পরীক্ষাকেন্দ্র দেখার অভিজ্ঞতা
- শরীফুজ্জামান পিন্টু
- প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১০:০৯ AM , আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১০:০৯ AM
ঢাকার অভিজাত না হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মোহাম্মদপুর। গত এক যুগে এই এলাকার উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। প্রায় দুই দশক পর গিয়েছিলাম মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে। কলেজটি ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার অন্যতম কেন্দ্র এটি। এর কয়েক গজ দূরে মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ। মহিলা কলেজের কিছুটা দূরে মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি দূরে নয় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ ও হাজী মকবুল কলেজ।
এই পাঁচটি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার সিট পড়েছে। আশপাশে আরও পরীক্ষা কেন্দ্র আছে কিনা জানি না। পরীক্ষা শুরুর আগে ওই এলাকাজুড়ে যে যানজট সৃষ্টি হয়েছিল তা বর্ণনাতীত।
গ্রীনরোডের বাসা থেকে রওনা হয়েছিলাম ৭ টা ৫০ মিনিটে। পরীক্ষা শুরু সকাল ১০টায়, কক্ষে উপস্থিতির সময় সাড়ে নয়টা। মিরপুর রোড থেকে যানজট শুরু, এরপর অনেক কষ্টে তাজমহল রোডে যখন পৌঁছালাম তখন নয়টা। অগত্যা হেঁটে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে রওনা হলাম। শত শত পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ দেখে আমাদের এটুকু কষ্ট তেমন কিছুই মনে হয়নি।
পরীক্ষাকেন্দ্র খুঁজে পাওয়ার জন্য এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই। কাছাকাছি তিনটি কলেজের নামের আগে মোহাম্মদপুর থাকায় অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছে। মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের পরীক্ষার্থী এসেছে মোহাম্মদপুর সেন্ট্রাল কলেজে, মোহাম্মদপুর সেন্ট্রাল কলেজের পরীক্ষার্থী গেছে মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজে। নাম কাছাকাছি হওয়াটাই এই বিভ্রান্তির মূল কারণ।
একদিকে অসহনীয় যানজটে সময় খেয়ে ফেলা, আরেকদিকে কেন্দ্র ভুল করে ছোটাছুটিতে পরীক্ষা দেওয়ার আগেই অনেক পরীক্ষার্থীর কাহিল অবস্থা। অবশ্য সব অভিভাবকের উচিত ছিল পরীক্ষা কেন্দ্রের অবস্থান সম্পর্কে আগেই পরিষ্কার ধারণা নেওয়া। অনেকে অবশ্য আগেভাগে পরীক্ষা কেন্দ্র দেখে গেছেন। যারা দেখেননি তাদের অনেকেই ভুগেছেন। পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে এই বিশৃংখল ও নৈরাজ্যকার পরিস্থিতি দেখে মনে হল আমাদের স্কাউট, রোভার স্কাউট, গার্ল গাইডরা কোথায়?
