২৯ জুন ২০২৩, ১৩:৪৯

এখনও ঈদ আসে কিন্তু আনন্দে ভাটা পড়েছে

মো. শামীম আক্তার  © ফাইল ফটো

ছোটবেলায় ঈদ শব্দটি কানে আসার সাথে সাথেই অজানা এক টুকরো স্নিগ্ধতার আবেশ অন্তর গহীনে উষ্ণতার পরশ ছুঁয়ে দিত। শুরু হতো নানাবিধ আয়োজনের মাধ্যমে ঈদকে বরণ করে নেওয়ার জোরালো প্রতিযোগিতা। তাদের মধ্যে আতশবাজির অবস্থান সবার প্রথমে না দিলে হয়তো তার সাথে অবিচার করা হবে। সেইসব ঈদে আতশবাজির বারুদের গন্ধে সমগ্র এলাকা যেন শব্দপুরীতে পর্যবসিত হতো। কখনো বা এদিক থেকে চকলেট বাজির শব্দ দুম করে উঠতো আবার কখনো ওদিক থেকে বিড়ি বাজির স্বল্প আওয়াজে চমকে উঠতেন এলাকাবাসি।

আবার স্বল্প শব্দওয়ালা তারা বাজির পিড়পিড় করে ফুটতে থাকার সাথে আগুনের ফুলকিগুলো ঝরে পড়া যেন শৈল্পিক তুলিতে আকা নিখুঁত কারুকার্য রূপে পরিবেশিত হতো আঁধারের বুকে। রকেটবাজির কথাও বা ভুলি কীভাবে? সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা, উৎসাহ আর আবেগে গদগদ করা হতো এটি নিয়েই। সম্ভবত উপরে উঠা জিনিসকে আমরা বেশি কদর করা ছোট বেলা থেকেই শিখে গেছিলাম। যাই হোক, আগুন ধরানোর আগ থেকে শুরু হতো উল্লাস, চিল্লাপাল্লা, হাততালি আর দুষ্টুমি। পারলে পেছন থেকে আওয়াজ করে ভয় দেওয়া তো ছিলই। 

বাজির লেজে আগুন লাগতেই হুররেএএএএ কী আনন্দ! বলে প্রচুর হাতে তালি আর নানা রকম  সোর শুরু হয়ে যেত। যাদের নির্দিষ্ট কোনো অর্থ ছিল না। তাদের বেশির ভাগই সীমাহীন আনন্দের সাক্ষী হয়ে বাতাসের সান্নিধ্যে আওয়াজ হয়ে মিলতো। মনে পড়ে আতশবাজির জন্য কত যে দৌড়ানি খেতে হয়েছে ছোট বেলায়। এই আতশবাজির ফোটানোর জন্যই অর্ধেক রাত জেগে যেখানে সেখানে ঘাটি জমাতাম এবং হুটহাট ফুটাতাম। সবাই ঘুম থেকে উঠে চিল্লানি দিত, সেখান থেকে আমরা দৌড় দিয়ে সেটা উপভোগ করতাম। ভাবতেই নিজের অজান্তেই হেসে ফেলি এবং চরমভাবে মিস করি অতীতের সেই পাগলামিগুলো।

ঈদ উপলক্ষ্যে বিশেষ আড্ডা, গান, গল্প ও বিভিন্ন খেলাধুলা সাথে হাত সাজানোর হিড়িক ছিল সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর এবং উপভোগ্য। সারিতে সারিতে বসিয়ে, আপু-ভাবিরা সুন্দর করে হাত সাজিয়ে দিতেন আর মাঝে সুন্দর করে নামের অক্ষর লিখতেন। আমি আগে, আমি আগে বলে যে পাগলামিগুলো করতাম তা আজ একটু মুচকি হাসির কারণ হয়ে লেগে আছে স্মৃতির পাতায়।

ঈদের আগের রাতে নতুন কাপড়ের ট্রায়াল দেওয়া ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে সেটা গভীর রাতে। কারণ কেউ দেখলে তো আবার পুরাতন হয়ে যাবে। ইদের আগের রাতে অজানা আনন্দ ঘুমাতে দিত না। কখন সকাল হবে এই উদ্দীপনা যেন শেষ হবারই নয়। সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে করতে চিনচিনে শান্তি অনুভব করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম।

