বিশ্বকাপ জয়ীর বাংলাদেশ সফর এবং গণমানুষের আবেগের পুঁজিবাদী বাস্তবায়ন
৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছে। সে বিশ্বকাপ জয়ী দলের ত্রাতার ভূমিকা পালন করা সদস্যদের অন্যতম একজন ছিলেন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার দীর্ঘকায় লোকটির নির্ভীক মানসিকতা এবং চাপের সামনে নিজেকে ঈগল পাখির মতন দু’হাত প্রসারিত করে গোল হজম হওয়া থেকে দলকে রক্ষা করার কসরত তো সারাবিশ্বে সবাই জানে।
বিশ্বকাপে বিশ্ব মাতে। বিশ্বকাপের উন্মাদনা বাকি দেশগুলোর মতন এদেশের লোকজনের মনকেও স্পর্শ করে যায়। ম্যারাডোনার সময় থেকেই হাজার মাইল দূরের ল্যাটিন রাষ্ট্র আর্জেন্টিনার প্রতি এদেশের মানুষের আবেগ এবং উৎসাহ বাড়তে থাকে। যুগের পরিবর্তনে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এখন খোদ আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রাও বাংলাদেশীদের এ উৎসাহ, উদ্দীপনার কথা জানে। তারা জানে লাখ লাখ নির্ঘুম ফুটবল প্রেমী ভক্তদের কথা। যারা নিঃস্বার্থভাবে সমর্থন করে গেছে আলবিসেলেস্তাদের। এরই প্রতিক্রিয়ায় কাতার বিশ্বকাপজয়ী, ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ বাংলাদেশে আসবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে এবং গত ৩ জুলাই ঢাকায় স্বেচ্ছায় ঘুরে যান।
দেশীয় একটি কোম্পানির সহযোগিতায় সে এদেশের মাটিতে পদার্পণ করলেও সরকার দলীয় এমপি, তাদের পুত্র-কন্যারা এবং বেশকিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার তার সাথে দেখা করার সুযোগ পায়। তবে গণমানুষের আর্জেন্টিনার প্রতি যে আবেগ দেখে মার্টিনেজ বাংলাদেশে এসেছিল তা কতটুকু সে অবলোকন করতে পেরেছে, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ প্রশ্ন আরও হতাশার জন্ম দেয় যখন দেশের ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা 'বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন' (বাফুফে)-এর নিষ্ক্রিয়তা এবং বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার প্রতি স্পন্সর কোম্পানির অবহেলাপূর্ণ আচরণ প্রকাশ পায়।
একজন বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারের সাথে যদি বাফুফে অল্প কিছু সময়ের জন্যেও দেশের জাতীয় এবং অনূর্ধ্ব দলের ফুটবলারদের দেখা করার আয়োজন করতে পারতো তবে তা নিঃসন্দেহে দেশের ফুটবলারদের মেন্টাল গ্রুমিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতো। এটিকে প্রেরণা হিসেবে নিতে পারতো অনেক উঠতি বয়স্ক ফুটবলাররা। কিন্তু বাফুফের নীতি নির্ধারকে কোনো প্রকার উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে দেশের ফুটবল প্রেমীরা দেখতে পারেনি। যা একপ্রকার বিরক্ত এবং নিরাশ করেছে সবাইকে। এ যেন দীর্ঘ সময় যাবত নামকা ওয়াস্তে চলা একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার অচলাবস্থার বহিঃপ্রকাশ!
পাশাপাশি নিজ দেশের ফুটবলার জিকো এবং জামাল ভূঁইয়াদের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব এক প্রকার দেশের লাখ লাখ ফুটবল ফ্যানদের আবেগের সাথে করা আচরণের মেটাফোর হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। জাতীয় দলের ফুটবল ক্যাপ্টেনের প্রতি প্রটোকলের দোহাই দিয়ে এমির সাথে সামান্য সৌজন্য সাক্ষাৎ থেকে বিরত রাখা এক প্রকার নিজ জাতির লোকদের প্রতি অবমাননার সামিল হয়েই ধরা দিয়েছে নেটিজেনদের চোখে।
ফুটবলের প্রতি এদেশের মানুষের আবেগ বলা যায় সমভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। সে আবেগে সাড়া দিয়ে এক বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারের এদেশে পদার্পণ এবং গুটিকয়েক অবস্থা সম্পন্ন লোকেদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা, এ যেন আবেগের পুঁজিবাদী বাস্তবায়ন। যে আবেগ সামাজিকভাবে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে থেকে জন্ম নিয়ে উচ্চশ্রণির তরে বাস্তবায়িত হয়! দিনশেষে তৃপ্তির হাসি হাসে গুটিকতক লোকেরা, সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেদন রয়ে যায় নীরবে-নিভৃতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।