বার্ধক্য ছুঁতে পারেনি সত্তর বছরেও
দেশের উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষায় আলোকিত করার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) ৭০ বছর অতিক্রম করে ৭১ বছরে পা রাখবে। বর্তমানে গুণগত শিক্ষা প্রদান, গবেষক তৈরি, শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও উচ্চশিক্ষা প্রদানে বিশ্ববিদ্যালয়টি রেখে চলেছে অসামান্য অবদান। এসব নিয়েই কথা অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের অনুভূতি তুলে ধরছেন মো. আব্দুল্লাহ-
‘প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই এটি প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অপরূপ সৌন্দর্য্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এত সবকিছুর মাঝে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে নেই পর্যাপ্ত সিটের সুবিধা, হলের রিডিং রুম গুলোতে নেই পর্যাপ্ত বসার জায়গা, ফলে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটছে। হলের খাবার গুলোর মান নিম্ন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে পর্যাপ্ত পুষ্টি চাহিদা থেকে। এতে তারা নানারকম রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা ঢুকে অসামাজিক কর্মকাণ্ড করছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর তুলনায় অপ্রতুল।ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে মেসে থাকতে হয়।
এর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির লাগাম টানতে হবে। হলের সীট পুরোপুরি রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। দলে নাম না লেখালে টাকার বিনিময়ে উঠতে হয়। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। প্রতিষ্ঠার ৭০ বছরে এসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদন্ডহীনতা দেশ ও জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকেই ইঙ্গিত করে। উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সমাধান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
[শাকিবুল হাসান, শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ]
‘মনের মনিকোঠায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নামটা শুনলেই বুকের মধ্যে একটা সুখের পরশ সৃষ্টি হয়৷সবুজে ঘেরা ৭৫৩ একরের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যে ভরপুর এই ক্যাম্পাস নতুন করে ভালোবাসতে বাধ্য করে বারবার।প্যারিস রোডের দুধারে সুউচ্চ গগন শিরিষ গাছগুলো যেন নিরবেই অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে বাঁচার। প্রতিটি ঋতুতে এই মতিহার চত্বরকে প্রায় নতুন রূপে দেখা যায়৷
এই যে শহীদ মিনারের সন্ধ্যার আড্ডা, শহীদুল্লাহ ভবনের সামনে বন্ধুদের সাথে গিটারের আসর,রবীন্দ্র ভবনের সামনে টুকিটাকি চত্বরে সারাদিনের নানা মানুষের আনাগোনা,পরিবহন মার্কেটের চায়ের আসর, বিশাল গ্রন্থাগার বইয়ের সাগরের নীরবতা, বদ্ধভূমির অপার্থিব সৌন্দর্য, পশ্চিম পাড়ার নারীর আসর, সময়ে সময়ে চারুকলার নানান বাঙালিয়ানার আয়োজন, তাদের রঙের ছোঁয়া .. ইত্যাদি ইত্যাদি। কি ছেড়ে কিসের বর্ণনা করলে বুঝাতে পারব ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি এই ক্যাম্পাসকে। মাঝে মাঝেই নিজেকে হারিয়ে ফেলি এর দিনের সাড়াশব্দের আয়োজনে,দুপুরের ক্লান্তিকর রোদের একাকিত্বে এবং রাতের নিস্তব্ধতায়। ভীষণ মন খারাপের সময় একা হাটতে বের হলে মনে মনে আলিঙ্গন করি পুরো ক্যাম্পাসকে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে স্বপ্নকে ছোঁয়ার মতো। মন্দ-ভালো সবার মধ্যেই থাকে কিন্তু এখানে মন্দের চেয়ে ভালোর পরিমানটা হয়তো হাজারগুনে বেশি এটা বলতে পারি নির্দ্বিধায়। এই খোলা প্রাঙ্গণে এতো এতো ধরণের মানুষ, এতো জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ শিক্ষক-গবেষকদের মাঝে বিচরণ করতে পারাই একটা ভাগ্য। মন মানসিকতাকে বড় করার জন্য সব কিছুই এখানে উপস্থিত৷১৯৫৩ সালের প্রতিষ্ঠা লাভ করা এই বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ বছরে পদার্পণ করলো। প্রাণের ক্যাম্পাসের সুদূর ভবিষ্যতে আরও উন্নতি ও সচ্ছলতা লাভ করুক এটাই কামনা।
[বিশাহ্ তাসনীম ঐশী, শিক্ষার্থী]
‘র্যাঙ্কিং উন্নয়নে কাজ করতে হবে’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুলোর মধ্যে অন্যতম। সুবিশাল গোছানো ক্যাম্পাস, সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে আকৃষ্ট করে অনায়াসেই।১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।এছাড়া প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে যাচ্ছে যারা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠা হওয়ার সত্তর বছর অতিক্রম করলেও নানান সংকট শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে ফেলছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় আবাসিক ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে মেসে থাকতে হয় ফলে তারা হল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।হলের ও লাইব্রেরীর রিডিং রুমে বসার আসন শিক্ষার্থী অনুপাতে অনেক কম ফলে একটা বড় অংশ এসব সুবিধা পাচ্ছে না। এসব সমস্যা নিরসনে প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিবে আশাকরি।
এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় বিদ্যাপীঠ। অথচ বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের তালিকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অত্যন্ত করুণ। কোনোটিতে একেবারে তলানিতে; কোনো তালিকায় স্থানই নেই।
বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রতি বছর র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি সংস্থা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে বিব্রতকর। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে রাবির অবস্থান উন্নয়নেও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
[শাহ্ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, শিক্ষার্থী]
‘সত্তর বছরেও বার্ধক্য ছুঁতে পারেনি’
১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরু হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। আসন্ন ৬ জুলাই দেশের প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ বছরে পদার্পণ করবে। প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয় তার অপার সৌন্দর্য ও তাৎপর্যময় ইতিহাস নিয়ে বাঙালি জাতির গৌরবের কারণ হয়ে আছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিচরণের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই শিক্ষালয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সার্বিক ক্ষেত্রে পদাচারণা রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মুখদের।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা স্যার, যিনি ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ঘাতকের হাতে শহীদ হন; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সমকালীন রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও মননের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, মহাদেব সাহা প্রমুখ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ। এছাড়াও রাজনৈতিক অঙ্গনেও বাংলার প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দীন, বিশিষ্ট রাজনৈতিক আনিসুল হক সহ আরো অনেকে উল্লেখযোগ্য।
এ ভূখন্ডের সব মানুষের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও সংগ্রামের পরিণতি লাভ করার মিছিলে ছায়াসঙ্গী হয়ে শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা। বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট ও ক্রমবর্ধমান পরিসরের কারণে এর ধারাবাহিকতা কিছুটা ব্যাহত হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ বছরের মাইলফলক উদযাপনের মুহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হবে- এ প্রত্যাশা শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে সবার।
[আশিকুর রহমান আশিক, শিক্ষার্থী]