় দেখে- শিক্ষক নেতারা শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করা ও কথা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু সম্ভব হলো না।
প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের সেক্রেটারি জি. এম ইয়াসিনের ফোনে যে তারিখ দিয়েছিলেন, সেই তারিখও তিনি রাখলেন না। অবশেষে ০২.০১.২০২৩ তারিখ আলোচনায় বসলেন তিনি। সভার শুরুতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সংক্ষেপে সরকারের প্রশংসা করেন। মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য শেষে- প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি প্যানেল নিয়োগের তিনদফা দাবি এবং দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। দেড় ঘন্টার আলোচনায় মন্ত্রী বললেন- আপনাদের দুইটি দাবি আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে; এক আবেদনে নিয়োগ, ইনডেক্সবিহীন গণবিজ্ঞপ্তি-এ দুইটি দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। তিনি আরও বললেন, আপনারা হবু শিক্ষক। এখনও শিক্ষক হন নাই (২০০৬ গেজেট, ১১ নংধারা পরিপন্থি)। শিক্ষামন্ত্রীয় কথার মর্মার্থ বুঝতে বাকী থাকল না। মাননীয় মন্ত্রীর কথা শুনে মনে হলো- তিনি যেনো নিবন্ধিত শিক্ষকদের মন্ত্রী নন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বললেন- এ সনদ তো চাকরির নিশ্চয়তা নয়, নূন্যতম যোগ্যতার সনদ। শিক্ষক নিবন্ধন সনদকে ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সাথে তুলনা করায়, ক্ষিপ্ত হয়ে যান শিক্ষক নেতারা। তারা বলেন- আমরা তো ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষা কিংবা বিদেশ গমনের মতো কোন নিবন্ধন সনদ অর্জন করিনি। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের সনদ অর্জন করেছি। ২০০৬ সালের ৩০ জুলাই প্রকাশিত গেজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাস করা ৩(ক), ৩(খ) এবং ৯(ঘ) ধারাগুলো দেখানো হলো।
শিক্ষক নেতারা বললেন, সনদেই লিখে দিয়েছেন- He/ She is eligible to be appointed as Lecturer of Mathematics at any Higher Seondary School/College/Madrasa/Bussiness Management institute in Bangladesh. ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ প্রকাশিত পরিপত্র শিক্ষক নিয়োগের অনুসরনীয় পদ্ধতি যা ২০১৫ সালের গেজেট প্রাধ্যান্য পেয়েছে, ফলে ১-১২তমরা হচ্ছে বঞ্চিত, যদিও ৯নং ধারায় বলা আছে ২০০৬ গেজেটের সাথে সাংঘষিক হলে আইন-বিধি-প্রবিধি সংশোধন যোগ্য। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করা হলো- আপনি ইচ্ছে করলে প্রজ্ঞাপণ জারির মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান করতে পারেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী- বারবার একটি কথা বলেই সব উড়িয়ে দিয়েছেন যে, বিদ্যমান আইনের বাইরে তিনি কিছুই করবেন না।
জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটির ‘‘বিষয়: সরকারি চাকরিতে (বিসিএস ব্যতিত) সরাসরি নিয়োগের লক্ষ্যে ৩০-০৬-২০২৩ তারিখ প্রকাশিতব্য বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২৫-০৩-২০২০ তারিখে নির্ধারণ।’’ এতে ১৩-১৬তম যাদের এন্ট্রিলেভেল ৩৫ বছর তারা লাভবান হলো। কিন্তু মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ৩৯০০/২০১৯ নং মামলার রায় অনুযায়ী বলা- ১২.০৬.২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের পূর্বে যারা শিক্ষক নিবন্ধন সনদ লাভ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে বয়সীমা শিথিলযোগ্য অর্থাৎ নিবন্ধিত শিক্ষকেরা চাকরির বয়সসীমার মেয়াদ শেষ হবার একদিন আগেও সুপারিশ পেলে আইনগত নিয়োগে কোনো বাধা নেই, তাদের আবেদন নেওয়া হলো না যেমনটি দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতেও ঘটেছিল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নিবন্ধিত শিক্ষকদের শুধু হতাশই করেন নাই, কূট-কৌশলে অধিকার বঞ্চিতও করেছেন। সরকারি কোনো আইন বা প্রজ্ঞাপন দ্বারা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে পুনর্বাসন করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতেও কাটছে না কৃত্রিম শিক্ষক সংকট। এনটিআরসিএ এতদিন পর এসে এখন বলছেন- খালি থাকা পদগুলোর জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রার্থী নেই। যে বিষয়ে এরকম সমস্যা সে বিষয়গুলোর পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক ঘাটতি পূরণ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন যোগ্য প্রার্থীর থাকা সত্তে¡ও বছরে একবার (দুইবার গেজেট পরিপন্থি) পরীক্ষা নিয়ে প্রতিবার একটু একটু করে সকল বিষয়ের প্রার্থীদের তালিকার পিছনে দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে বেশ কিছু বিষয়ে ৪০ মার্কেও সুপারিশ করা হচ্ছে এবং ১৭তম থেকে ৪০ মার্কেও মৌখিকে নির্বাচিত হবে। নিবন্ধিত শিক্ষকের মধ্যে এত বৈষম্য, এত বিভেদ, এতা পার্থক্য এর আসল উদ্দেশ্য কি? একেক সময় একেক প্রজ্ঞাপণে কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হলেও নষ্ট হচ্ছে সরকারের ভাবমূতি এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত নিবন্ধনধারী। প্রকৃত নিবন্ধনধারী বলতে কি বুঝানো হচ্ছে সেই বিষয়টা পরিস্কার করার আগে অবৈধ বা জাল সনদ নিয়ে কিছু তথ্য না প্রকাশ করলে সবই বৃথা। অনেক প্রকার জাল সনদ আছে। কেউ কেউ নিলক্ষেত থেকে সনদ বানিয়ে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেছে। এনটিআরটিএ’র সচিব স্যার তো বলেই রেখেছিল কোনো প্রার্থী ইচ্ছে করলেই যেকোনো বয়সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে- বেটার পজিশনের জন্য পরীক্ষা দিতেই পারে। এইতো সুযোগ, জালসনদধারীদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সনদ বদলিয়ে নতুন সনদে চাকরি বৈধ করে নিয়েছে। এতো গেল এনটিআরসিএ’র বাহিরের কথা। শাহবাগে প্যানেল প্রত্যাশীদের আন্দোলন চলাকালিন বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয় এনটিআরসিএ’র এক চঞ্চল্যকর তথ্য। এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যানের ড্রাইভার, এ্যানালাইসিস টাকার বিনিময়ে উচ্চমার্কের সনদ প্রদান করে, আবার চাকরিও পাইয়ে দেয়। বৈধ সনদধারীর পাশাপাশি উচ্চমার্কের এই অনৈতিক সনদের বৈধতা যাচাই করার কোনো পদ্ধতি আছে কী? এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃত যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ সাধারন নিবন্ধনধারীর ভাগ্য কোনো দিনই ফিরবে না। জাল সনদ চিহ্নিত হচ্ছে – আবার অপর দিকে বেতন পাচ্ছে, ঈদ বোনাসও পাচ্ছে। বৈধ সনদধারীরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে আর অবৈধরা চাকরি করছে। কেউ কেউ বলেন- কেন চাকরির পিছনে ছুটছেন, আত্মনির্ভরশীল হন। কথাটা আপাতত সুন্দর হলেও- পাল্টা প্রশ্ন আসতেই পারে- চাকরি তাহলে কারা করবে? শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি- মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না, ঘরে ঘরে চাকরি দিবেন। এসব কি কথার কথা, নাকি বাস্তবতাও আছে? জাল সনদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও প্রতিকারের ব্যাপারে এত উদাসীনতা কেন? সেই অসাধু ড্রাইভার ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদৌও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কী?
যে দিতে পারে, তার কাছেই চাওয়া উচিত। সে হিসেবে শিক্ষকেরা কোনো ভুলে নেই। শিক্ষকেরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন, আশা ভরসা শেষ আশ্রয়স্থল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শিক্ষাক্ষেত্রের এসব জটিলতা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। শিক্ষক আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা একাংশের আবদার বলে চালিয়ে দিলে- শুধু যে শিক্ষকগণ অধিকার বঞ্চিত হবে তা নয়, শিক্ষার প্রকৃত আলো থেকে বঞ্চিত হবে আগামী ভবিষ্যৎ। এনটিআরসিএ’র বিরুদ্ধে হাজারও মামলা-মোকদ্দমাসহ জটিলতা এড়াতে বৈধ সনদধারীদের নিজ নিজ নীতিমালায় নিয়োগ সুপারিশ করতে হবে। এনটিআরসিএ’র বেশির ভাগ নিবন্ধিত শিক্ষকই সরকারি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, অভিজ্ঞ এবং নতুন কারিকুলামে কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অনুসারে প্রত্যেকেরই আছে পিডিএস আইডি। এছাড়াও নিবন্ধিত শিক্ষক, শিক্ষকতা পেশাকে ব্রত হিসেবে নিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্নাতক-মাস্টার্স, এমনকি এমএড-বিএড করেও নামেমাত্র পারিশ্রমিকে (শাখা অনুমোদন না থাকায়) হচ্ছেন বৈষম্যেও শিকার। শিক্ষক বৈষম্য বলুন, জাতীয়করণ বলুন, নিবন্ধিত শিক্ষকদের সাথে প্রহসণ বলুন- সবই এক সূত্রে গাথা।
এনটিআরসিএ’র তথ্যমতে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে স্কুল-কলেজে প্রকৃত চাকরিপ্রত্যাশীর সংখ্যা হিসেবে আবেদন পড়েছে মাত্র ৮১ হাজার। ১-১২তমরা (সনদের মেয়াদ আজীবন) যারা বয়সসীমার বেড়াজালে আটকে গেছে তাদের ডেমো আবেদন নিয়ে সমন্বয় করে নিবন্ধন শিক্ষকদের প্যানেল (ব্যাচভিত্তিক) নিয়োগই একমাত্র সহজ সমাধান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমলমতি-কঁচিকাঁচা শিক্ষার্থীর স্বপ্নের লেখাপড়া বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছায় শিক্ষাক্ষেত্র বিড়ম্বনাময় ব্যর্থ অধ্যায় না হয়ে, হতে পারে সাফল্যগাথা ও গৌরবের ইতিহাস।