দেশের আট সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে একযোগে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার, যাতে অংশ নিচ্ছে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী। ঢাকা বা বিভাগীয় শহরের বড় কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রে এমন অবস্থা হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। পুলিশের তেমন একটা তৎপরতাও চোখে পড়েনি। এইচএসসি পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়মুখী এসব শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করতে দেশের ছাত্রসংগঠনগুলো এগিয়ে আসেনি। অথচ পরীক্ষার্থীদের সেবা দিয়ে রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ প্রচারের সুযোগ নিতে পারত ছাত্রসংগঠনগুলো।
খবরে দেখলাম শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আগামী বছরের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে কথা বলছেন। পরীক্ষা নেয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলো দেখার দায়িত্ব অনেকের। সেখানে বড় ঘাটতি দেখলাম। একজন পরীক্ষার্থীর যাওয়ার পথ করে দেওয়া বা তাকে পরীক্ষাকেন্দ্র দেখিয়ে দেওয়াটাও বড় সেবা হতে পারে।
এই দৃশ্য দেখে মনে প্রশ্ন জাগে স্কাউট, রোভার স্কাউট, গার্ল গাইড-এদের কাজ কী? বাংলাদেশ স্কাউটসের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখতে পাই সেখানে বলা আছে, ‘একজন স্কাউট এগিয়ে যায় সকলের সাহায্যে। কোন কিছু প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে নয়, মানবতার টানে। কাউকে রাস্তা পার করে দেয়া থেকে দুর্ঘটনা কবলিত কোন বাক্তিতে সর্বোচ্চ সহায়তা করতে দ্বিধাবোধ করে না সে। যে কোন বিপদে বিচলিত হয় না। ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা সে আগেই পেয়ে থাকে স্কাউটিং থেকে।’
তাই পুলিশ বা ছাত্র সংগঠনের কথা বাদ দিলাম, এরকম জনস্রোতে স্বেচ্ছাসেবী ছেলেমেয়েরাও সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। এসএসসি বা এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় স্কাউট বা রোভার স্কাউটরা যদি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অবস্থান করে, পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকদের সহায়তা করে তাতে পরীক্ষার্থীরা যেমন উপকৃত হবে তেমনি স্কাউট করা ছেলেমেয়েরাও সেবা দেওয়া শিখতে পারে। তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের আগে মোহাম্মদপুর থাকায় অন্য এলাকা থেকে যাওয়া পরীক্ষার্থীদের যে বিভ্রান্তি সেটি সম্পর্কে স্কাউটদের ধারনা দিয়ে মাঠে নামানো যেতো। আগাম ধারনা দিতে রাস্তা বা অলিগলির মুখে তারা দাঁড়ালে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। আসলে বড়রাই তাদের দায়িত্ব পালন করেননি, ওদেরকে ডাকলে নিশ্চয়ই আসত।
এই পরিস্থিতিতে বরং দেখলাম রিকশাওয়ালারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ঠিক বা বেঠিক যাই হোক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করছেন, বলে দিচ্ছেন কোন কলেজ কোনদিকে।
যাই হোক, লেখাটা শুরু করেছিলাম মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ঘিরে স্মৃতি নিয়ে। কলেজের সামনে দাঁড়ানোর পর অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে ও পরের দশকের শুরুর দিকে শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টার হিসেবে এই কলেজে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।
কলেজের অধ্যক্ষ এম শরীফুল ইসলামের কক্ষটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পরিপাটি কক্ষে বসতেন ফতুয়া পরা দাপুটে প্রিন্সিপাল। তার কক্ষে সবাইকে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হতো। এসব কথা ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান, অধ্যক্ষ মজিবুর রহমান হাওলাদার, অধ্যক্ষ ইসহাক হোসেন, রফিকা আফরোজসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেতার নাম যাঁদের সঙ্গে সেখানে দেখা হতো। তারা সবাই আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন, চলে গেছেন শরীফুল ইসলাম। উনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। সেই সময়টা ছিল বেসরকারি শিক্ষক আন্দোলনের স্বর্ণযুগ।
জনকণ্ঠে মাঝেমধ্যে ওনাকে নিয়ে একটু খোঁচাখুঁচি করতাম। উনি কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না, অনেক সময় বেফাঁস কথাও বলতেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সিএসপি সচিবকে তিনি মন্ত্রণালয়ের ‘সম্রাট’ বলে ব্যঙ্গ করে তোপের মুখে পড়েন।
মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে অনেককেই চিনতাম। তাদের কেউবা অবসরে, কেউবা পরপারে। একমাত্র লিয়াকত ভাইকে খুঁজে পেলাম, যিনি তখন শিক্ষকদের দাবির পক্ষে শ্লোগান ধরা তরুণ শিক্ষক নেতা ছিলেন।
পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। ওই এলাকার এতোগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জড়ো হবে, কিন্তু সেখানে কোনও প্রস্তুতিই থাকবে না? স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
[লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি; সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক বাংলা]