হঠাৎই সকালে মায়ের আলতো হাতের ছোঁয়া গায়ে লাগতো। আর 'বাবা উঠ, দেখ সকাল হয়েছে, ঈদের মাঠে যাবি না?', শব্দে চোখের পাতাগুলো মেলতো। দুম করে উঠে পড়তাম।কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠা কাজ করতো, কয়টা বেজে গেছে, সবাই আমাকে রেখে চলে যায়নি তো, আমার নতুন কাপড় কই, আমার ইদ সালামী আছে তো? এক কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো একটা অবস্থা।

গোসল সেরে নতুন কাপড় পরা মানেই ব্যাংক ম্যানেজারের ভূমিকায় অবস্থান জানান দেওয়া পাক্কা। সবাইকে সালামী দিতেই হবে। অল্প দিলে হবে না। আর চকচকে রঙিন নোট সে তো লাগবেই। সে ছিল দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা, বিশ টাকা বা পঞ্চাশ টাকার নতুন নোট। এখন কেন জানি হাজার টাকাতেও ওই আনন্দটুকু মেলে না।

এবার পালা দল বেঁধে ঈদের নামাজের জন্য বের হওয়া। সারিতে সারিতে কত রং-বেরঙের বাহারি পোশাকে ছেয়ে যাওয়া রাস্তা। মনে হতো একেবেঁকে জ্বলন্ত রংধনু চলছে। ঈদের নামাজ শেষে সবার সাথে কোলাকুলি করা, হাতে-হাত রেখে করমর্দন করা যেন জন্মজন্মান্তরের সকল ভেদাভেদের অবসান কল্পে সাজানো এক মালার সেতুবন্ধন। এরপর শুরু হতো ঈদের বাজারে কেনাকাটা। কত রঙের বাহারি খেলনা, প্লাস্টিকের পিস্তল, রঙিন বেলুন, কাঠের গাড়ির খেলনা, বাঁশি, মাটির ব্যাংক, মাটির হাড়িকুড়ি, প্লাস্টিকের ঘড়িসহ নানা রকমের কত যে খেলনা।

ঈদ শেষে মারবেল খেলার ধুম পড়তো পাড়া-মহল্লার কোণে-কোণে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে মুরুব্বি কাকা-দাদারাও লেগে পড়তো খেলার উৎসবে। লাগাতে পারছেন না মারবেলে অথচ একটু বিরক্তি নেই। বরং সুন্দর মুচকি হাসি দিয়ে বলতেন এক সময় এ গুটি ছলকা মেরে ভেঙে ফেলতাম; তোদের তো সে জোর নেই। আরও শুনাতো তাদের সময়কার ঈদ আনন্দের কত কথা। তাদের স্মৃতি চারণে জানতে পারতাম আরো ২০-৩০ বছর আগে ইদ কেমন কাটাতেন তারা।

মনে পড়ে সেই সোনালী অতীতের কথা। এখনো ঈদ আসে কিন্তু ওই অনুভূতিগুলো আর নেই। বড় হওয়ার সাথে সাথে কেন জানি সব ভালো লাগার জগতে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। এখনো নতুন কাপড় কেনা হয়, হয় ভোরে উঠে প্রস্তুত হওয়া,  একসাথে নামাজে যাওয়াটাও আগেই মতই আছে সাথে সালামী পাওয়াটাও। কোলাকুলির রেওয়াজটা আজও শেষ হয়নি; শুধু ঝরে গেছে অনুভূতির বাগানে সাজানো হাজারো গোলাপের সুরভিত পাপড়ি আর সাথে করে নিয়ে গেছে ইদ আনন্দ, ভালোলাগা, উৎকন্ঠা, উচ্ছ্বাস আর অন্তর গহিনে গেঁথে থাকা চিনচিনে সুখটুক। তবুও চলছে চলুক অনবরত সময়। সূচিত হোক স্মৃতির ফল্গুধারা। হৃদয়ের গহীন থেকে সবাইকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